কর ফাঁকির দেশে ব্যতিক্রম কাউছ মিয়া

কাউছ মিয়া, হাকিমপুরী জর্দা, শীর্ষ করদাতা,

রাজধানীর গুলশান, বনানী ও মতিঝিল এলাকার মতো অভিজাত অফিস ছিল না কাউছ মিয়ার। পুরান ঢাকার আগা নবাব দেউড়ি রোডের হাকিমপুরী জর্দা কারখানার একটি কক্ষ ছিল তার প্রিয় চেম্বার। সেই কক্ষ থেকেই নিজের ব্যবসা পরিচালনা করতেন তিনি। সেখান থেকেই হয়ে ওঠেন বাংলাদেশের শীর্ষ করদাতা।

কাউছ মিয়া ১৯৩১ সালের ২৬ আগস্ট চাঁদপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তবে তার পূর্বপুরুষরা অবিভক্ত ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের বাসিন্দা ছিলেন। দেশের শীর্ষ এই করদাতা ১৯৪৫ সালে অষ্টম শ্রেণি পাস করার পর আর পড়াশোনা করেননি।

বাবা চাননি ছেলে ব্যবসায়ী হোক। তবে ব্যবসা যার মগজে গেঁথে আছে, তাকে কী আর আটকে রাখা যায়! কাউছ মিয়াকেও আটকে রাখা যায়নি। মায়ের কাছ থেকে আড়াই হাজার টাকা নিয়ে চাঁদপুরের পুরাতন বাজারে মুদিখানার ব্যবসা শুরু করেন। তাও ১৯৫০ সালের কথা, তখন তার বয়স মাত্র ১৯ বছর।

অচিরেই কাউছ মিয়া ১৮টি ব্র্যান্ডের সিগারেট, বিস্কুট ও সাবানের এজেন্ট হন। তার পরের ২০ বছর তিনি চাঁদপুর থেকে ব্যবসা করেন। ১৯৭০ সালে নারায়ণগঞ্জে চলে আসেন এই ব্যবসায়ী, শুরু করেন তামাকের ব্যবসা। তামাক ব্যবসা থেকেই জর্দা (সুগন্ধি তামাক) উৎপাদনের চিন্তা তার মাথায় আসে।

কাউছ মিয়া ১৯৭৬ সালে শান্তিপুরী জর্দার ব্যবসা শুরু করেন, কিন্তু তা নকল হচ্ছিল। তাই ১৯৯৬ সালে তিনি হাকীমপুরী জর্দা নামে নতুন ব্যবসা শুরু করেন। পরে এই হাকীমপুরী জর্দা ঘরে ঘরে একটি পরিচিত নাম হয়ে ওঠে।

গতকাল ৯৪ বছর বয়সে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কাউছ কেমিকেল ওয়ার্কসের স্বত্বাধিকারী ৪০ থেকে ৪৫ ধরনের ব্যবসা পরিচালনা করেছেন। ২০১৬ সালে এক সাক্ষাৎকারে এই উদ্যোক্তা বলেছিলেন, ১০ হাজার কোটি টাকার সম্পদের মালিক তিনি।

হাকিমপুরী জর্দা ছাড়াও নিয়মিত কর প্রদান ও শীর্ষ করদাতা হিসেবে আলোচিত ছিলেন এই ব্যবসায়ী। শীর্ষ করদাতার খেতাব তাকে জাতীয়ভাবে খ্যাতি এনে দিয়েছিল।

সফল এই ব্যবসায়ী ২০১০-২০১১ অর্থবছর থেকে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ করদাতাদের একজন। অথচ তিনি এমন একটি দেশে ব্যবসা করেছেন যেখানে অনেকেই কর ফাঁকি দিতেই বেশি আগ্রহী। শুধু তাই নয় বেশিরভাগ ব্যবসায়ী কর দেন না।

ফলে বাংলাদেশের কর-জিডিপির অনুপাত বিশ্বের সর্বনিম্ন দেশগুলোর একটি। এজন্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বলেছে, বাংলাদেশের আরও কর আদায়ের সুযোগ রয়েছে।

