‘শিক্ষাকে গুরুত্ব দেওয়া না হলে, শিক্ষকদের মর্যাদাও কমে যায়’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, শাসকগোষ্টী ধারাবাহিকভাবে শিক্ষাখাতকে অবহেলা করে এসেছে। আর যখন শিক্ষাকে অবমূল্যায়ন করা হয়, তখন অনিবার্যভাবে শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা হরণ হয়।
বিশ্ব শিক্ষক দিবস উপলক্ষে শিক্ষকদের সামাজিক ও আর্থিক মর্যাদার অবমূল্যায়ন এবং ভবিষ্যৎ করণীয় নিয়ে দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে সর্বজন শ্রদ্ধেয় এই শিক্ষাবিদের সঙ্গে।
দ্য ডেইলি স্টার: বিশ্ব শিক্ষক দিবসে আমরা বিশ্বজুড়ে শিক্ষকদের সম্মান জানাই। এমন একটি সময়ে বাংলাদেশের শিক্ষকদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক মর্যাদা আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করেন?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: এই প্রশ্নটা খুব জরুরি। শিক্ষকের মর্যাদাকে কেন্দ্র করে একটা সমস্যা দীর্ঘদিন ধরে চলছে, এখন পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। তাদের সামাজিক অবস্থান ও আর্থিক নিরাপত্তা কমেছে। আগে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে শিক্ষা যতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল, এখন সেটা ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়।

বাংলাদেশ একটি আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদী রাষ্ট্র। এই ব্যবস্থার মধ্যে আমলারা যে প্রাধান্য পান, শিক্ষকরা সেটা পান না। একজন শিক্ষক কোনো অনুষ্ঠানে গেলে, তাকে কেউ খুঁজেও দেখে না। অর্থনৈতিকভাবেও শিক্ষকরা দুর্বল অবস্থানে থাকেন—যা তাদের বেতন স্কেল দেখলেই বুঝতে পারবেন।
ফলস্বরূপ, অনেকেই প্রাইভেট পড়ানো ও কোচিং সেন্টারের ওপর নির্ভর করেন। অনেক শিক্ষক সকালে প্রাইভেট পড়ান, এরপর স্কুলে যান এবং সন্ধ্যায় কোচিং সেন্টারে সময় দেন। দিনের অধিকাংশ সময় এভাবে কাটানোর ফলে ক্লাসে তার শিক্ষাদান ব্যাহত হচ্ছে।
ক্লাসেই শিক্ষাদান এমন হওয়া উচিত যেন শিক্ষার্থীকে আর বাড়িতে গিয়ে না পড়লেও চলে। কিন্তু একজন শিক্ষক যদি ক্লাসে পুরোপুরি মনোযোগ দিতে না পারেন, তাহলে তারা পরিপূর্ণভাবে শিক্ষক হিসেবে ভূমিকা পালন করতে পারবেন না।
ডেইলি স্টার: একসময় শিক্ষকদের যথাযথ সম্মান দেওয়া হলেও এখন এই পরিবর্তনের কারণ কী?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: শাসকগোষ্ঠী কখনো শিক্ষার উন্নয়নকে গুরুত্ব দেয়নি। সরকারের গুরুত্ব ছিল দেশ শাসন করা নিয়ে। জনগণ শিক্ষিত হোক, শিক্ষা ছড়িয়ে পড়ুক, এই দিকে তাদের লক্ষ্য ছিল না।
যখন শিক্ষাকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না, তখন শিক্ষককেও সম্মান দেওয়া হয় না। আমাদের উন্নয়ন পুঁজিবাদী প্রকৃতির। এই উন্নয়ন সমাজে বৈষম্য তৈরি করে, মুনাফাকে প্রাধান্য দেয় এবং এতে শিক্ষার মূল্য কমে যায়।
শিক্ষকরা দেখেন যে, তাদের অর্থনৈতিক উন্নতি প্রয়োজন। তখন তার মনোযোগ যায় উপার্জন বাড়ানোর দিকে, অর্থাৎ ওই কোচিং সেন্টারে—স্বাভাবিকভাবেই এর প্রভাব পড়ে সামাজিক মর্যাদায়।
