শাহজালালে আগুন: পোশাক ও ওষুধ শিল্পের উৎপাদন পেছাতে পারে ২ মাস

ছবি: সংগৃহীত

ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো কমপ্লেক্সে গত শনিবারের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে সবচেয়ে বড় ক্ষতির মুখে পড়েছে পোশাক ও ওষুধ শিল্প। এসব শিল্পের আমদানি করা কাঁচামাল ও উৎপাদন উপকরণ পুড়ে যাওয়ায় স্থানীয় শিল্পকারখানাগুলোতে উৎপাদন কমপক্ষে দুই মাস পিছিয়ে যেতে পারে। শুধু তাই নয়, উৎপাদনকারীরা আরও আশঙ্কা করছেন ক্ষতির পরিমাণ ধ্বংস হওয়া কাঁচামালের মূল্যের চেয়েও অনেক বেশি হবে।

পশ্চিমা দেশগুলোর সবচেয়ে বড় উৎসব ক্রিসমাস আসন্ন। বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানিকারকদের জন্য সবচেয়ে ব্যস্ত মৌসুমগুলোর একটি এটি। কিন্তু বিমানবন্দরে এই অগ্নিকাণ্ডে কাঁচামাল ও মধ্যবর্তী উপকরণ পুড়ে যাওয়ায় এই মৌসুমের অর্ডারগুলো সময়মতো পাঠাতে না পারার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।

অনেক প্রতিষ্ঠানকে এখন দ্রুত পণ্য পাঠানোর জন্য ব্যয়বহুল বিমানপথে চালান পাঠাতে হতে পারে। কেউ কেউ হয়তো দেরি পুষিয়ে নিতে ক্রেতাদের ছাড়ও দেবে। ফলে তাদের মুনাফা কমে যাবে। সবমিলিয়ে ক্ষতির পরিমাণটা অনেক হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

একইভাবে, ওষুধ শিল্পের কাঁচামাল পুড়ে যাওয়ায় সেগুলো আবার আমদানি করতে হবে। এতে নতুন করে ব্যাংক ঋণ ও সরকারের অনুমোদনের প্রক্রিয়া পেরোতে সময় লাগবে। ফলে উৎপাদন বিলম্বিত হবে এবং সুদের কারণে খরচ আরও বাড়বে।

বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সিনিয়র সহসভাপতি ইনামুল হক খান বলেন, 'কাঁচামাল ও মধ্যবর্তী উপকরণ হারানোর কারণে ক্ষতিগ্রস্ত কারখানাগুলোর উৎপাদন অন্তত দুই মাস পিছিয়ে যাবে।'

স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন চৌধুরী বলেন, 'বিমানবন্দরের আগুনে অন্তত ৮ কোটি টাকার কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি পুড়ে গেছে। একই কাঁচামাল আবার আমদানি করে ওষুধ উৎপাদনে যেতে আরও সাত থেকে আট মাস সময় লাগবে।'

বিমানবন্দরের কার্গো কমপ্লেক্সে শীততাপ-নিয়ন্ত্রিত গুদাম রয়েছে, যেখানে ওষুধ শিল্প সংবেদনশীল উপকরণ সংরক্ষিত থাকে।

ল্যাবএইড ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের নির্বাহী পরিচালক (মার্কেটিং ও কমার্শিয়াল) এসএম নূর হোসেন জানান, তাদের ১ কোটি ৫০ লাখ টাকার অ্যাকটিভ ফার্মাসিউটিক্যাল ইনগ্রেডিয়েন্ট (এপিআই) ভারত থেকে আমদানি করা হয়েছিল এবং তা এক সপ্তাহ ধরে কার্গো কমপ্লেক্সে আটকে ছিল। সেগুলোই আগুনে পুড়ে গেছে।

তিনি বলেন, 'এখন একই উপকরণ আবার আমদানি করতে হবে। ব্যাংক থেকে উচ্চ সুদে ঋণ নিতে হবে, তাই আর্থিক ক্ষতি অনেক। এই উপকরণ দিয়ে ওষুধ তৈরি হলে তার বাজারমূল্য প্রায় ১০ কোটি টাকা হতো।'

