আইসিডির পর এবার চট্টগ্রাম বন্দরে সার্ভিস চার্জ বাড়ল ৪১ শতাংশ

প্রায় চার দশক পর প্রথম বড় ধরনের শুল্ক সংশোধন করেছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (সিপিএ)। এতে করে বন্দর পরিষেবা চার্জ ৪১ শতাংশ বেড়েছে।
এই শুল্ক বৃদ্ধি রোববার রাতে প্রকাশিত এক গেজেটের মাধ্যমে জানানো হয়, যা কার্যকর হয়েছে গতকাল থেকে।
ব্যবসায়ী নেতাদের আশঙ্কা, এ সিদ্ধান্ত বৈদেশিক বাণিজ্যের খরচ বাড়িয়ে দেবে ও প্রতিযোগিতা সক্ষমতা হ্রাস করবে। বিশেষ করে এমন এক সময়ে যখন আগামী বছরের নভেম্বরে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উত্তরণের প্রস্তুতি নিচ্ছে এবং সে সময়ে বিভিন্ন দেশে অগ্রাধিকারমূলক বাজার সুবিধা হারাবে।
এই বৃদ্ধি বেসরকারি ইনল্যান্ড কন্টেইনার ডিপোগুলোর (আইসিডি) শুল্ক বৃদ্ধির পরপরই হয়েছে। চলতি মাস থেকে, আইসিডিগুলো রপ্তানি পণ্য এবং খালি কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ের জন্য ৬০ শতাংশ পর্যন্ত বেশি চার্জ নেওয়া শুরু করে।
বাংলাদেশের জলসীমায় একটি জাহাজ প্রবেশ করার মুহূর্ত থেকে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন সেবার জন্য নির্ধারিত মাশুল আদায় করে।
কর্তৃপক্ষের দাবি, বিশ্বের আর কোনো বন্দরে এত কম খরচে জাহাজ পরিবহন সেবা দেওয়া হয় না। আগের শুল্ক কাঠামো বর্তমান ব্যয় বা চাহিদার সঙ্গে আর সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
তারা বলছেন, স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনার পর কর্তৃপক্ষ আরও বাস্তবসম্মত হার নির্ধারণ করেছে।
তবে ব্যবসায়ীরা এর সমালোচনা করে বলেছেন একসঙ্গে শুল্ক বাড়ানোর পরিবর্তে ধাপে ধাপে কার্যকর করা হলে চাপ কম হতো। পাশাপাশি, বন্দরের দক্ষতা, হ্যান্ডলিং সময় এবং জট কমানোর উন্নতি না করেই এই শুল্ক বৃদ্ধির যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তারা।
চট্টগ্রাম বন্দরে একটি জাহাজকে জেটিতে আনা, টাগবোট ব্যবহার, পানি সরবরাহ, ক্রেন দিয়ে কন্টেইনার ওঠানো-নামানো এবং পণ্য ডেলিভারি দেওয়ার মতো অনেক কাজ হয়।
সিপিএ এই প্রতিটি কাজের জন্য ফি নেয় এবং এই সব ফি মিলেই বন্দরের মোট শুল্ক নির্ধারিত হয়।
১৯৮৬ সালের পর থেকে এবারই প্রথম সিপিএ বড় আকারে তাদের চার্জ বাড়াল। এর আগে ২০০৭-০৮ সালে তারা কিছু নির্দিষ্ট সেবার (যেমন: টাগবোট, পানি সরবরাহ, জেটির ভাড়া) ফি বাড়িয়েছিল।
নতুন হার
গেজেট অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি বেড়েছে কনটেইনার পরিবহন খরচ। একটি ২০-ফুট কন্টেইনারের গড় খরচ ১১ হাজার ৮৪৯ টাকা থেকে বেড়ে ১৬ হাজার ২৪৩ টাকা হয়েছে। অর্থাৎ, প্রতি কন্টেইনারে ৪ হাজার ৩৯৫ টাকা বেশি দিতে হবে।
আমদানি কনটেইনারে খরচ বেড়েছে ৫ হাজার ৭২০ টাকা এবং রপ্তানি কনটেইনারে ৩ হাজার ৪৫ টাকা।
এককভাবে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে জাহাজ থেকে কনটেইনার লোড ও আনলোডের ক্ষেত্রে। ৪৩ দশমিক ৪০ ডলার (প্রায় ৫,২৮২ টাকা) থেকে বেড়ে ৬৮ ডলারে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ প্রায় ৩ হাজার টাকা বেড়েছে।
শুল্ক মার্কিন ডলারে নির্ধারিত হওয়ায় ডলারের মান বাড়লে খরচ আরও বাড়তে পারে।
