বিনিয়োগ কম, বাড়ছে না জিডিপি

অলঙ্করণ: আনোয়ার সোহেল/স্টার ডিজিটাল গ্রাফিক্স

সরকারি তথ্য বলছে—২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশের বিনিয়োগ-জিডিপি অনুপাত শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ পয়েন্ট কমে ৩০ দশমিক ৭০ শতাংশ হয়েছে। ফলে, ভবিষ্যতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমে যেতে পারে।

ব্যবসায়ীরা বলছেন—করোনা মহামারির পর টাকার দাম কমে যাওয়া, জীবনযাত্রার খরচ বেড়ে যাওয়া ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মতো বিষয়গুলো নতুন বিনিয়োগকে বাধাগ্রস্ত করেছে।

অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কা—বিনিয়োগ কমে যাওয়ায় অদূর ভবিষ্যতে কাজের সুযোগ ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমে যেতে পারে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ তথ্যে দেখা যায়, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সরকারি ও বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ কমছে।

২০২২ সালে শুরু হওয়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হয়। আমদানি খরচ বেড়ে যায়। রিজার্ভ দ্রুত কমে যাওয়ায় টাকার মানও দ্রুত কমতে থাকে।

টাকার দাম কমে যাওয়ায় আমদানি খরচ আরও বেড়ে যায়। বিনিয়োগের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও কাঁচামালের দামও বেড়েছে।

এ ছাড়াও, ২০২৩ সালের মার্চ থেকে উচ্চ মূল্যস্ফীতি নয় শতাংশের বেশি। মানুষের আয় ও প্রতিষ্ঠানগুলোর মুনাফা কমছে। বিনিয়োগের টাকা পাওয়া যাচ্ছে না।

রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। ঘন ঘন নীতি পরিবর্তন, নিয়ন্ত্রকের পরিবর্তন ও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বিনিয়োগকারীরা সতর্কাবস্থায় আছেন। এমনকি অনেকে তাদের পরিকল্পিত বিনিয়োগে দেরি করছেন। অনেকে আবার বাতিলও করে দিয়েছেন।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন দেশে দুর্নীতি, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও জ্বালানি সংকটকে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে প্রধান বাধা বলে মনে করেন।

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দেশে গ্যাস সরবরাহে সীমাবদ্ধতা ও বিদ্যুৎ বিভ্রাটের সময় বিকল্প জ্বালানির খরচ বেড়ে যাওয়ায় অনেক কারখানায় উৎপাদন কমিয়ে দেওয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, 'রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও ব্যবসা পরিচালন খরচ বেড়ে যাওয়ায় বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ কম। এ কারণেই বিনিয়োগ-জিডিপি অনুপাতও কম।'

তার মতে, মূল্যস্ফীতি ও সামগ্রিক সামষ্টিক অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অনিশ্চয়তা তৈরি করছে। নতুন বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে পারছে না।

বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্টের (বিল্ড) সাবেক চেয়ারম্যান আসিফ ইব্রাহিম ব্যবসায় খরচ বেড়ে যাওয়ার পেছনে দুর্নীতিকে মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।

বিনিয়োগ-জিডিপি অনুপাত বাড়াতে তিনি দুর্নীতি দমন ও অর্থনৈতিক বহুমুখীকরণ, প্রণোদনা কাঠামোর পুনর্মূল্যায়ন, ক্ষুদ্র ব্যবসা ও কম আয়ের মানুষকে রক্ষা এবং কর সংস্কারের দিকে মনোযোগ দেওয়ার আহ্বান জানান।

'করোনার পর নতুন বিনিয়োগ নেই বললেই চলে'

ব্যবসায়ীরা বলছেন, মহামারির পর থেকে দেশে বিনিয়োগ কমেছে। ২০২০-২১ অর্থবছরের পর থেকে বেসরকারি বিনিয়োগ প্রায় ধারাবাহিকভাবে কমছে।

