স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকে ৩০ ভাগই খেলাপি ঋণ, পিতা-পুত্র বিরোধে ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত
পিতা-পুত্রের ক্ষমতার বিরোধসহ নানা সংকটে জর্জরিত স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক। বোর্ডরুমে এই বিরোধ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে ব্যাংকের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণও প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠছে। আর ঠিক এমন অবস্থার মধ্যেই ব্যাংকের খেলাপি ঋণ মোট ঋণের প্রায় এক-তৃতীয়াংশে পৌঁছে গেছে—যা পরিস্থিতিকে আরও উদ্বেগজনক করে তুলেছে।
শরীয়াভিত্তিক এই ব্যাংকের খেলাপি ঋণের ঊর্ধ্বগতি শেয়ারহোল্ডারদের পরিচালনায় সমস্যা থাকার বিষয়টিকে স্পষ্ট করে তুলেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকও এ ব্যাংকটিকে নজরদারিতে রেখেছে—এমনই তথ্য পাওয়া গেছে নথিপত্রে।
যখন দেশের ব্যাংকিং খাত আস্থা সংকট আর বাড়তে থাকা খেলাপি ঋণের চাপে রয়েছে, ঠিক সেই সময় স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ১৬ সদস্যের বোর্ড দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. হাবিবুর রহমানকে রাখা হবে কি না, এই নিয়ে বিরোধ চলছে ব্যাংকটিতে।
ব্যাংকটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল আজিজ ও তার ছেলে ভাইস চেয়ারম্যান একেএম আবদুল আলিম এখন দুই বিপরীত শিবিরের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
আলিমপক্ষ এমডি মো. হাবিবুর রহমানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছে। তারা বলছে, এর আগে ইউনিয়ন ব্যাংকে কাজ করার সময় তিনি ঋণ জালিয়াতিতে জড়িত ছিলেন। তাই তাকে অপসারণ করতে হবে। এই পক্ষ দুবার বাংলাদেশ ব্যাংকে চিঠি দিয়ে তাকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানোর অনুরোধও করেছে।
তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের অনুরোধ নাকচ করে বলেছে, অভিযোগ এখনো প্রমাণিত হয়নি। তাই এমডি পদে হাবিবুর রহমানকেই রাখতে হবে।
এদিকে চেয়ারম্যান আজিজপক্ষ বলছে, হাবিবুর রহমান নির্দোষ। অন্য পক্ষ ব্যাংকের স্বাভাবিক কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করছে এবং লন্ডন ও যুক্তরাষ্ট্রের এক্সচেঞ্জ হাউজসহ মূল জায়গাগুলোতে তাদের পছন্দের লোক নিয়োগ দিতে চায়।
চেয়ারম্যান আজিজ বলেন, 'এমডি কোনো ভুল করেননি। যদি করতেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাকে থাকতে দিত না।' তিনি গত ৫ নভেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে লেখা এক চিঠিতে জানান, অন্য পক্ষ ব্যাংকের কাজ ব্যাহত করছে।
আলিমপক্ষ চারদিন পর আরেকটি চিঠি পাঠায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকে। সেখানে তারা আবারও এমডিকে সরানোর দাবি জানিয়ে বলে, দুর্নীতির "অনেকগুলো মামলা" তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) রয়েছে।
দ্য ডেইলি স্টার এই চারটি চিঠি দেখেছে।
নাম না প্রকাশের শর্তে ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলেন, এই বিরোধে সিদ্ধান্ত নেওয়াই অসম্ভব হয়ে পড়েছে। বোর্ডের বৈঠকগুলো প্রায়ই তর্কে শেষ হয়, বিশেষ করে কর্মকর্তাদের নিয়োগ-বদলি আর ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে।
ব্যালান্স শিটে ধস
স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৯৯ সালের ৩ জুন। ২০২১ সালের জানুয়ারিতে এটি পূর্ণাঙ্গ শরিয়াভিত্তিক ব্যাংক হয়।
এখন বোর্ডের এই বিবাদ চলছে, অন্যদিকে ব্যাংকের আর্থিক অবস্থাও দুর্বল হয়ে পড়েছে। ২০২৪ সালের শেষে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৫ হাজার ৯৬৮ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ২৯ দশমিক ৩ শতাংশ। চার বছর আগে এই হার ছিল মাত্র ৪ দশমিক ৮ শতাংশ।
গত বছরের আগস্টে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই ব্যাংক পরিদর্শন আসে। তখন ব্যাংকের অনেক গোপন খেলাপি ঋণের তথ্য বের হয়।
