শিক্ষার্থীদের বাঁচাতে সেদিন নিজের জীবন উৎসর্গ করেন মাহরীন

মাহরীন চৌধুরী। ছবি: সংগৃহীত

বিশ্ব শিক্ষক দিবসে শিক্ষার্থীরা যখন কৃতজ্ঞচিত্তে তাদের শিক্ষকদের সম্মান জানাচ্ছে, ঠিক সেই সময়ে একটি নাম হয়ে উঠছে মর্মস্পর্শী—মাহরীন চৌধুরী।

গত ২১ জুলাই মাইলস্টোন স্কুলের হায়দার আলী ভবনে একটি প্রশিক্ষণ উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হয়ে আগুণ লেগে গেলে নিজে বাঁচার জন্য দৌড়ে পালাননি মাহরীন। শিক্ষার্থীদের উদ্ধার করতে তিনি ছুটে যান আগুনের কাছে।

শেষ পর্যন্ত সন্তানতুল্য শিক্ষার্থীদের বের করে আনতে পারলেও তিনি দগ্ধ হন এবং চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।

হাসপাতালে নিজের জীবনের শেষ সময়গুলোতে স্বামী মনসুর হেলালকে মাহরীন বলছিলেন, 'ওরা আমারও সন্তান। কীভাবে ওদের ফেলে চলে আসি বলো? আমার কিছু হয়ে গেলেও ওদের তো এই নরকে ফেলে আসতে পারি না।'

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে শিক্ষক মাহরীন চৌধুরী। ছবি: সংগৃহীত

শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগ পর্যন্ত তিনি ভেবে গেছেন তার শিক্ষার্থীদের কথা।

মাহরীনকে জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়েছিল। তার শরীর তখন শতভাগ দগ্ধ। হাসপাতালে গিয়ে মনসুর দেখতে পান, তার প্রিয়তমা স্ত্রীকে চেনা যাচ্ছে না। ফিসফিস করে শুধু বললেন, 'তুমি এসেছো? আমি আব্বা-আম্মার কাছে যাচ্ছি।'

মাহরীনকে নিয়ে আলাপচারিতায় সম্প্রতি দ্য ডেইলি স্টারকে মনসুর জানান, সেই শেষ দেখায় মাহরীন মনে করিয়ে দিয়েছিলেন, সন্তানদের পড়াশুনার জন্য প্রয়োজন হলে যেন তার গয়না বিক্রি করে দেওয়া হয়।

মাহরীন মাঝে মাঝেই তার সন্তানদের বলতেন, ভাগ্যে যা আছে সেটা হবে। কিন্তু, পড়াশুনার ব্যাপারে কোনো আপোস করা চলবে না। স্নাতকোত্তর শেষ করার পর কর্মজীবন শুরু করতে হবে।

এমনকি মৃত্যুশয্যায়ও স্বামীর কাছে সেই কথাগুলোই বলে গেছেন তিনি।

দুর্ঘটনার সেই রাতেই পৌনে ৯টার দিকে মারা যান মাহরীন। রেখে যান স্বামী ও দুই সন্তানকে।

মনসুর বলেন, 'এখনও মনে হয় সে বাড়িতে আছে। পুরো বাড়িতে তো ওরই ছায়া। সবকিছু ওরই হাতে গোছানো। ও যেভাবে বলত, করত, আজও একইভাবে সব চলছে।'

সকাল সাড়ে ৬টার মধ্যে বারান্দায় পাখিদের খাওয়ানো, সবার জন্য নাস্তা তৈরি ও দুপুরের খাবার তৈরি নিতেন মাহরীন। ৭টায় বের হতেন স্কুলে যাওয়ার জন্য। বাসা থেকে তিন কিলোমিটার দূরে ছিল তার স্কুল ক্যাম্পাস। যাতায়াত করতে রিকশায়। বিকেলের মধ্যে ফিরে আসতেন বাসায়।

২০০৬ সালে মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে ইংরেজিতে স্নাতক সম্পন্ন করে পরের বছর মাইলস্টোনে ইংরেজি ও সামাজিক শিক্ষার শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন মাহরীন। ২০১৯ সালে তিনি কো-অর্ডিনেটর হিসেবে পদোন্নতি পান।

নতুন সেই দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকেই শিক্ষার্থী, তাদের অভিভাবক ও সহকর্মীদের সঙ্গে তার যোগাযোগ আরও বেশি হতে শুরু করে। অনেক সময় তিনি মধ্যরাতের পরেও ফোন ধরে তাদের সঙ্গে কথা বলতেন; নির্দেশনা, উৎসাহ ও পরামর্শ দিতেন।

এমনই একজন সহকর্মী মাসুকা বেগম। যিনি যেকোনো পরামর্শের জন্য ছুটে গিয়েছেন মাহরীনের কাছে। মাসুকাও এই দুর্ঘটনায় মারা যান।

মনসুর বলেন, 'মাহরীন সবসময় মাসুকাকে বড় বোনের মতো সান্ত্বনা দিত। কেউই আর নেই…।'

মাহরীনের বড় ছেলে আইয়ানের বয়স ১৬ বছর। এখন ও-লেভেলে পড়ছে। আর ১৪ বছর বয়সী ছোট ছেলে আদিল নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী।

মনসুর বলেন, 'মাহরীন তো শুধু ওদের অভিভাবক ছিল না, ওদের বন্ধু ছিল।'

চলতি বছরের শুরুর দিকে নীলফামারীর জলঢাকার বোগলাগাড়ি স্কুল অ্যান্ড কলেজের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি নির্বাচিত হন মাহরীন। জাতি গঠনে সরাসরি অবদান রাখার প্রত্যাশা নিয়ে রাজনীতি করারও ইচ্ছা ছিল তার।

'কিন্তু রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার আগে সামাজিক ও শিক্ষামূলক কাজের মাধ্যমে দেশের সেবা করতে চেয়েছিলেন, যোগ করেন মনসুর।

Comments

The Daily Star  | English

Shibli Rubayat, Reaz Islam banned for life in market over scam

In 2022, asset management firm LR Global invested Tk 23.6 crore to acquire a 51 percent stake in Padma Printers, a delisted company, from six mutual funds it manages

1h ago