সব প্রতিকূলতা পেরিয়ে উজ্জ্বল পৃথিন্দ্র

বাবা-মায়ের সঙ্গে পৃথিন্দ্র চাকমা। ছবি: স্টার

বাবা অবসরপ্রাপ্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক, মা গৃহিনী। খাগড়াছড়ির প্রত্যন্ত গ্রামে জন্ম, বেড়ে ওঠা। তারপর দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে অবশেষে সরকারি চাকরি। সদ্য প্রকাশিত ৪১তম বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে প্রশাসন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন পৃথিন্দ্র চাকমা। কেমন ছিল সেই প্রস্তুতি, কাদের উৎসাহ ছিল সবচেয়ে বেশি, সাফল্যের সেই গল্প করেছেন দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে।

আমাদের প্রত্যেকের নিজের একটা গল্প থাকে বলছিলেন পৃথিন্দ্র চাকমা। প্রত্যেকের লক্ষ্যে পৌঁছানোর গল্পটা আলাদা। এক একটা বালিকণা দিয়ে যেমন মরুভূমি হয় তেমনি জীবনের প্রত্যেকটা ঘটনার সমন্বয়ে সফলতা আসে।

'খাগড়াছড়ি জেলার মহালছড়ি উপজেলার চিত্তরঞ্জন কার্বারী পাড়া নামক প্রত্যন্ত গ্রামে আমার জন্ম। ভালো রাস্তাঘাট ও অন্যান্য আধুনিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত গ্রামে আমার বেড়ে ওঠা। গ্রামের চিত্তরঞ্জন কার্বারী পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আমার পড়াশোনার হাতেখড়ি। আমার মাতৃভাষা চাকমা হওয়ায় স্কুলে গিয়ে স্যাররা যখন বাংলায় পড়াতেন তখন শুধু শুনতাম, তেমন কিছুই বুঝতাম না। কুপি জ্বালিয়ে কত বইয়ের অধ্যায় যে না বুঝে টানা মুখস্ত করেছি তার হিসাব নেই। এরপর খাগড়াছড়ি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় হয়ে সর্বশেষ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃষিতে অনার্স এবং কৃষি বনায়ণ ও পরিবেশ বিজ্ঞান থেকে মাস্টার্স সম্পন্ন করি। পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে বৃত্তি পাওয়ার সুবাদে এলাকায় ভালো ছাত্র হিসেবে নামডাক ছিল, সেই সাথে নিজের যোগ্যতা প্রমাণের চেষ্টা সবসময় ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষে থাকাকালীন বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর এক বড় ভাই ও এক বড় বোন ৩৪তম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডারে সুপারিশ পেলে ওনাদের দেখে অনুপ্রাণিত হই,' বলছিলেন পৃথিন্দ্র।

বলেন, 'সত্যি বলতে এর আগ পর্যন্ত বিসিএস পরীক্ষা কী এটাই জানতাম না। এরপর সিদ্ধান্ত নিই একদিন বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারে চাকরি করব, তখন থেকেই নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে চেষ্টা করেছি। মাঝখানে কোটা বাতিল হলে সুযোগ সংকুচিত হয়। তবে কোটার খোটা থেকে বাঁচার জন্য সবসময় কোটা ছাড়া বিসিএস ক্যাডার হওয়ার একটা তীব্র জেদ ছিল। চেষ্টা করেছি সর্বোচ্চ। অবশেষে দীর্ঘ প্রায় চার বছর অপেক্ষার পর চেষ্টার স্বীকৃতি পেয়ে ভালো লাগার অনুভূতি অসাধারণ।'

এই পথচলায় সবচেয়ে কঠিন বিষয় কী ছিল, পড়াশোনার খরচ কীভাবে এসেছে-- জানতে চাইলে পৃথিন্দ্র বলেন, 'বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় নিজে স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য ৩-৪টা টিউশন করতাম। স্কুল শিক্ষক বাবার কাছে টাকা চাইতে মন সায় দিতো না। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষ থেকে টিউশন করে নিজের পড়াশোনাসহ সব খরচ নিজে চালিয়েছি। ক্লাস ও ব্যবহারিক করে সবাই যখন বিকেলে আড্ডা দিতো তখন নিজের খরচ যোগাতে টিউশন করেছি। এই নিয়ে অনেক বন্ধু আড্ডায় থাকতাম না বলে আমাকে নিয়ে হাসি-তামাশা করতো, তবে আমি এসব পাত্তা না দিয়ে আমার লক্ষ্যে কীভাবে পৌঁছাবো তা নিয়ে চিন্তা করেছি। কোনো কিছু শেখার জন্য আমি জুনিয়র অথবা সিনিয়র, যার কাছ থেকে যা পেয়েছি, বুঝে নিয়েছি। সারাদিন ক্লাস করে তারপর ৪-৫টা টিউশন করিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে এসে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনার পাশাপাশি বিসিএসের প্রিপারেশন নিয়েছি। মাঝে মাঝে খুব ক্লান্ত লাগলে আমার বাবা-মায়ের মুখ চিন্তা করে আবার নতুন উদ্যমে পড়াশোনা করেছি।'

