সাগরে ইলিশের আকাল, ট্রলারের খরচের টাকাই উঠছে না জেলেদের

কক্সবাজারে ট্রলার থেকে ইলিশ নামিয়ে আনছেন জেলেরা। ছবি: মোকাম্মেল শুভ

ইলিশের ভরা মৌসুম শেষ হতে চললেও এবার মধ্যবিত্ত শ্রেণির অনেকের পাতেই পড়েনি জাতীয় মাছ। জেলেরা বলছেন, সাগরে জাল ফেলে ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে সামান্যই। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সাগরে যাওয়ার খরচই উঠছে না। এর সরাসরি প্রভাব পড়েছে বাজারে। আকাশচুম্বী দামে ইলিশ এখন বহু মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে।

গত সপ্তাহে কক্সবাজারের টেকপাড়া এলাকার জেলে হাসান আলীর দুটি মাছ ধরার নৌকা সাগর থেকে ফিরেছে মাত্র ২০০টি ইলিশ নিয়ে। অথচ একসময় তার জাল ইলিশে ভরা থাকত। এবার একটি ট্রলার পেয়েছে ৩০টি ও অন্যটি ১৫০টি ইলিশ। সব মিলিয়ে তিনি মাছ বিক্রি করেছেন দেড় লাখ টাকায়। অথচ জ্বালানি তেল, বরফ, রসদ ও জেলেদের মজুরি বাবদ তার খরচ হয়েছে ৮ লাখ টাকা।

হতাশ হাসান বলেন, 'গত ১২ জুন ৫৮ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষ হওয়ার পর আমরা চারবার সাগরে গিয়েছি। এর মধ্যে তিনবারই লোকসান হয়েছে, একবার শুধু খরচ তুলতে পেরেছি।' কক্সবাজারের অধিকাংশ জেলের এবারের অভিজ্ঞতা তার থেকে ভিন্ন নয়।

শুধু কক্সবাজার নয়, ইলিশের আরেক প্রধান বিচরণক্ষেত্র পটুয়াখালীর উপকূলীয় অঞ্চলেও এবার একই চিত্র। জেলেরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা জাল ফেলেও মাছ পাচ্ছেন না।

নুরুল আফসার নামের এক নৌকার মাঝি জানান, ২২ জন জেলে নিয়ে তার বড় ট্রলারটি এ মাসের শুরুতে সাগরে গিয়েছিল। তিনি বলেন, 'সাগরে মাছ নেই। আমরা কী করব? প্রায় খালি হাতেই ফিরতে হয়েছে।' বৈরী আবহাওয়ার কারণে তাড়াতাড়ি ফিরে আসায় সেবার তার লোকসান হয় প্রায় আড়াই লাখ টাকা। তার আশঙ্কা, এভাবে চলতে থাকলে ব্যবসাটাই ডুবে যাবে।

সাগরে সরবরাহ কম থাকায় বাজারে ইলিশের দামে আগুন লেগেছে। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, গতকাল রোববার ঢাকার বাজারে প্রতি কেজি ইলিশ বিক্রি হয়েছে ৯০০ থেকে ২,২০০ টাকায়, যা এক মাস আগের তুলনায় প্রায় ৭ শতাংশ এবং গত বছরের তুলনায় ২৯ শতাংশ বেশি। গত বছর এই সময়ে দাম ছিল ৮০০ থেকে ১,৬০০ টাকা।

জেলেদের অভিযোগ, নির্বিচারে জাটকা (ছোট ইলিশ) নিধনের কারণেই আজ সাগরে ইলিশের সংকট। জেলে হাসান আলী বলেন, 'আগে আমরা বড় ফাঁসের জাল ব্যবহার করতাম। কিন্তু এখন অনেকে চিকন সুতার 'কারেন্ট জাল' ব্যবহার করে, যাতে ছোট-বড় সব মাছ আটকা পড়ে। এভাবে নির্বিচারে জাটকা নিধনের কারণে বড় মাছ পাওয়া যাচ্ছে না।'

কক্সবাজার ফিশিং ট্রলার মালিক সমিতির সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন বলেন, 'আগস্টের মাঝামাঝি থেকে অক্টোবরের মাঝামাঝি পর্যন্ত জাটকাগুলো উপকূলের কাছাকাছি অগভীর পানিতে চলে আসে। প্রায় ৪০০ গ্রাম ওজন হওয়ার পর তারা গভীর সাগরে যায়। কিন্তু এই সময়ে কুতুবদিয়া থেকে মহিপুর পর্যন্ত হাজার হাজার ট্রলার কারেন্ট জাল দিয়ে নির্বিচারে জাটকা ধ্বংস করে। ফলে সেগুলো আর বড় হতে পারে না।'

আশঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, 'এভাবে চলতে থাকলে একসময় আমাদের সাগর থেকে ইলিশ হারিয়ে যেতে পারে।'

কক্সবাজার মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক আশিষ কুমার বৈদ্য জানান, কেন্দ্রে ইলিশের সরবরাহ দিন দিন কমছে। তিনি বলেন, 'গত তিন মাসে কক্সবাজার কেন্দ্রে মাত্র ৩৫৬ টন ইলিশ এসেছে, যা গত অর্থবছরে ছিল ১,৬২৮ টন।'

পটুয়াখালীর মহিপুর মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. রাজা মিয়া বলেন, 'এ মৌসুমে এক কেজি বা তার চেয়ে বড় আকারের ইলিশ প্রায় পাওয়াই যাচ্ছে না। এবার সব ব্যবসায়ী লোকসান গুনছেন। ছোট ব্যবসায়ীদেরই প্রায় ৫ লাখ টাকা করে ক্ষতি হয়েছে, বড়দের ক্ষতি আরও বেশি। এভাবে চললে অনেক জেলে এ পেশা ছাড়তে বাধ্য হবেন।'

তবে আশার কথা শুনিয়েছেন পটুয়াখালী জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. কামরুল ইসলাম। তিনি বলেন, 'সাগরে প্রচুর ইলিশের বিচরণ আছে। কিন্তু এ বছর ঘন ঘন নিম্নচাপ ও বৈরী আবহাওয়ার কারণে জেলেরা গভীর সাগরে যেতে পারছেন না। আবহাওয়া অনুকূলে এলে জেলেরা আবার বিপুল পরিমাণে ইলিশ পাবেন বলে আশা করা যায়।'

Comments

The Daily Star  | English

15 military officers held in army custody taken to ICT amid tight security

The tribunal is set to review the progress of two cases of enforced disappearance

17m ago