২৮ জুলাই: আলোচনায় ‘হাউন আঙ্কেলের ভাতের হোটেল’, নাহিদদের ভিডিও বার্তা

ডিবি কার্যালয়ে আসা ব্যক্তিদের অনেককে ভাত খাওয়ানোর ভিডিও করে প্রচার করে ব্যাপক আলোচিত হয়েছিলেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ। তার এমন কর্মকাণ্ডের কারণে ডিবি কার্যালয়েকে অনেকে মজা করে 'হারুনের ভাতের হোটেল' বলে ডাকতেন।
জুলাইয়ে আন্দোলনের সময় ও ৫ আগস্ট হাসিনার পতনের পর দেয়ালে দেয়ালে আঁকা গ্রাফিতিতেও জায়গা করে নেয় এই 'হাউন আঙ্কেলের ভাতের হোটেল'। কারণ পতিত আওয়ামী লীগের শাসনামলে সরকারবিরোধীদের কাছে এ কার্যালয়টি হয়ে উঠেছিল আতঙ্কের নাম।
চব্বিশের ২৮ জুলাই ঢাকার মিন্টো রোডের এই কার্যালয়ে হেফাজতে থাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয়জন সমন্বয়ক এক ভিডিও বার্তায় সব কর্মসূচি প্রত্যাহারের কথা বলেন।
সেখানেই ধারণ করা ওই ভিডিও বার্তাটি রাত ৯টার দিকে গণমাধ্যমে পাঠানো হয়। ভিডিওতে দেখা যায়, একটি কক্ষে নাহিদ ইসলামের পাশে বসে আছেন সমন্বয়ক সারজিস আলম, হাসনাত আবদুল্লাহ, আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া, নুসরাত তাবাসসুম ও আবু বাকের মজুমদার।
ভিডিও বার্তায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামকে একটি লিখিত বক্তব্য পাঠ করতে দেখা যায়। লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, 'আমাদের প্রধান দাবি ছিল কোটার যৌক্তিক সংস্কার। এটি সরকার ইতিমধ্যে পূরণ করেছে। এখন শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে দ্রুত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি জোর দাবি জানাই। সার্বিক স্বার্থে আমরা এই মুহূর্ত থেকে আমাদের সব কর্মসূচি প্রত্যাহার করছি।'

ওই ভিডিও বার্তা আসার কিছুক্ষণ আগে সাবেক ডিবিপ্রধান হারুন ফেসবুকে একটি পোস্ট দেন। তাতে লেখা হয়, 'বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কেরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিলেন। তাই তাঁদের ডিবি কার্যালয়ে এনে কথা বললাম, কী কারণে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। তাঁদের কথা শুনে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিয়ে আমাদের নানা পরিকল্পনার কথা জানানোর পর তাঁদের উদ্বেগ দূর হয়েছে। শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে টিম ডিবি, ডিএমপি বদ্ধপরিকর।'
ওই পোস্টে সংযুক্ত পাঁচটি ছবিতে হেফাজতে থাকা সমন্বয়কের সঙ্গে এক টেবিলে হারুনকে খাবার খেতেও দেখা যায়।
সেদিন ডিবি হেফাজতে থাকা সমন্বয়কদের কয়েকজনের পরিবার মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয়ে গেলেও তাদের পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হয়নি।
সন্তানের দেখা না পেয়ে কার্যালয়ের সামনে নাহিদ ইসলামের মা মমতাজ নাহার সাংবাদিকদের বলেন, 'ডিবি বলছে নিরাপত্তার কারণে তাদের কাছে রেখেছে। সন্তান মা-বাবার কাছে নিরাপদ। ডিবি অফিসে কিসের নিরাপত্তা?'
তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের ধারণা ছিল—ডিবি থেকে পাঠানো ওই ভিডিও বার্তার মাধ্যমে আন্দোলন থেমে যাবে। কিন্তু ঘটনাটি তাদের জন্য বুমেরাং হয়। সমন্বয়কদের ডিবি কার্যালয়ে আটকে রেখে লিখিত বক্তব্য পাঠ করতে বাধ্য করার ঘটনায় মানুষ আরও ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।
ওই রাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা ডিবির কার্যালয় থেকে প্রচারিত ওই বার্তা প্রত্যাখ্যান করে 'স্পষ্ট বিবৃতি' দেন। এতে বলা হয়, অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে ডিবি কার্যালয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনের ছয়জন সমন্বয়ককে দিয়ে জোরপূর্বক যে বিবৃতি আদায় করা হয়েছে, তা দেশের ছাত্রসমাজ প্রত্যাখ্যান করে।
আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক মাহিন সরকার বলেন, 'অস্ত্রের মুখে ডিবি অফিসে ৬ সমন্বয়কের ভিডিও বিবৃতি নেওয়া হয়েছে। ডিবি অফিস কখনোই ছাত্রদের সংবাদ সম্মেলনের জায়গা নয়।'
এ পর্যায়ে মধ্যরাতে 'সমন্বয়কদের কাছ থেকে জোর করে আন্দোলন প্রত্যাহারের বিবৃতি আদায়, সারা দেশে বিনা বিচারে হত্যা, গুম-খুন, মিথ্যা মামলা ও গণগ্রেপ্তারের প্রতিবাদে' সারা দেশে বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করেন মুক্ত থাকা কয়েকজন সমন্বয়ক।
ঢাকার আটটি স্থানে বিক্ষোভ কর্মসূচি হবে বলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জানান সমন্বয়করা। জায়গাগুলো ছিল—সায়েন্স ল্যাব, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮ নম্বর গেট, জাতীয় প্রেসক্লাব, উত্তরার বিএনএস সেন্টার, মিরপুর-১০, মিরপুরের ইসিবি চত্বর, রামপুরা ও মহাখালী।
হাসিনা বললেন—'খুনি-জালেমদের হাত থেকে দেশটা যেন রেহাই পায়'
চব্বিশের ২৮ জুলাই ছিল রোববার। সেদিন দুপুরে গণভবনে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সহিংসতায় নিহত ৩৪ জনের পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন পলাতক শেখ হাসিনা। পরিবারের সদস্যদের হাতে আর্থিক সহায়তার অর্থ তুলে দেন।
হাসিনা বলেন, 'মানুষ কী দোষ করল যে, এভাবে মানুষ খুন করতে হবে! মানুষ খুন করে সরকার পতন—এটা কবে হয়, কখন হয়? সাধারণ মানুষ কী দোষ করেছে?'
স্বজন হারানো পরিবারের সদস্যদের শেখ হাসিনা আরও বলেন, 'আপনাদের কাছে শুধু এইটুকু বলব, আপনারা সবর করেন। আর আল্লাহকে ডাকেন, যেন এই সমস্ত খুনি-জালেম; এদের হাত থেকে আমাদের দেশটা যেন রেহাই পায়।'
এছাড়া সহিংসতায় নিহতদের পরিবার ও আহতদের পাশে থাকার আশ্বাস দেন হাসিনা। বলেন, 'যতক্ষণ বেঁচে আছি আপনাদের পাশে আছি। আমি আসলে আপনাদের কী বলে সান্ত্বনা দেব? শুধু এটুকু বলব যে, আমি আপনাদের মতই একজন। বাবা-মা, ভাই হারানো সেই এতিম। কাজেই আপনাদের কষ্ট আমি বুঝি। আমি আছি আপনাদের জন্য, আপনাদের পাশে।'
১৬ জুলাই রংপুরে পুলিশের গুলিতে নিহত বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদের বাবা মকবুল হোসেন ও মা মনোয়ারা বেগমসহ পরিবারের অন্য সদস্যরাও সেদিন গণভবনে আসেন শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করতে।
পরে আবু সাঈদের ভাই রমজান আলী জানান, সেদিন তাদের জোর করে গণভবনে নেওয়া হয়েছিল।
২৮ জুলাই আহত পুলিশ সদস্যদের দেখতে রাজারবাগের পুলিশ হাসপাতালেও যান শেখ হাসিনা।
আইএসপিআর- এর বিজ্ঞপ্তি
এদিন আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বিভিন্ন বিদেশি গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে মিথ্যা ও বিভ্রান্তিমূলক অপপ্রচার চালানো হচ্ছে।
'কিছু স্বার্থান্বেষী মহল' এই অপপ্রচার চালাচ্ছে বলে উল্লেখ করা হয় ওই বিজ্ঞপ্তিতে। এতে উল্লেখ করা হয়, 'জনগণের স্বার্থে ও রাষ্ট্রের যেকোনো প্রয়োজনে সেনাবাহিনী সব সময় জনগণের পাশে আছে ও থাকবে।'
সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ব্রিফিং, ফিরল মোবাইল ইন্টারনেট
২৮ জুলাই সচিবালয়ে এক ব্রিফিংয়ে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, ডিবির হেফাজতে নেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের গ্রেপ্তার করা হয়নি। পুলিশ যদি মনে করে তারা ঝুঁকিমুক্ত, তখনই তাদের ছেড়ে দেওয়া হবে।
ওই ব্রিফিংয়ে আন্দোলন ঘিরে সহিংসতায় ১৪৭ জন নিহত হওয়ার তথ্য দেন কামাল। যদিও তখনকার সংবাদমাধ্যমের হিসাবে সংখ্যাটি দুই শতাধিক।
এদিনই ১০ দিন পর সচল হয় মোবাইল ইন্টারনেট।
Comments