ডেইলি স্টার: শিক্ষক যখন প্রাইভেট পড়াচ্ছেন বা কোচিং সেন্টারে ক্লাস নিচ্ছেন, কিংবা টাকার বিনিময়ে চাকরি নিচ্ছেন, তখনো তো মর্যাদা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: অবশ্যই ওঠে। টাকা দিয়ে চাকরি নেন, তারপর সেটা তুলে আনার চেষ্টা করেন। আগে মানুষের পেশার মধ্যেই একটা প্রতিযোগিতা ছিল, এখন এই প্রতিযোগিতা হয়ে গেছে সার্বজনীন। আমার প্রতিবেশী যিনি শিক্ষকতা পেশায় নেই, তার সঙ্গেও একটা প্রতিযোগিতা আছে। আমার আয়-উন্নতি যদি অন্যদের থেকে কম হয়, তাহলে পরিবারের মধ্যেই আমার মর্যাদা কমে যায়।
ডেইলি স্টার: আপনি বলছেন, এই সমস্যাটি পুঁজিবাদী মডেল থেকে উদ্ভূত। কিন্তু অন্যান্য পুঁজিবাদী দেশে শিক্ষকরা মর্যাদাপূর্ণ বেতন পান এবং তারা প্রাপ্য সম্মানও পেয়ে থাকেন। তারা কীভাবে পারছে, আর আমরা কেন পারছি না?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: অন্যান্য দেশের পুঁজিবাদী ব্যবস্থা এবং এখানকার বুর্জোয়া কাঠামোর মধ্যে মৌলিক পার্থক্য আছে। অনেক পুঁজিবাদী দেশে উন্নতি হচ্ছে দক্ষতা অর্জন ও জ্ঞানের সাহায্যে। তারা ছড়িয়ে পড়েছেন, জ্ঞান আহরণ করেছেন এবং বুঝেছেন যে শিক্ষাকে মর্যাদা দিলেই, আমরা আরও ভালো জীবনযাপন করতে পারব।
তারা বুঝতে পেরেছিল যে জ্ঞান কেবল এগিয়ে যাওয়ার জন্য নয়, ঔপনিবেশিক আধিপত্যের কৌশলও বটে। অস্ত্র থেকে শুরু করে ব্যবসা-বাণিজ্য পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রে দক্ষতার প্রয়োজন ছিল এবং দক্ষতার জন্য শিক্ষার প্রয়োজন। শিক্ষার উন্নতির জন্য শিক্ষকদের সম্মান করতে হবে এবং তাদের মর্যাদা ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা দিতে হবে—এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এসব দেশ শিক্ষকদের প্রতিযোগিতামূলক বেতন দিয়েছে এবং এই পেশার সামাজিক অবস্থান উন্নত করেছে, যাতে প্রতিভাবানরা শিক্ষকতা পেশায় থাকেন। পুঁজিপতিরা সাধারণত অন্যান্য দেশ থেকে সম্পদ অর্জন করত। কিন্তু আমাদের মতো দেশে উল্টোটা হয়—এখান থেকে সম্পদ বিদেশে পাচার হচ্ছে। এখানে দৃষ্টিভঙ্গির একটা পার্থক্য আছে। ওইসব দেশে পুঁজিবাদী বিকাশের মধ্যে দেশপ্রেমটা ছিল, আমাদের পুঁজিবাদী বিকাশে দেশপ্রেমটা ক্রমাগত কমে গেছে।

ডেইলি স্টার: শিক্ষকদের যে বেতন, ভাতা, সমাজে সম্মান ও নিরাপত্তা পাওয়ার কথা, তা কি পাচ্ছেন বলে মনে করেন?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: মোটেই না। শিক্ষকরা, বিশেষ করে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের শিক্ষকদের কয়েকদিন পর পর রাস্তায় নামতে হচ্ছে, নিপীড়নের শিকার হতে হচ্ছে। শিক্ষকদের সঙ্গে এমন আচরণ করলে তাদের সম্মান কোনোভাবেই বাড়বে না।
আরেকটি ক্ষতিকর কারণ হলো আমাদের তিন ধারার শিক্ষা ব্যবস্থা। পাকিস্তান আমলে সাধারণ, মাদ্রাসা ও ইংরেজি মাধ্যম ছিল। কিন্তু সেটা ছড়িয়ে পড়েছে এবং এর মাধ্যমে শ্রেণি বিভেদ বেড়ে গেছে।
ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের যদি দেখেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া তাদের জন্য অত্যন্ত কঠিন। কারণ, ভর্তি পরীক্ষায় যেসব প্রশ্ন আসে, সেগুলো তাদের পাঠ্যক্রমের সঙ্গে পুরোপুরি মেলে না। স্বাভাবিকভাবেই তারা অন্য পথ দেখে। অনেকেই বিদেশে চলে যায়। ফলে, দেশের মেধা পাচার হয়।