কনটেইনারভিত্তিক পণ্য পরিবহনে প্রতি কেজির খরচ ১ দশমিক ২৮ টাকা থেকে বেড়ে ১ দশমিক ৭৫ টাকা হয়েছে, যা প্রায় ৩৭ শতাংশ বৃদ্ধি।
চট্টগ্রাম বন্দরের প্রায় ৬০ শতাংশ আমদানি পণ্যই বহির্নোঙরে হ্যান্ডেল করা হয়। এক্ষেত্রে খরচ তুলনামূলকভাবে কম বাড়বে, কারণ সেগুলো বন্দরের জেটিতে ওঠানো-নামানো হয় না।
ব্যবসায়ীদের উদ্বেগ
বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম পারভেজ বলেন, চার্জ বৃদ্ধি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের উপর অতিরিক্ত বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে।
তিনি বলেন, নতুন এই শুল্ক কাঠামো ব্যবসা পরিচালনার খরচ বাড়াবে এবং দেশীয় উৎপাদকের উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি করবে।
একইসঙ্গে রপ্তানিকারকরা বৈশ্বিক বাজারে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বীদের তুলনায় প্রতিযোগিতা সক্ষমতা হারাবেন, দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন তিনি।
তিনি বলেন, এলডিসি থেকে উত্তরণের প্রাক্কালে এ ধরনের সিদ্ধান্ত ব্যবসায়ীদের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করছে।
'অদক্ষ বন্দর ব্যবস্থাপনার কারণে পণ্য ছাড়তে দেরি হচ্ছে, তার ওপর হঠাৎ এ শুল্ক বৃদ্ধি অযৌক্তিক।'
বিজিএমইএর সাবেক প্রথম সহ-সভাপতি নাসির উদ্দিন চৌধুরী জানান, তারা সরকারকে এক বছরের জন্য শুল্ক বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত স্থগিত করার অনুরোধ করেছিলেন, তবে তা গৃহীত হয়নি।
তিনি অভিযোগ করেন, সরকার মূলত বেশির ভাগ জেটি বিদেশি অপারেটরের হাতে তুলে দেওয়ার চেষ্টা করছে।
'এই শুল্ক বৃদ্ধি বিদেশি অপারেটরদের লাভবান করতেই করা হয়েছে,' বলেন তিনি।
সিপিএ সচিব ওমর ফারুক জানান, ব্যবসায়ীদের অনুরোধ সত্ত্বেও বাড়তি শুল্ক স্থগিত করা সম্ভব হয়নি। তবে তিনি বলেন, প্রতিবেশী দেশের তুলনায় চট্টগ্রাম বন্দরের শুল্ক এখনও অনেক কম। সরকার সম্ভবত এই বিষয়টিকে বিবেচনায় নিয়েছে।
গত ২৪ জুলাই অর্থ মন্ত্রণালয় শুল্ক বৃদ্ধির অনুমোদন দেয়। এ নিয়ে আপত্তি ওঠায় ২৫ আগস্ট নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে বৈঠক হয়। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন জাহাজ চলাচল উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন। সেখানে ব্যবসায়ীরা আবারও এটি ধাপে ধাপে বাড়ানোর প্রস্তাব দেন।
বৈঠকে সিপিএ-এর ডেপুটি চিফ ফাইন্যান্স অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস অফিসার কাজী মেরাজ উদ্দিন আরিফ এই শুল্ক বৃদ্ধির পক্ষে যুক্তি দিয়ে বলেন, এই বৃদ্ধির পরেও অন্যান্য প্রধান বৈশ্বিক বন্দরের তুলনায় শুল্ক এখনও কম।
বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান এই বৃদ্ধিকে অগ্রহণযোগ্য বলে মন্তব্য করেছেন।
বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ এম আরিফও এর বিরোধিতা করে বলেন, বন্দরের পাশাপাশি বার্থ অপারেটর ও বেসরকারি অফ-ডকের বাড়তি শুল্ক সামগ্রিক বাণিজ্য ব্যয় বাড়িয়ে দেবে।
তিনি সতর্ক করে বলেন যে বিদেশি শিপিং লাইনগুলোর কাছেও মালবাহী চার্জ বৃদ্ধি করা ছাড়া আর কোন বিকল্প থাকবে না, যা দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
Comments