পরিবারের সবার ভালোবাসা আর আশীর্বাদ ছিল বলেই এতদূর এসেছেন, বলেন পৃথিন্দ্র।

'বাবা, মা ও ভাইয়ের সাপোর্ট ছিল বেশি। বাবা-মায়ের আমার প্রতি বিশ্বাস ছিল আমি পারব। আমার মা বলতো কেউ না হলেও আমার ছেলে বিসিএস ক্যাডার হবে। মায়ের এই আত্মবিশ্বাস আমাকে আরও আত্মবিশ্বাসী করেছে যে আমি পারব। আমার মায়ের চোখে আমিই সেরা।'

'আমার বাবা প্রাইমারি বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আর মা গৃহিণী, পাশাপাশি চাষাবাদের সাথে সম্পৃক্ত। বাবা প্রথমদিকে বেসরকারি স্কুলের শিক্ষক ছিলেন পরে জাতীয়করণ হলে সরকারি হয়। বাবা স্বল্প বেতনের চাকরি দিয়ে আমাদের দুই ভাইয়ের খরচ চালাতো। আমাদের আবদার পূরণের পাশাপাশি আমাদের পড়াশোনার খরচ যোগাতে আমার বাবা-মাকে অনেকদিন নতুন কিছু কিনতে দেখিনি। তবে আমার চলার পথে যা আবদার ছিল তা বাবা-মা কখনও অপূর্ণ রাখেনি।'

বিসিএস পরীক্ষায় আত্মবিশ্বাস জুগিয়েছে কোন বিষয়? পৃথিন্দ্র বলেন, অনার্সের ফল প্রকাশের পর এটা আমার প্রথম বিসিএস হলেও আমার নিজের উপর আত্মবিশ্বাস ছিল, আমি বিসিএস ক্যাডার হতে পারব। অনেকে অনেক কথা বললেও আমি আমার লক্ষ্য অর্জনে অবিচল ছিলাম, আমার চেষ্টার সর্বোচ্চটা করেছি। আমি সুপারিশপ্রাপ্ত হওয়ায় অনেকে অনুপ্রাণিত হবে। আমি চাই পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মানুষ চেষ্টা করে যেন সফলতার সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছে যেতে পারে।

পাহাড়ে শিক্ষার আলোকবর্তিকা সব জায়গায় ছড়িয়ে যাক এইটা আমার প্রত্যাশা। পাহাড়ের প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নের পাশাপাশি শিক্ষার হার বাড়ানোর ব্যাপারে কাজ করতে চান বলে জানান পৃথিন্দ্র। আর দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে কাজ করে সুখি-সমৃদ্ধ, দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে সরকারকে সাহায্য করাই লক্ষ্য। 

বিসিএস পরীক্ষার জন্য যারা প্রস্তুতি নিচ্ছেন তাদের উদ্দেশে পৃথিন্দ্র বলেন, 'বিসিএস ক্যাডার হওয়া নিঃসন্দেহে সম্মানের। বর্তমান চাকরি বাজারের বিবেচনায় সবাই ক্যাডার সার্ভিসে আসতে চায়। যারা ক্যাডার সার্ভিসে আসতে চায় তাদের প্রথমে নিজের লক্ষ্য স্থির করতে হবে। কঠোর পরিশ্রম করার মন-মানসিকতার পাশাপাশি নিজের উপর আত্মবিশ্বাস রাখতে হবে। বিসিএস পরীক্ষার টপিক অনুযায়ী পড়াশোনা করলে সহজেই এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া যায়। তবে নিয়মিত পড়াশোনা চালিয়ে যেতে হবে। গণিত, বিজ্ঞান, ইংরেজি, সংবিধান ও মুক্তিযুদ্ধের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর উপর বেশি জোর দিতে হবে। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজের পঠিত বিষয়, সমসাময়িক ঘটনাবলীসহ সবকিছুর দিকে নজর রাখতে হবে।

নিজের লক্ষ্যের প্রতি অবিচল থাকা, জেদ, প্রচন্ড ইচ্ছাশক্তি, সৃষ্টিকর্তার ও পিতা-মাতার দোয়া নিয়ে পড়াশোনা করলে অবশ্যই সফলতা আসবে। সর্বোপরি দীর্ঘদিন পড়াশোনা করার মানসিকতা নিয়ে পড়তে বসতে হবে।'

Comments

The Daily Star  | English

Child victims of July uprising: Of abandoned toys and unlived tomorrows

They were readers of fairy tales, keepers of marbles, chasers of kites across twilight skies. Some still asked to sleep in their mother’s arms. Others, on the cusp of adolescence, had just begun to dream in the language of futures -- of stethoscopes, classrooms, galaxies. They were children, dreamers of careers, cartoons, and cricket.

10h ago