একইভাবে, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের খেলাপি ঋণও বেড়ে গেছে। কারণ বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের নির্দেশ দিয়েছে আগেকার 'ভালো' হিসেবে চিহ্নিত অনেক ঋণ আবার 'খেলাপি' হিসেবে পুনঃশ্রেণিকরণ করতে।
২০২৩ সালে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ১ হাজার ৩৭৯ কোটি টাকা। ২০২৪ সালের শেষে মোট আমানত দাঁড়ায় ২০ হাজার ১২৫ কোটি টাকা এবং মোট বিনিয়োগ ২০ হাজার ৩৬১ কোটি টাকা।
স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের এমডি ও সিইও হাবিবুর রহমান বলেন, ২০২৪ সালের শেষে খেলাপি ঋণ প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা ছিল। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে তারা ৯০০ কোটি টাকা কমাতে পেরেছেন।
বোর্ডের বিবাদে নজর রাখছে বাংলাদেশ ব্যাংক
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলেন, তারা পুরো বিষয়টি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন।
আগের একটি পরিদর্শনে সাবেক চেয়ারম্যান কাজী আকরাম উদ্দিন আহমেদ ও তার ছেলে সাবেক পরিচালক কাজী খুররম আহমেদের বিভিন্ন অনিয়ম খুঁজে পায় বাংলাদেশ ব্যাংক। এসব অনিয়ম ব্যাংকের আর্থিক অবনতিতে ভূমিকা রেখেছে বলে জানায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর তারা দুজনই বোর্ডের গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে সরে যান।
এখনকার বিবদমান দুই পক্ষের পাঠানো অভিযোগপত্র সম্পর্কে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরেফিন হোসেন খান জানান, এমডির বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। তবে এখনো কোনো অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি।
তিনি আরও বলেন, পরিচালকদের অন্তর্কলহ ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা আরও খারাপ করতে পারে।
বিবদমান পক্ষগুলো যা বলছে
দ্য ডেইলি স্টারের পক্ষ থেকে ফোন ও হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করা হলেও ভাইস চেয়ারম্যান একেএম আবদুল আলিমের কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
একটি চিঠিতে স্বাক্ষরকারী ব্যাংকের পরিচালক কামাল মোস্তফা চৌধুরী বলেন, এমডির বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি অভিযোগ আছে। সে কারণেই তারা তার বাধ্যতামূলক ছুটির দাবি করেছেন। তিনি আরও বলেন, দুদকে এমডির বিরুদ্ধে একটি দুর্নীতির মামলাও আছে বলে তারা জানেন।
কামাল মোস্তফা চৌধুরীর অভিযোগ, এমডি প্রায় ১০০ কর্মচারীকে চাকরি থেকে বাদ দিয়েছেন। এমনকি তিনি নাকি বোর্ড মিটিংয়ে পুলিশ নিয়ে আসেন।
এমডি হাবিবুর রহমান বলেন, ইউনিয়ন ব্যাংকে তিনি কোনো ঋণ অনিয়মে জড়িত ছিলেন না। তিনি দাবি করেন, আলিমপক্ষ তাকে সরাতে চায়। কারণ তিনি তাদের "অনৈতিক কর্মকাণ্ডে" সহযোগিতা করেননি।
চেয়ারম্যান আজিজ বলেন, এমডি হাবিবুর রহমান কোনো ভুল করেননি। বাংলাদেশ ব্যাংকও তাকে রাখার নির্দেশ দিয়েছে। যদি এমডি খারাপ মানুষ হতেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাকে থাকতে দিত না।
চেয়ারম্যান আরও অভিযোগ করেন, বিরোধী পক্ষ লন্ডন ও যুক্তরাষ্ট্রের এক্সচেঞ্জ হাউজে নিজেদের লোক বসাতে চেয়েছিল। কিন্তু এতে ৫০ থেকে ৬০ লাখ টাকা ক্ষতি হতো বলে ব্যাংক রাজি হয়নি।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক অর্থনীতিবিদ মঈনুল ইসলাম বলেন, অনেক বেসরকারি ব্যাংকের বোর্ডেই এমন বিরোধ দেখা যায়। আর এতে এসব প্রতিষ্ঠান দ্রুত খারাপ অবস্থায় চলে যায়।
তিনি বলেন, অনেক ব্যাংক রাজনৈতিক সম্পর্কের কারণে অনুমোদন পেয়েছে। পরিচালকরা নিজের লোকজন আনতে চান, এতে বিরোধ বাড়ে। তার মতে, অনেক পরিচালক ব্যাংকের নয়, নিজেদের স্বার্থ আগে দেখেন। তাই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত দ্রুত হস্তক্ষেপ করা।


Comments