'করোনা মহামারির পর থেকে বেসরকারি বিনিয়োগ কমছে,' জানিয়ে বাংলাদেশ চায়না চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির মহাসচিব আল মামুন মৃধা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'মন্দার জন্য অনিয়মিত জ্বালানি সরবরাহ ও সামষ্টিক অর্থনৈতিক দুর্বলতা প্রতিকূল বিনিয়োগ পরিবেশের জন্য দায়ী।'

তার মতে, 'ব্যবসা পরিচালনায় খরচের পাশাপাশি ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় বিদেশি বিনিয়োগকারীদের অনেকে বাংলাদেশে তাদের ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছেন।'

বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'শিল্পায়নবিরোধী নীতি, চলমান জ্বালানি সংকট ও ভঙ্গুর ব্যাংকিং খাতের কারণে বিনিয়োগ কার্যত স্থবির হয়ে পড়েছে।'

সরকারের কার্যকর বিনিয়োগনীতির অভাবের সমালোচনা করে তিনি আরও বলেন, 'পুরোনো বিধিবিধান, দুর্বল পরিষেবা ও নিয়ন্ত্রক বাধাগুলো বিনিয়োগ প্রক্রিয়াকে দেরি করিয়ে দেয়।'

সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক সেলিম রায়হান জাতীয় পরিসংখ্যান সংস্থার প্রকাশিত বিনিয়োগের পরিসংখ্যান নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন।

তিনি মনে করেন, বিনিয়োগ-জিডিপি অনুপাতের হিসাব অর্থনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

'নতুন বিনিয়োগ প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছে। তাহলে পরিসংখ্যান ব্যুরো কীভাবে বিনিয়োগ-জিডিপি অনুপাত ৩০ শতাংশের বেশি বলে জানালো? পদ্ধতি ও তথ্য প্রকাশে স্বচ্ছতার অভাব আছে।'

তার ভাষ্য, জাতীয় হিসাবে তথ্যগত ভুল নীতিনির্ধারকদের বিভ্রান্ত করে। সরকারকে প্রকৃত অর্থনৈতিক সংকট কার্যকরভাবে মোকাবিলায় বাধা দেয়।

বিল্ডের সাবেক চেয়ারম্যান আসিফ ইব্রাহিম কার্যকর নীতিগত সিদ্ধান্তের সুবিধার্থে সঠিক অর্থনৈতিক তথ্যের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন।

পরিসংখ্যান ব্যুরো ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস সংশোধন করে চার দশমিক ২২ শতাংশ করার সঙ্গে সঙ্গে তিনি অন্তর্বর্তী সরকারকে সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার ওপর মনোযোগ দেওয়ার আহ্বান জানান।

সামগ্রিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি প্রয়োজন

পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী এম মাসরুর রিয়াজ সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা, ব্যবসায়িক আস্থা বাড়ানো ও বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ গড়ার ওপর গুরুত্বারোপ দিয়ে বলেন, 'গত কয়েক বছর ধরে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ-জিডিপি অনুপাত ২২ থেকে ২৩ শতাংশের আশেপাশে। এটি লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় কম।'

তিনি আরও বলেন, 'সরকারি বিনিয়োগে কিছুটা প্রবৃদ্ধি দেখা গেলেও বেসরকারি খাত ক্রমাগত গুরুত্বপূর্ণ সমস্যায় পড়ছে। এটি অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করছে।'

নিয়ন্ত্রক সংস্থার অদক্ষতা দূর ও ব্যবসায়ীদের আস্থা বাড়ানো বিনিয়োগ ফিরিয়ে আনার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মন্তব্য করেন তিনি।

Comments

The Daily Star  | English

BNP says ‘no’ to constitutional reforms under interim govt

The BNP has said it will not support any constitutional reforms before the national election in February 2026, arguing that such changes must be made by the next parliament.

5h ago