কেন ইলিশের এত দাম—কৃত্রিমভাবে বাড়ানো, নাকি বাস্তবতা

ছবি: মোকাম্মেল শুভ

সাধারণ মানুষের ক্রয়সীমার বাইরে চলে গেছে ইলিশের দাম। শখ করে খেতে চাইলেও ছোট আকারের ইলিশ ছাড়া যেন গতি নেই স্বল্প আয়ের মানুষের।

ইলিশের দাম সবসময়ই তুলনামূলক বেশি থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ে হয়ে উঠেছে লাগাম ছাড়া। স্থানীয় বাজারে ইলিশের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ার কারণ অনুসন্ধানে সম্প্রতি এক সমীক্ষা চালিয়েছে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন।

বৃহস্পতিবার প্রকাশিত 'ইলিশ মাছের বাজারমূল্য সংক্রান্ত সমীক্ষা প্রতিবেদন'-এ বলা হয়, দাদন ব্যবসায়ী ও মধ্যসত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য, সিন্ডিকেট ও রপ্তানিসহ বিভিন্ন কারণে একদিকে যেমন জেলেরা ন্যায্য দাম থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, অপরদিকে ভোক্তাকে কিনতে হচ্ছে চড়া দামে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, সাধারণভাবে ৪-৬ স্তরে হাত বদল হয়ে গ্রাহকের কাছে পৌঁছায় ইলিশ মাছ। প্রতিটি স্তরে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত মূল্য বৃদ্ধি হয়ে থাকে। 'ইলিশের মূল্য বৃদ্ধির অন্যতম ক্ষেত্র হচ্ছে এই সকল আচরণ।'

ইলিশের সাপ্লাইচেইন

প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইলিশ আহরণ থেকে গ্রাহক পর্যায় পর্যন্ত সাপ্লাইচেইন হচ্ছে—

  • জেলে
  • মাছঘাট
  • আড়তদার
  • হোলসেল পাইকার
  • খুচরা বিক্রেতা/দোকানদার
  • ভোক্তা

প্রতিকেজি ইলিশ ধরতে খরচ কত

প্রতিকেজি ইলিশ মাছ ধরতে ছোট, মাঝারি ও বড় নৌকাভেদে কত টাকা খরচ হয় তার একটি গড় খরচও উঠে এসেছে সমীক্ষায়। মাছ ধরার সময়কাল, বছরে মোট যাত্রা, প্রাপ্ত মাছের পরিমাণসহ সার্বিক দিক বিবেচনায় ইলিশ আহরণে নৌকার আকারভেদে প্রতিকেজি মাছ ধরতে গড় ব্যয় হচ্ছে—

  • ছোট নৌকায় ৪৮৩ টাকা ৮৭ পয়সা
  • মাঝারি নৌকায় ৫০৪ টাকা ৩ পয়সা
  • বড় নৌকা বা ফিশিং ট্রলারে ৪৭১ টাকা ৬৯ পয়সা

প্রতিবেদন অনুযায়ী, জেলেরা মাছ ধরে নিয়ে আসার পর এই খরচের সঙ্গে আরও কিছু আনুষঙ্গিক খরচ যোগ হয় চূড়ান্ত পর্যায়ে ইলিশ মাছের দামের সঙ্গে। এর মধ্যে রয়েছে ইলিশ আহরণে নিষেধাজ্ঞার সময়কালে জেলেদের জীবনধারণ ব্যয়, উৎপাদকের মুনাফা, আড়ত কমিশন, সংরক্ষণ ব্যয়, ফড়িয়া ও পাইকারের মুনাফা, খুচরা ব্যবসায়ীর মুনাফা ইত্যাদি। সার্বিক খরচসহ প্রতিকেজি ইলিশের গড় মোট খরচ হচ্ছে—

  • ছোট নৌকায় ধরা মাছে ৮১৩ টাকা ১০ পয়সা
  • মাঝারি নৌকায় ধরা মাছে ৮৪৬ টাকা ৭৩ পয়সা
  • বড় নৌকা বা ফিশিং ট্রলারে ধরা মাছে ৮২৮ টাকা ৪ পয়সা

