রেস্তোরাঁ ব্যবসায় মন্দা

রেস্তোরাঁ, রেস্তোরাঁ ব্যবসা, গণঅভ্যুত্থান, স্টার কাবাব,
স্টার ফাইল ফটো

বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর প্রথমবার ধানমন্ডির স্টার কাবাবের একটি শাখায় যান শিউলি আক্তার ও তার বন্ধু। কিন্তু সেখানে ঢুকে তিনি অবাক হয়ে যান! কারণ স্টার কাবারের ওই আউটলেটে খুব বেশি ভিড় ছিল না।

অথচ অন্য সময়ে সেখানে গিয়ে বসার চেয়ের পেতে কিছু সময় হলেও অপেক্ষায় থাকতে হতো।

আগে স্টার কাবাবে অর্ডার করে দীর্ঘক্ষণ বসে থাকতো হতো। কিন্তু গত বৃহস্পতিবার অর্ডার দেওয়ার মাত্র পনেরো মিনিটের মধ্যে তাদের খাবার চলে আসে। এমনকি সেখানে বসার অনেকগুলো চেয়ার ফাঁকা ছিল। এতে বিস্মিত হয়ে শিউলি একজন ওয়েটারের কাছে জানতে চান, সবকিছু ঠিক আছে কিনা।

জবাবে ওয়েটার বলেন, 'হ্যাঁ, সবকিছু ঠিক আছে। কিন্তু নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায় আগের চেয়ে গ্রাহক কিছুটা কমেছে।'

ওয়েটার আরও জানান, সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিবর্তনের কারণেও মানুষ মিতব্যয়ী হয়েছেন। অতিরিক্ত খরচ করা বা বিলাসিতা থেকে বিরত থাকছেন। সবমিলিয়ে তাদের মধ্যে এক ধরনের অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা কাজ করছে।

বাংলাদেশের বেশিরভাগ রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ী একই পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছে বলে জানা গেছে। রেস্তোরাঁ মালিকরা জানিয়েছেন, তাদের গ্রাহক সমাগম মে মাসের চেয়েও এখন ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ কম।

এর আগে, শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন দমনে তৎকালীন সরকার কারফিউ ও ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউট করলে তখন থেকে রেস্তোরাঁগুলোতে ক্রেতার সংখ্যা কমতে শুরু করে। এরপর গত ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে।

তবে, রেস্তোরাঁগুলোর এই লড়াই নতুন করে শুরু হয়নি। গত বছর থেকেই তাদের ব্যবসায়ে মন্দা পরিস্থিতি বিরাজ করছে। কারণ ২০২৪ সালের শুরুতে জাতীয় নির্বাচন ও ২০২৩ সাল থেকে উচ্চ মূল্যস্ফীতিসহ একাধিক চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে হচ্ছে তাদের।

এছাড়া, মার্কিন ডলার সংকটে আমদানি পণ্যের দাম অনেক বেড়েছে। পাশাপাশি ঢাকার বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ শপিংমলের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় রেস্তোরাঁগুলোর নিরাপত্তা নিয়েও অনেকে উদ্বিগ্ন।

রাজধানীর রামপুরা বাজারের আল কাদেরিয়া রেস্টুরেন্টের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফিরোজ আলম সুমন বলেন, গত তিন-চার মাসে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। কিন্তু আমরা হঠাৎ করে খাদ্যপণ্যের দাম বাড়াতে পারিনি, ফলে আমাদের ব্যবসা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

তিনি জানান, আড়াই মাস আগেও যে কাঁচামাল কিনতে খরচ হতো ১০ হাজার টাকা, সেই একই পণ্য কিনতে তাকে এখন প্রায় ২৫ হাজার টাকা খরচ করতে হচ্ছে।

'তবে এই পরিস্থিতিতেও আমরা যদি আবার খাদ্যপণ্যের দাম বাড়াই তাহলে আরও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ব,' বলেন তিনি।

তিনি আরও জানান, আগে প্রতি মাসের ১০ তারিখের মধ্যে কর্মচারীদের বেতন পরিশোধ করতেন, কিন্তু বিক্রি কমায় বেতন দিতে মাসের শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হচ্ছে। এমনকি ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে বন্ধুবান্ধব ও পরিবারের কাছ থেকে টাকা ধার নিতে হচ্ছে।