বেঁচে থাকতে কাউছ মিয়া বারবার বলেছেন, দেশপ্রেম এবং দায়িত্ববোধ থেকেই তিনি নিয়মিত কর পরিশোধ করেছেন।

একবার তিনি বলেছিলেন, '১৯৫৮ সাল থেকে আমি নিয়মিত কর দিয়ে আসছি। কর পরিশোধ করা একটি দায়িত্ব, আইনি বাধ্যবাধকতা নয়।'

যখন তার কাছে মানুষ জানতে চেয়েছিল, তিনি কর দেওয়ার বিষয়ে এত আগ্রহী কেন? উত্তরে তিনি বলেছিলেন, 'আমি মুনাফা করি বলে কর দিই।'

এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, 'কর পরিশোধ করা একটি ভালো কাজ। আমরা কর না দিলে দেশ চলবে কীভাবে? কর দিলে টাকা সাদা হয়ে যায়। আর বৈধ অর্থে যা চাই তা করতে পারি।'

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) শীর্ষ করদাতাদের সম্মাননা প্রদান ও কর দিতে উৎসাহিত করতে ট্যাক্স কার্ড চালুর পর কাউছ মিয়া কর পরিপালনের প্রতীক হয়ে ওঠেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত মুজিববর্ষে তিনি সেরা করদাতা নির্বাচিত হন।

সফল ব্যবসায়ীর কর উপদেষ্টা শাকিল আহমেদ তার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, ২০২১ সালে কাউছ মিয়ার মোট কর এক বছরে ৯৯ লাখ টাকায় এসেছিল। পরে তিনি এটিকে এক কোটি টাকা করার পরামর্শ দিয়েছিলেন, যেন সহজে বোঝা যায়।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাকিল আহমেদ বলেন, 'প্রয়োজনে তিনি বেশি টাকা দিতেও রাজি ছিলেন।'

শাকিল আহমেদ গত ৪০ বছর ধরে কাউছ মিয়া এবং তার ব্যবসায়ের করের বিষয়গুলো দেখাশোনা করছেন।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, 'কাউস মিয়া একজন ব্যতিক্রমী ব্যবসায়ী ছিলেন। কারণ দেশের বেশিরভাগ ব্যবসায়ীর কর পরিশোধে অনীহা আছে। অনেকের করযোগ্য আয় থাকার পরও কর দেন না।'

'তিনি আমাদের দেশে একটি ভালো দৃষ্টান্ত প্রতিষ্ঠিত করেছেন। কাউছ মিয়ে অনেকের জন্য রোল মডেল হয়ে উঠেছেন। বহু মানুষ তার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছেন।'

এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আবদুল মজিদ বলেন, 'কর ফাঁকি দেওয়ার জন্য অনেকে নানান কৌশল অবলম্বন করেন, অথচ কাউছ মিয়া ছিলেন তার বিপরীত।'

এনবিআরের আয়কর বিভাগের সাবেক সদস্য অপূর্ব কান্তি দাস বলেন, স্বেচ্ছায় কর দেন এমন লোকের সংখ্যা খুবই কম।

তিনি বলেন, 'আমি অনেক মানুষ ও ব্যবসায়ীকে দেখেছি যারা কর না দিয়ে আনন্দ পান। ফলে এনবিআরের পক্ষে সব ব্যবসায়ীকে করের আওতায় আনা এবং কর আদায় প্রত্যাশিত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি।'

কাউছ মিয়া বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় ভুগছিলেন। গতকাল তিনি রাজধানীর আজগর আলী হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার নাতি আনোয়ার সাদাত দ্য ডেইলি স্টারকে এসব তথ্য জানান।

কাউছ মিয়া স্ত্রী, আট ছেলে ও আট মেয়েসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।

Comments

The Daily Star  | English

ACC to get power to probe corruption by Bangladeshis anywhere, foreigners in Bangladesh

The Anti-Corruption Commission (ACC) is set to receive sweeping new powers under a proposed ordinance that will allow it to investigate corruption by Bangladeshi citizens, both at home and abroad, as well as by foreign nationals residing in the country. .The draft Anti-Corruption Commissio

43m ago