ডেইলি স্টার: সম্প্রতি আমরা দেখতে পেয়েছি, শিক্ষকদের পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে, নানাভাবে হয়রানি করা হয়েছে। এটিকে কীভাবে দেখছেন?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: এটা তো খুবই লজ্জার ও দুঃখের ব্যাপার। শিক্ষক যদি লাঞ্ছিত হন, তাহলে শুধু তিনি নন, গোটা শিক্ষাব্যবস্থা লাঞ্ছিত হয়। শিক্ষক লাঞ্ছনা বড় অপরাধ। তিনি যদি অযোগ্য হন তাকে বিদায় করে দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে বা অন্য কোনো কারণে সংগঠিত হয়ে তাকে লাঞ্ছিত করার মতো বড় অন্যায় আর হয় না। এ ধরনের অন্যায় শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি শিক্ষার প্রতি মানুষের আস্থা কিংবা শিক্ষা ও শিক্ষকের প্রতি মর্যাদার জন্য খুবই হানিকর।
ডেইলি স্টার: শিক্ষকদের সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে যুক্ত হওয়া তাদের পেশাগত নিরপেক্ষতা ও মর্যাদায় কী ধরনের প্রভাব ফেলে?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: শিক্ষকদের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থাকা উচিত। কিন্তু আদর্শ এক জিনিস আর নিয়োগের জন্য রাজনীতি করা আরেক জিনিস। শিক্ষক হওয়ার জন্য কাউকে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত হতে হবে—এই মানসিকতার কারণেই শিক্ষকতা পেশা বিভাজিত হয়েছে।
এখন শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে দুটি বিষয় প্রাধান্য পায়—টাকা এবং রাজনৈতিক আনুগত্য। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে টাকাটাই বড় ভূমিকা পালন করে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে রাজনৈতিক আনুগত্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষক নিয়োগের সময় তাদের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এটা হয়।
এর বিপরীত চিত্র কিন্তু আছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে, সেখানে সাধারণত মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ হয়ে থাকে। যার ফলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবকাঠামো উন্নত থাকলেও, অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় মানের দিক থেকে তাদেরকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে।
ডেইলি স্টার: শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ ও শিক্ষকদের ভূমিকার মধ্যে কি কোনো যোগসূত্র আছে?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: অবশ্যই। শিক্ষা এখন পণ্য। যারা বেশি খরচ করতে পারে, তারা উন্নত মানের শিক্ষা পাবে। শিক্ষা বাণিজ্যিক পণ্য হওয়া উচিত না। সবাইকে সমান সুযোগ দেওয়া রাষ্ট্রের দায়িত্ব।
শিক্ষার্থী যখন কোনো শিক্ষককে গাইডবই বিক্রেতা হিসেবে দেখে, তাহলে শিক্ষকের মর্যাদা কমে যায়। কোচিং সেন্টারে যাওয়া শিক্ষকের জন্য লজ্জার এবং শিক্ষার্থীর জন্য হতাশার।
ডেইলি স্টার: কম বেতনের কারণে শিক্ষকদের অতিরিক্ত আয়ের উৎস খুঁজতে হয়। সমাধান কী?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: সমাধান হলো শিক্ষকের মর্যাদা, বেতন ও ভাতা বৃদ্ধি করা।
ডেইলি স্টার: বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের শিক্ষার মান সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী? আপনি কি মনে করেন, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে প্রতিযোগিতায় সক্ষম?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: আমরা অনেক পিছিয়ে আছি—প্রায় সবদিকেই। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় পরীক্ষাই প্রধান, ফলে আমরা মূলত পরীক্ষার্থী তৈরি করি। পরীক্ষা নিয়ে নানা রকম নিরীক্ষা চলে। বেশি সংখ্যক পরীক্ষা পড়ালেখার মান বাড়ায় না, বরং এটি কেবল কোচিং সেন্টারের খরচ বাড়ায়। আর কোচিং সেন্টার শেখায় কীভাবে পরীক্ষা ভালো হবে।