ঢাকায় প্রায় ২৫ হাজার রেস্টুরেন্ট আছে। এর মধ্যে গত এক দশকে নগরবাসীকে স্বাস্থ্যসম্মত ও মানসম্পন্ন খাবার সরবরাহের লক্ষ্যে কয়েকশ রেস্টুরেন্ট গড়ে উঠেছে।

বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির (বিআরওএ) তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে ৪ লাখ ৮১ হাজার রেস্তোরাঁ রয়েছে, যেখানে প্রায় ৩০ লাখ মানুষ কাজ করেন।

বিআরওএর তথ্য অনুযায়ী, প্রায় দুই কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত।

সম্প্রতি রাজধানীর বাংলামটরের গোল্ডেন চিমনি রেস্টুরেন্টে গিয়ে দেখা গেছে, সেখানেও ক্রেতাদের উপস্থিতি কম।

গোল্ডেন চিমনির কর্মকর্তা জাফর হোসেন বলেন, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের আগে প্রতিদিন দুপুরে রেস্তোরাঁয় ১৫ থেকে ২০ জন ক্রেতা আসতেন।

অন্য সবার মতো তিনিও ব্যবসা মন্দার জন্য চলমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, আইনশৃঙ্খলার অভাব এবং উচ্চ মূল্যস্ফীতিকে দায়ী করেন।

তবে সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে এবং বিকেল ও সন্ধ্যার সময় বেশি ক্রেতা পাওয়া যাচ্ছে বলে জানান তিনি।

তিনি বলেন, 'দেশ যত স্থিতিশীল হবে, মানুষ তত স্বস্তি বোধ করবে।'

ধানমন্ডি-২৭ নম্বরে হার্ফির শাখার ব্যবস্থাপক সাবিকুন নাহার বলেন, সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের সঙ্গে জুলাই-আগস্টের তুলনা করলে দেখা যাবে, ৬০ শতাংশ ব্যবসা এখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি।

তিনি বলেন, 'উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষ ছয় মাস আগে যতটা টাকা বাঁচাতে পারত, এখন পারছে না। এ কারণে তারা আগের মতো ঘন ঘন রেস্টুরেন্টে আসছেন না।'

ঢাকার মিরপুর-১ এর স্কাই লাউঞ্জের মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ গোলাম মুস্তাফা বলেন, জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তাদের বিক্রি ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ কমেছিল।

কিন্তু গ্রাহকরা ধীরে ধীরে ফিরতে শুরু করায় সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে তাদের ব্যবসা প্রায় ৫০ শতাংশ ঘুরে দাঁড়িয়েছে, বলেন তিনি।

তিনি আরও বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে বেশিরভাগ মানুষ বাইরে খাওয়ার পেছনে অতিরিক্ত খরচ করার ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন। আগে যারা সপ্তাহে তিনবার রেস্তোরাঁয় আসতেন তারাও এখন বড়জোর একবারই আসেন।

বিআরওএর সেক্রেটারি জেনারেল ইমরান হাসান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, জুলাই-আগস্টে ব্যবসার পরিস্থিতি অনেক খারাপ ছিল, তবে পরের মাসগুলোতে কিছুটা উন্নতি হয়েছিল। তারপরও বিক্রি এখন পর্যন্ত ৩০-৩৫ শতাংশ কম।

তিনি আরও বলেন, সরকার যখনই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যথাযথভাবে নিয়ন্ত্রণে আনবে, তখনই রেস্টুরেন্ট ব্যবসায় ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

বর্তমান পরিস্থিতিতে অনেক ব্যবসায়ী তাদের ফিক্সড ডিপোজিটের রসিদ, সঞ্চয়পত্র ভেঙে নানাভাবে ঋণ নিয়ে ব্যবসা চালাচ্ছেন, বলেন তিনি।

Comments

The Daily Star  | English

SC Secretariat Ordinance: Judges may hold executive posts

Lower court judges will be able to hold executive positions in the law ministry as well as state entities even after the establishment of a Supreme Court secretariat aimed at keeping the judiciary free from the executive’s influence, says a draft ordinance.

4h ago