ইলিশের অস্বাভাবিক দামের কারণ

অথচ, বাজারে কেজিভেদে ইলিশ মাছ বিক্রি হচ্ছে ৮৫০ থেকে ৩ হাজার টাকা কেজি দরে। অতিরিক্ত মূল্যবৃদ্ধির কারণ হিসেবে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যেসব দাদন ব্যবসায়ী জেলেদের জন্য বিনিয়োগ করেন, তারা মাছঘাটে সর্বনিম্ন দাম নির্ধারণ করে দেন। ফলে, ওই দামের নিচে ইলিশের বিডিং নামানো সম্ভব হয় না এবং মাছের দাম বেড়ে যায়।

ইলিশের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধির পেছনে অন্তত ১১টি কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। সেগুলো হলো—

  • চাহিদা ও সরবরাহের ভারসাম্যহীনতা
  • মজুদ ও সিন্ডিকেট
  • জ্বালানি তেল ও পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধি
  • মাছ ধরার খরচ বৃদ্ধি
  • নদীর নাব্যতা সংকট ও পরিবেশগত কারণ
  • অবৈধ জালের ব্যবহার
  • দাদন
  • বিকল্প কর্মসংস্থান না থাকা
  • নিষিদ্ধ সময়ে মাছ ধরা
  • মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য
  • রপ্তানি

ইলিশের দাম কমাতে করণীয়

ইলিশের দাম বৃদ্ধির জন্য রপ্তানিকে একটি কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হলেও, প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, 'রপ্তানির পরিমাণ খুব বেশি না হলেও যে রপ্তানি মূল্য দেওয়া হয়েছে তা স্থানীয় বাজারমূল্যের অর্ধেক। এই তথ্য নির্দেশ করে, বিদ্যমান রপ্তানি মূল্যে যদি ব্যবসায়ীরা মুনাফা করতে পারে তাহলে স্থানীয় মূল্যে ব্যবসায়ীরা উৎপাদন ব্যয়ের তুলনায় অস্বাভাবিক হারে মুনাফা করছে বলে প্রতীয়মান হয়।'

এসব সমস্যা সমাধানে একগুচ্ছ সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। সেগুলো হলো—

  • মধ্যস্বত্বভোগীর দৌরাত্ম্যরোধে জেলেদের সমবায় সমিতি গঠন, যাতে তারা সরাসরি মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র থেকে পাইকার বা বড় খুচরা বিক্রেতাদের কাছে মাছ বিক্রি করতে পারে।
  • বাজারে স্বচ্ছতা বৃদ্ধি ও সাপ্লাইচেইনের ধাপ কমাতে সরকারের সহযোগিতায় অনলাইন প্ল্যাটফর্ম তৈরি।
  • ভোক্তাদের জন্য ন্যায্য মূল্যে ইলিশ নিশ্চিত করতে মৌসুমে প্রধান শহরগুলোতে সরকারি উদ্যোগে বিশেষ বিপণন কেন্দ্র স্থাপন করা, যেখানে জেলে বা তাদের সমিতি সরাসরি মাছ বিক্রি করতে পারবে।
  • মাছের অপচয় রোধ ও গুণগত মান বজায় রাখাতে মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র ও প্রধান পরিবহন রুটে আধুনিক কোল্ড স্টোরেজসহ প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিশ্চিত।
  • সরকারের রাজস্ব বাড়াতে এই সাপ্লাইচেইনে জড়িত সবার রেজিস্ট্রেশন ও লাইসেন্স বাধ্যতামূলক করা।
  • ইলিশ মাছের কৃত্রিম সংকট ও অধিক মুনাফা বন্ধে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর এবং স্থানীয় প্রশাসনের নিয়মিত বাজার তদারকি করা।
  • জেলেদের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতে তাদের কাছে প্রতিদিনের বাজারদর, চাহিদা ও সরবরাহের তথ্য সরকারিভাবে মোবাইলে এসএমএস বা অ্যাপের মাধ্যমে পৌঁছে দেওয়া।
  • লেনদেনে স্বচ্ছতা আনতে ও দাদনের প্রভাব কমাতে জেলেদের জন্য ডিজিটাল পেমেন্ট সিস্টেমের প্রচলন করা।
  • ইলিশ সংরক্ষণ ও বিপণনের সঙ্গে সম্পৃক্ত সব আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করা এবং প্রয়োজনে সংশোধন করা।
  • ইলিশের ন্যায্যমূল্য এবং সুষম বণ্টনের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট জাতীয় নীতি প্রণয়ন করে সাপ্লাইচেইনের প্রতিটি ধাপকে অন্তর্ভুক্ত করে যৌক্তিক মুনাফা নির্ধারণ করা।
  • মাছের প্রক্রিয়াজাতকরণ ক্ষতি কমাতে জেলেদের প্রশিক্ষণ দেওয়া।
  • দাদনের দৌরাত্ম্য কমাতে সহজ শর্তে জামানতবিহীন ব্যাংক ঋণ ও ক্ষুদ্রঋণের ব্যবস্থা করা।
  • ইলিশের আকার অনুযায়ী সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য নির্ধারণ করে দেওয়া।