আরেকটি সমস্যা হলো, এক সরকার একটি পরিবর্তন আনে, পরের সরকার এসে আবার তা বদলে দেয়। পাঠ্যসূচিতে যেভাবে ঘন ঘন পরিবর্তন করা হয়, আমরা কি ইংলিশ মিডিয়ামে এমন দেখি? তাদের পাঠ্যপুস্তক কি এত সহজে বদলে যায়? জ্ঞান তো একই থাকে, কিন্তু আমাদের পাঠ্যপুস্তক থেকে কিছু বাদ দেওয়া, কিছু যুক্ত করার এই প্রবণতা পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকে দুর্বল করে দিচ্ছে।
আরেকটি বিষয় হলো, শিক্ষার সঙ্গে কর্মসংস্থানের সংযোগ করতে হবে—যা আমাদের পুঁজিবাদী উন্নয়নের একটি প্রধান দুর্বলতা। এখানে কর্মসংস্থান বাড়ছে না, কিন্তু শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে। অর্থাৎ, একটা ফাঁপা উন্নয়ন হচ্ছে। এটা অনেকটা এরকম যে—একটা দালান আছে, কিন্তু ভেতরে বসবাসের ব্যবস্থা নেই। শিক্ষিত বেকারের হার ক্রমাগত বাড়ার ফলে একটা ভয়ঙ্কর ব্যাপার হচ্ছে যে ডিগ্রিধারীদের মধ্যেও হতাশা দেখা দিচ্ছে, তারা মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে এবং নানা রকম অপরাধেও জড়াচ্ছে।
তবে, এটা সত্য যে এখনকার অনেক শিক্ষার্থী আগের তুলনায় বেশি জানছে। কিন্তু সেখানেও উল্লেখযোগ্য বৈষম্য রয়েছে—পাঁচ শতাংশের মতো শিক্ষার্থী বেশি জানছে, বাকি ৯৫ শতাংশই অনেক পিছিয়ে আছে।
আগে ডিগ্রি দেখেই একজন শিক্ষার্থীর মান অনুমান করা যেত। এখন আর সেটা নেই। একই ধরণের ডিগ্রিধারীদের মধ্যেও উল্লেখযোগ্য পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়, মানের ব্যবধান হয় ব্যাপক।
বিদেশে যাওয়া শিক্ষার্থীরা প্রতিযোগিতায় ভালো করছে। বিদেশে নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করছে। কারণ, তারা জানে যে টিকে থাকা নির্ভর করবে তার সক্ষমতার ওপর। তারা তাদের সর্বোচ্চ সক্ষমতা, সময় ও প্রতিভা দেখিয়ে ভালো করছে।
ডেইলি স্টার: কিছু শিক্ষার্থীর এই সাফল্য কি ব্যক্তিগত উদ্যোগে, নাকি শিক্ষাব্যবস্থার কারণে?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: এটি শিক্ষাব্যবস্থার জন্য হয়নি। যদি হতো, তাহলে সবাই ভালো করত। ব্যক্তিগত চেষ্টায় তারা ভালো করছে। তারা ভালো পারিবারিক পরিবেশ থেকে এসেছে, ইন্টারনেটের মাধ্যমে সহজেই তথ্য পেয়েছে এবং নিজস্ব উদ্যোগে উন্নতি করেছে।
ডেইলি স্টার: শিক্ষার মানোন্নয়নে শিক্ষকদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। পাঠদানের দক্ষতা, মূল্যায়ন পদ্ধতি এবং নৈতিক প্রস্তুতির দিক থেকে তারা কতটা প্রস্তুত?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: তারা প্রস্তুত নয়। এর বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। বেতন আকর্ষণীয় না হওয়ায় মেধাবীদের শিক্ষক হওয়ার প্রতি আগ্রহ কম। যারা শেষ পর্যন্ত সিভিল সার্ভিস বা বেসরকারি কোম্পানিতে ভালো চাকরি পান না, তারা বাধ্য হয়ে শিক্ষকতায় আসেন। নিয়োগ দেওয়ার সময় শিক্ষার প্রতি তাদের কতটা আগ্রহ আছে সেটা খুব কমই বিবেচনায় নেওয়া হয়। মোদ্দাকথা, শিক্ষাকে কেবলই আরেকটি কর্মসংস্থান হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দিয়েই শিক্ষক তৈরি করা যায় না। প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। কিন্তু সর্বস্তরে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের অভাব রয়েছে। প্রশিক্ষণ নামে আছে, কিন্তু ক্লাসে সেটা কার্যকরভাবে প্রয়োগ হয় না। নতুন শিক্ষকদের নিজস্ব উদ্যোগে বিকাশ করতে হবে। আগে শিক্ষকদের গবেষণা ও প্রকাশনার জন্য উৎসাহিত করা হতো।
