রপ্তানির অনুমতিতে হু হু করে বেড়েছে ইলিশের দাম

অন্তর্বর্তী সরকার সম্প্রতি ভারত ও মধ্যপ্রাচ্যে ইলিশ রপ্তানির অনুমতি দেওয়ার পরপরই স্থানীয় বাজারে ইলিশের দাম বেড়ে গেছে।
ব্যবসায়ীদের দাবি, সরবরাহ ঘাটতির কারণে এ বছর ইলিশের দাম আগে থেকেই বেশি ছিল। রপ্তানির সিদ্ধান্তের পর দাম আরও বেড়েছে। বিশেষ করে বড় ইলিশের ক্ষেত্রে পাইকারি দাম প্রতি কেজিতে সর্বোচ্চ ৬০০ টাকা ও খুচরোতে ২০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।
কালাপাড়ার মহিপুর ফিশ ল্যান্ডিং সেন্টারের কক্সবাজার ফিশের মালিক মনিরুল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এক কেজির বেশি ওজনের রপ্তানিযোগ্য ইলিশের দাম গড়ে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা বেড়েছে রপ্তানির আদেশ আসার পর।'
তিনি বলেন, 'বড় ইলিশের দাম সম্প্রতি ৮০ হাজার থেকে ৮৫ হাজার টাকা থেকে বেড়ে এখন প্রতি মণ (এক মণে ৩৭ কেজির সামান্য বেশি) এক লাখ থেকে এক লাখ পাঁচ হাজার টাকায় পৌঁছেছে।'
তিনি জানান, বরিশাল, ভোলা ও চাঁদপুরের ব্যবসায়ীরা সাধারণত এখান থেকে বড় ইলিশ কিনে রপ্তানির জন্য পাঠান।
খুচরো পর্যায়েও দাম বেড়েছে ১০০ থেকে ২০০ টাকা।
ঢাকা কারওয়ান বাজারের মাছ ব্যবসায়ী সুক্কুর আলী সম্প্রতি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'রপ্তানির অনুমোদনের আগে ৭০০ গ্রামের ইলিশ প্রতি কেজি দেড় হাজার টাকায় বিক্রি হতো। এখন দাম বেড়ে এক হাজার ৬০০ থেকে এক হাজার ৭০০ টাকা হয়েছে। ৮০০ গ্রামের ইলিশ এক হাজার ৭০০ টাকা থেকে বেড়ে এক হাজার ৮০০ টাকা হয়ে গেছে।'
বরিশালেও ইলিশের দাম বেড়েছে, তবে সেটা ঢাকার মতো বেশি নয়। বরিশালের শাকিল এন্টারপ্রাইজের ম্যানেজার মোহাম্মদ আরিফ জানান, রপ্তানি ঘোষণার পর এক কেজি ওজনের ইলিশের দাম এক হাজার ৯৮০ টাকা থেকে বেড়ে দুই হাজার ২১০ টাকা হয়েছে।
তিনি বলেন, 'কয়েক দিন আগেও ৭০০-৮০০ গ্রামের ইলিশ এক হাজার ৯০০ টাকা ছিল। এখন তা বেড়ে এক হাজার ৯৬০ টাকা হয়েছে।'
পূর্ণদ্যোমে রপ্তানি শুরু হলে দাম আরও ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে বলে তিনি সতর্ক করেন।
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেন, সরকার প্রতিবেশী দেশের অনুরোধে হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজার আগে ভারতে এক হাজার ২০০ টন ইলিশ রপ্তানি করছে।
গত রোববার তিনি বলেন, ধর্মীয় সৌজন্য হিসেবে এবং অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে ভারতে ইলিশ পাঠানোর অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এবার গত বছরের অর্ধেকেরও কম ইলিশ পাঠানোর অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
যদিও ইলিশ রপ্তানির জন্য 'চাপ' রয়েছে বলেও আলোচনা ছিল।
ফরিদা আখতার আরও জানান, প্রবাসী বাংলাদেশিদের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে ১১ হাজার টন ইলিশ রপ্তানিরও অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
ইলিশ আহরণ কমতে থাকার পরও এই মাছ রপ্তানির অনুমতি দেওয়া হয়েছে। নির্বিচারে জাটকা ধরা, পরিবেশ দূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তনসহ নানা কারণে এ বছরের জুলাই ও আগস্ট মাসে ইলিশ আহরণ যথাক্রমে ৩৭ শতাংশ ও ৪৭ শতাংশ কমেছে গত বছরের একই সময়ের তুলনায়।
মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৩ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত জাতীয় ইলিশ উৎপাদন বাড়লেও ২০২৪ সালে ৪২ হাজার টন কমেছে।
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, ঢাকায় বড় ইলিশের দাম আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় সর্বোচ্চ ৬০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।
সোমবার বিভিন্ন আকারের ইলিশ প্রতি কেজি ৯০০ থেকে দুই হাজার ২০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে, যেখানে এক বছর আগে দাম ছিল ৮০০ থেকে এক হাজার ৬০০ টাকা।
সরকারি সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত এক মাসে দাম বেড়েছে ১০ দশমিক ৭১ শতাংশ এবং গত এক বছরে বেড়েছে ২৯ দশমিক ১৭ শতাংশ। ২০২৩ সালের তুলনায় ইলিশ এখন ৩৩ শতাংশ বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে।
গণমাধ্যমের উদ্ধৃতি দিয়ে কনজিউমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) জানিয়েছে, ২০১০ সালে ইলিশ বিক্রি হয়েছে প্রতি কেজি ৪১৭ টাকায়, ২০১৯ সালে ৭৮৯ টাকায় এবং ২০২৫ সালে তিন হাজার ৫০০ টাকায়।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় গতকাল এক প্রজ্ঞাপনে জানিয়েছে, ভারতে অনুমোদিত ইলিশ রপ্তানির জন্য ৩৭টি প্রতিষ্ঠানকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
ইলিশের ন্যূনতম রপ্তানি মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে প্রতি কেজি ১২ দশমিক ৫ ডলার (প্রায় দেড় হাজার টাকা), যা এখনও অভ্যন্তরীণ বাজারমূল্যের চেয়ে কম।
মা ইলিশের প্রজনন মৌসুমে সুরক্ষার জন্য সরকার সাধারণত ১৩ অক্টোবর থেকে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত ইলিশ ধরা, পরিবহন, বিক্রি ও মজুদে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
জেলেরা বলছেন, এ মৌসুমে বড় ইলিশের আহরণ অস্বাভাবিকভাবে কম। কিছু জাটকা ধরা পড়লেও বড় মাছ প্রায় নেই বললেই চলে।
কালাপাড়ার জেলে শাহ জালাল বলেন, 'আমি ছোটবেলা থেকেই ইলিশ ধরছি। বর্ষায় নৌকা ভর্তি বড় ইলিশ নিয়ে ফিরতাম। এ বছর কিছু জাটকা ছাড়া বড় ইলিশ একেবারেই নেই।'
এর জন্য বিশেষজ্ঞরা দায়ী করছেন ছোট জালে অতিরিক্ত মাছ ধরা ও যান্ত্রিক সরঞ্জাম ব্যবহারকে। এসব সরঞ্জাম ব্যবহার করলে সব আকারের মাছই জালে আটকে যায়, ফলে মাছের মজুদ কমে যাচ্ছে।
চাঁদপুরে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. আবু কাওসার দিদার বলেছেন, 'জেলেদের ৬ দশমিক ৫ সেন্টিমিটারের ফাঁস সম্বলিত জাল ব্যবহারের অনুমতি থাকলেও এরচেয়ে ছোট ফাঁসের অবৈধ জাল ব্যাপকভাবে ব্যবহার হচ্ছে। মাঠের তথ্য বলছে, মাত্র ২৩–২৫ সেন্টিমিটার আকারের অনেক অপরিণত ইলিশ ধরা ও বিক্রি হচ্ছে, যা প্রজননকে ব্যাহত করছে।'
তিনি সতর্ক করেন, অপরিণত ইলিশ বা জাটকা ধরা এখন জলবায়ু পরিবর্তনের চেয়েও বড় হুমকি তৈরি করছে ইলিশ মাছ আহরণের ক্ষেত্রে।
(এই প্রতিবেদনে সহযোগিতা করেছেন আমাদের বরিশাল সংবাদদাতা সুশান্ত ঘোষ)
Comments