ইলিশ মাছের সিংহভাগ সমুদ্রের মোহনা ও গভীর সমুদ্র থেকে আহরিত হয়। ডিম পড়ার সময় ইলিশ সমুদ্র থেকে নদীর মোহনায় মিঠা পানিতে আসে।

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট ও বিভিন্ন সরকারি প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, মোট আহরিত ইলিশের প্রায় ৬০ শতাংশই ধরা হয় সমুদ্র থেকে। বাকি ইলিশের ১৫ শতাংশ নদী ও ২৫ শতাংশ নদীর মোহনা থেকে আহরিত হয়।

মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত কয়েক বছর ধরে ইলিশের সরবরাহ ক্রমাগত বাড়লেও ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কমেছে। বিগত সময়ের তুলনায় ২০২৫ সালের জুলাই পর্যন্ত নদীতে ইলিশ মাছের সরবরাহ দুই-তৃতীয়াংশ কমেছে।

দেশে সবচেয়ে বেশি ইলিশ পাওয়া যায় ভোলা জেলায়। এরপরই বরগুনা, পটুয়াখালী, চট্টগ্রাম, বরিশাল, কক্সবাজার, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালীর অবস্থান।

বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান মইনুল খান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সম্প্রতি ইলিশ মাছের অস্বাভাবিক উর্ধ্বমুখী দামের কারণে বাজারে যে অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে, তাই ভোক্তাদের স্বার্থে এই সমীক্ষা করা হয়েছে।'

'ইলিশ মাছের দাম বাড়ার পেছনে কৃত্রিমতার সংযোগ রয়েছে। সমীক্ষায় চিহ্নিত মূল জায়গা হলো আহরণ পরবর্তী মধ‍্যস্বত্বভোগীদের নানা স্তর ও তাদের অতিরিক্ত মুনাফা,' বলেন তিনি।

মূলত দাদন ব্যবসায়ীদের কারসাজি এর পেছনে বেশি ভূমিকা রাখছে বলে উঠে এসেছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

তিনি বলেন, 'সমীক্ষায় এসব স্তর কমানোর উদ্যোগ নেওয়া, দাদন ব্যবসায়ীদের মনিটর করা এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ইলিশ মাছের খরচ বিশ্লেষণ করে এর সাইজ অনুযায়ী সর্বোচ্চ দাম নির্ধারণ করার সুপারিশ করা হয়েছে। এতে ইলিশের প্রান্তিক বিক্রেতা ন‍্যায‍্য দাম পাবে, অন্যদিকে ভোক্তাদের কাছে তা নির্ধারিত দামে বিক্রি হবে।'

Comments