খেলাপি ঋণের ৭১ শতাংশই ১০ ব্যাংকে

অলঙ্করণ: আনোয়ার সোহেল/স্টার ডিজিটাল গ্রাফিক্স

দেশের ব্যাংকিংখাতের মোট খেলাপি ঋণের (এনপিএল) ৭১ শতাংশই রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি মিলিয়ে মাত্র ১০ ব্যাংকে।

বিপুল পরিমাণ টাকা খেলাপি হওয়ায় এসব ব্যাংক আর্থিকভাবে ভঙ্গুর অবস্থায় আছে। এটি সামগ্রিকভাবে ব্যাংকিং খাতের ওপর চাপ বাড়িয়েছে।

গত মার্চে ব্যাংকিংখাতে খেলাপি ছিল রেকর্ড চার লাখ ২০ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য বলছে, এর মধ্যে ১০ ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ তিন লাখ ২৮ কোটি টাকা।

এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত চার প্রতিষ্ঠান হচ্ছে—অগ্রণী, জনতা, সোনালী ও রূপালী ব্যাংক।

বাকি ছয়টি হলো—ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, আইএফআইসি ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ও ইউনিয়ন ব্যাংক।

মূলত ব্যাপক অনিয়ম ও আর্থিক কেলেঙ্কারির কারণে সবচেয়ে বেশি মন্দ ঋণ জনতা ব্যাংকের।

গত মার্চ পর্যন্ত জনতা ব্যাংক মোট ৯৪ হাজার ৭৩৪ কোটি ৯৪ লাখ টাকা ঋণ বিতরণ করেছে। এর মধ্যে ৭০ হাজার ৮৪৫ কোটি ৬৮ লাখ টাকা খেলাপি হয়েছে।

এক সময়ের জনপ্রিয় জনতা ব্যাংক বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অ্যানটেক্স, ক্রিসেন্ট, বেক্সিমকো, থার্মেক্স ও এস আলম গ্রুপের ধারাবাহিক আর্থিক কেলেঙ্কারির কারণে সুনাম হারায়।

এর খেলাপি মাত্র নয় মাসে ৪৮ শতাংশ বেড়েছে। গত বছরের জুনে তা ছিল ৪৮ হাজার কোটি টাকা।

ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে। দেশের সবচেয়ে বড় শরিয়াহভিত্তিক এই ব্যাংক বিতর্কিত এস আলম গ্রুপের কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়ে। গত বছরের আগস্টের মাঝামাঝি পর্যন্ত এই শিল্পগোষ্ঠী ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ নিয়ন্ত্রণ করত।

চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ছিল ৪৭ হাজার ৬১৮ কোটি টাকা। এটি মোট বিতরণ করা ঋণের ২৭ দশমিক ৩৮ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, ইসলামী ব্যাংকের বিতরণ করা এক কোটি ৬৩ হাজার ৮৬৩ কোটি ৭৮ লাখ টাকা ঋণের অর্ধেকের বেশি নিয়েছে এস আলম গ্রুপ ও এর সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো।

গত বছরের জুন শেষে অর্থাৎ ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ঠিক আগে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ছিল মাত্র সাত হাজার ৭২৪ কোটি টাকা।

মার্চ পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ২৯ হাজার ৭২০ কোটি টাকা। এটি ব্যাংকটির বিতরণ করা ঋণের ৪১ দশমিক ৩৫ শতাংশ।

এটি গত বছরের জুনের তুলনায় ৩৯ দশমিক ৩৭ শতাংশ বেশি। অগ্রণী ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা রাষ্ট্রীয় এই ব্যাংক থেকে বড় অঙ্কের ঋণ নিতেন।

গত মার্চে ন্যাশনাল ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২৭ হাজার ৩৫২ কোটি টাকা। এটি ব্যাংকটির বকেয়া ঋণের ৬৪ শতাংশ। নয় মাস আগে তা ছিল ২০ হাজার ৯২৯ কোটি টাকা।

গত বছরের আগস্টের শুরুতে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর ন্যাশনাল ব্যাংকসহ আরও ১০ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

দেশের প্রথম বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক ন্যাশনাল ব্যাংক ঋণ অনিয়ম, দুর্বল প্রশাসন ও অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে লোকসানে পড়ে।

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের ১৬ বছরের শাসনামলে ব্যাংকটির ওপর সিকদার গ্রুপের আধিপত্য ছিল।

রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) ভাইস চেয়ারম্যান ও ব্যবসায়ী আবদুল আউয়াল মিন্টু ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।

এ ছাড়া, এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে থাকা ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ও ইউনিয়ন ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে।

ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ২২ হাজার ৬৪৬ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। এটি বিতরণ করা মোট ঋণের ৩৬ দশমিক ৬৩ শতাংশ।

সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ১৪ হাজার ৩৬০ কোটি টাকা বা মোট বিতরণকৃত ঋণের ৩৮ শতাংশ। ইউনিয়ন ব্যাংকের খেলাপি ২৫ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা। এটি ব্যাংকটির বিতরণ করা ঋণের প্রায় ৯০ শতাংশ।

গত মার্চে আইএফআইসি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়ে হয় ২৫ হাজার ৯৭১ কোটি টাকা। এটি গত বছরের জুনে ছিল তিন হাজার ৭৫৬ কোটি টাকা।

ব্যাংকটির কর্মকর্তাদের অভিযোগ, আইএফআইসি ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ও ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ব্যাংকটিকে ব্যক্তিগত স্বার্থে ব্যবহার করেছিলেন।

অপর রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১৯ হাজার ৯১ কোটি টাকা। এটি বিতরণ করা ঋণের ২১ দশমিক ১১ শতাংশ।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, রূপালী ব্যাংকের খেলাপি ১৭ হাজার ১২২ কোটি টাকা বা মোট ঋণের ৩৬ শতাংশ।

ইসলামী ব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ওমর ফারুক খান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ব্যাংকের খেলাপি ঋণ আদায়ে সর্বাত্মক চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু বড় ঋণগ্রহীতাদের অসহযোগিতার কারণে ঋণ আদায় সন্তোষজনক পর্যায়ে পৌঁছায়নি।'

তিনি জানান, গত দুই মাসে ঋণ আদায়ে এস আলম গ্রুপসহ বেশ কয়েকটি বড় ঋণগ্রহীতার বিরুদ্ধে নেগোশিয়েবল ইনস্ট্রুমেন্ট আইনে ৩৭০টি ও অর্থঋণ আদালতে ২৪টি মামলা করা হয়েছে।

'আমানত বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকের আর্থিক অবস্থার উন্নতি হয়েছে' বলে মন্তব্য করেন তিনি।

অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি বিগত সরকারের আমলে ব্যাপক অনিয়মের প্রতিফলন। আমি চেয়েছিলাম প্রকৃত পরিস্থিতি সামনে আসুক। এ কারণে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে।'

ব্যাংকটির ঋণ আদায়ের প্রচেষ্টা সন্তোষজনক নয় বলে জানান তিনি।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ মইনুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ঋণখেলাপিদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনতে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে হবে। অন্যথায় অন্যরাও ঋণ খেলাপি হতে উৎসাহিত হবেন।'

Comments

The Daily Star  | English

Audits expose hidden bad loans at 6 Islamic banks

Asset quality reviews by international auditors KPMG and Ernst & Young have revealed that six Shariah-based banks in Bangladesh are in a dire financial state, with non-performing loans (NPLs) skyrocketing four times greater than previously reported.

5h ago