ফ্যাব্রিকা নিট কম্পোজিট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিজানুর রহমান জানান, বিমানবন্দরের আগুনে তার কোম্পানির ২ লাখ ৫০ হাজার ডলার (প্রায় ৩ কোটি টাকা) মূল্যের অ্যাক্সেসরিজ ও ট্রিমস পুড়ে গেছে। তিনি বলেন, 'এই পণ্যগুলো আবার উৎপাদন ও আমদানি করতে অন্তত চার সপ্তাহ লাগবে। হয়তো বিমানপথে দ্রুত আনতে হবে অথবা কিছু অর্ডার বাতিল হয়ে যেতে পারে।'
সুরমা গার্মেন্টস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফয়সাল সামাদ জানান, তার কোম্পানির ৬০ হাজার ডলার (প্রায় ৭৩ লাখ টাকা) মূল্যের গার্মেন্ট অ্যাক্সেসরিজও আগুনে পুড়ে গেছে।

বিজিএমইএ পরিচালক সামাদ জানান, তিনি বিমানবন্দরে শুল্ক কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। বৈঠকে বিজিএমইএ সদস্যদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বর্তমানে সীমিত জায়গার কারণে তারা যেন আমদানি করা পণ্য ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সংগ্রহ করে নেন।

আগুনে পুড়ে যাওয়া আমদানি করা পণ্যের মধ্যে ৫৯ শতাংশ এসেছে চীন থেকে, ৯ দশমিক ৪ শতাংশ হংকং থেকে, ৫ দশমিক ৪ শতাংশ ভারত থেকে, ২ শতাংশ দক্ষিণ কোরিয়া থেকে এবং বাকি অংশ অন্যান্য দেশ থেকে।

বিজিএমইএ'র সিনিয়র সহসভাপতি ইনামুল হক খান জানান, এখন পর্যন্ত ৯০১টি পোশাক কারখানা তাদের ক্ষতির তথ্য ট্রেড বডির পোর্টালে জমা দিয়েছে। প্রাথমিকভাবে ক্ষতির পরিমাণ ধরা হচ্ছে প্রায় ১০ মিলিয়ন ডলার বা ১২২ কোটি টাকা। তিনি বলেন, 'ক্ষতিগ্রস্ত কারখানার সংখ্যা ও মোট ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়বে, কারণ অনেক প্রতিষ্ঠান এখনো তথ্য জমা দিচ্ছে।'

ইনামুল হক খান নিজেও ৩৬ হাজার ডলার (প্রায় ৪৪ লাখ টাকা) মূল্যের পণ্য হারিয়েছেন। তিনি বলেন, 'ধ্বংস হওয়া কাঁচামালের আর্থিক মূল্য তুলনামূলকভাবে কম হলেও এর প্রভাব অনেক বড়। আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড ও ক্রেতারা এখন সময়মতো পণ্য সরবরাহ নিয়ে উদ্বিগ্ন।'

তবে তিনি জানান, সরকারি হস্তক্ষেপে বিমানবন্দরে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম ইতোমধ্যে আবার চালু হয়েছে।

বাংলাদেশ ঔষুধ শিল্প সমিতির (বিএপিআই) মহাসচিব মো. জাকির হোসেন জানান, ৩২টি ওষুধ কোম্পানি প্রায় ২০০ কোটি টাকার ক্ষতির তথ্য দিয়েছে। এই পরিমাণ আরও বাড়বে।

ঢাকায় গতকাল সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইএবি) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, 'ক্ষতির পরিমাণ ১ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে।'

রপ্তানিকারকরা ওই অনুষ্ঠানে ঢাকার বিমানবন্দরে আরও কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থার দাবি জানিয়েছেন। তারা বলেন, দুর্বল নিরাপত্তার কারণেই এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। 

বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল বলেন, 'আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলো উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। আমাদের টেক্সটাইল ও গার্মেন্টস খাতকে লক্ষ্যবস্তু বানানো হচ্ছে। বিমানবন্দরে আগুনের ঘটনা বাংলাদেশের সুনাম ক্ষুণ্ন করেছে এবং আন্তর্জাতিক অংশীদারদের কাছে আমাদের অঙ্গীকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।'

বাংলাদেশ গার্মেন্ট অ্যাক্সেসরিজ অ্যান্ড প্যাকেজিং ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএপিএমইএ) সভাপতি মো. শাহরিয়ার বলেন, অ্যাক্সেসরিজ খাতে ক্ষতির পরিমাণ ইতিমধ্যে ২৩ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। তিনি সময়মতো বীমা ক্ষতিপূরণ প্রদানের আহ্বান জানিয়েছেন।

Comments