পড়াশোনা শুধু শ্রেণিকক্ষেই সীমাবদ্ধ থাকে না। পড়াশোনাকে ক্লাসের বাইরেও নিতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে ছাত্র সংসদ ছিল, তার একটা বড় ভূমিকা ছিল এক্ষেত্রে। কেননা একজন শিক্ষার্থী শুধু ক্লাসরুমে বা ল্যাবরেটরিতে শিক্ষিত হয় না, বাইরে অন্যদের সঙ্গে জ্ঞানের আদান-প্রদানের মাধ্যমে সাংস্কৃতিকভাবে উন্নত হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কারখানা নয়, বরং একটা সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান। আলাপ-আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক, গান, খেলাধুলা করে সে নিজেকে বিকশিত করে এবং তার শিক্ষা গ্রহণ ক্ষমতা বাড়ে।
ডেইলি স্টার: আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা কি গবেষণাকে উৎসাহিত করে?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: এখানে গবেষণা হচ্ছে, কিন্তু সেটা ব্যক্তিগত আগ্রহের জায়গা থেকে। কিন্তু গবেষণার প্রকাশনা বা জার্নালকে একেবারেই গুরুত্ব দেওয়া হয় না। নতুন গবেষণা চাঞ্চল্য সৃষ্টি করবে—কিন্তু তা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খুব একটা আগ্রহী থাকে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের উচিত শিক্ষকের প্রকাশনা দিয়ে মূল্যায়ন করা। এখন তো কেউ একবার প্রভাষক হয়ে গেলে তারপর ধাপে ধাপে অধ্যাপক হয়ে যায়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখন অনেক অধ্যাপক। কিন্তু আগে পদোন্নতির জন্য পিএইচডি বা প্রকাশনা বাধ্যতামূলক ছিল। সেই চাপ এখন আর নেই।
ডেইলি স্টার: সরকার ও সমাজের পক্ষ থেকে শিক্ষকদের মর্যাদা রক্ষায় কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বা নেওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: যথাযথ ব্যবস্থা তো নেওয়া হয়নি। এখানে শিক্ষাকে অপরিহার্য হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। আমাদের দেশে একটি সামাজিক বিপ্লব অত্যাবশ্যক। সামাজিক বিপ্লবের মূল কথা হবে মানুষের সঙ্গে মানুষের অধিকার ও সুযোগের সমান অধিকার। মেধার কারণে পার্থক্য থাকবে, কিন্তু সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরি করতে হবে। শিক্ষকের মর্যাদা ও বেতনের মধ্যে একটি দৃঢ় সম্পর্ক রয়েছে। এই খাতে বরাদ্দ একেবারেই অপর্যাপ্ত। আমরা জিডিপির মাত্র প্রায় দুই শতাংশ বিনিয়োগ করি শিক্ষায় এবং এর বেশিরভাগই দুর্নীতি ও অপব্যবহারের মাধ্যমে নষ্ট হয়।
ইউনেসকো জিডিপির ছয় শতাংশ শিক্ষায় বরাদ্দ দেওয়ার সুপারিশ করে। আমাদের বিশাল জনসংখ্যা ও তাদের শিক্ষিত করে জনসম্পদে পরিণত করতে আমরা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছি যে, এই খাতে বিনিয়োগ জিডিপির ১২ শতাংশ বা তারও বেশি হওয়া উচিত। দক্ষতা ও সৃজনশীলতা বৃদ্ধির জন্য অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের বেশি বিনিয়োগ প্রয়োজন।
Comments