বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যেসব পরিবর্তন এনেছিলেন খালেদা জিয়া

১৯৯১ সালের মার্চে খালেদা জিয়া প্রথমবার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হন। ওই সময় তার হাত ধরে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে দীর্ঘস্থায়ী কোনো পরিবর্তন হবে—এমন প্রত্যাশা কেউ করেননি, করার বিশেষ কোনো কারণও ছিল না।

স্বামী জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডের পর একেবারে ভিন্ন পরিস্থিতিতে ব্যক্তি জীবন থেকে রাজনীতিতে পদার্পণ হয় খালেদা জিয়ার। তিনি একটি বিভক্ত দলের হাল ধরেন। অর্থনীতিতে তার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা ছিল না। সামষ্টিক অর্থনীতির জটিল ভাষাও তিনি জানতেন না, ব্যবহারও করতেন না।

তবু তিন দশকেরও বেশি সময় পর ও সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর মৃত্যুর পর অর্থনীতিবিদরা বলছেন—দেশের অর্থনীতিকে যে রূপান্তর ঘটেছে, তার অনেকগুলোরই সূচনা হয়েছিল খালেদা জিয়ার শাসনামলেই।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেনের মতে, খালেদা জিয়ার শক্তি কারিগরি দক্ষতায় নয়, বরং সঠিক মানুষকে সঠিক জায়গায় বসানোর বিচক্ষণতায় ছিল।

নব্বইয়ের দশকের শুরুতে বাংলাদেশ দীর্ঘদিনের রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছিল। আমদানি ছিল কোটা নিয়ন্ত্রিত, ব্যাংকিং ও শিল্পখাতের বড় অংশ ছিল রাষ্ট্রের দখলে। প্রবৃদ্ধি ছিল ধীর, বিনিয়োগকারীদের আস্থা ছিল নড়বড়ে।

ক্ষমতার শুরুতে খালেদা জিয়া অর্থনীতিকে কিছুটা 'শ্বাস নেওয়ার সুযোগ' দেন। যারা জানতেন কী করা দরকার, তাদের কথা তিনি শুনেছেন এবং দৃঢ় রাজনৈতিক সমর্থন দিয়েছেন।

উদাহরণ হিসেবে জাহিদ হোসেন বলেন, ১৯৯১ সালে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) চালু করা হয়। এটা করতে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান যে রাজনৈতিক সমর্থন পেয়েছিলেন, তা খালেদা জিয়ার কাছ থেকেই এসেছিল। তার সমর্থন ছাড়া সে সময় এমন বড় সংস্কার বাস্তবায়ন করা প্রায় অসম্ভব হতো।

সময়ের পরিক্রমায় আজ ভ্যাট বা কর দেশের রাজস্ব ব্যবস্থার মেরুদণ্ডে পরিণত হয়েছে।

খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে আমদানি কোটা ব্যবস্থা বাতিল করা হয়। এর ফলে সরবরাহ ও চাহিদাই বাণিজ্য প্রবাহ নির্ধারণ করতে শুরু করে। শুল্কহার বেছে বেছে নয়, বরং সার্বিকভাবে কমানো হয়।

এর আগে যে নিয়ন্ত্রক কাঠামো ছিল না, তার আওতায় বেসরকারি ব্যাংক খোলার ও ব্যবসা করার অনুমতি দেওয়া হয়। বিনিয়োগ বোর্ড ও বেসরকারিকরণ কমিশনের মতো প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়, যেন আমলাতান্ত্রিক জট কমানো যায়।

সবচেয়ে সুদূরপ্রসারী সিদ্ধান্ত আসে ২০০১ থেকে ২০০৬ মেয়াদে—২০০৩ সালে বিনিময় হার উদারীকরণ করা হয়। জাহিদ হোসেন বলেন, 'এটা ছিল এক যুগান্তকারী সংস্কার।'

এই সিদ্ধান্তের ফলে বৈশ্বিক বাজারের সঙ্গে দেশের সংযোগ বাড়ে এবং বাণিজ্য প্রতিযোগিতা ও সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা দৃঢ় ভিত্তি পায়—এমনটাই মূল্যায়ন অর্থনীতিবিদদের।

খালেদা জিয়া দক্ষ মানুষ বেছে নিয়েছেন, তাদের কাজ করার স্বাধীনতা দিয়েছেন এবং অজনপ্রিয় সংস্কারগুলো করলেও তাদের রাজনৈতিকভাবে আড়ালও করেছেন। ভ্যাট বাস্তবায়নের মতো সিদ্ধান্ত তার সমর্থন ছাড়া কার্যকর করা কঠিন হতো বলে মন্তব্য করেন সাবেক এই অর্থনীতিবিদ।

এর ফল এসেছে ধীরে, কিন্তু হয়েছে দীর্ঘস্থায়ী। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, আশির দশকের শেষ দিকে যেখানে গড় প্রবৃদ্ধি চার শতাংশের নিচে ছিল, পরের দশকে তা পাঁচ শতাংশের ওপরে ওঠে।

দারিদ্র্যও কমতে শুরু করে—নব্বইয়ের দশকের শুরুতে প্রায় ৫৭ শতাংশ থেকে তার প্রথম মেয়াদের শেষে তা নেমে আসে প্রায় ৫০ শতাংশে। ২০০১ থেকে ২০০৬ মেয়াদে প্রবৃদ্ধি আরও গতি পায়, যদিও একই সঙ্গে আয় বৈষম্যও বাড়ে।

খালেদা জিয়ার প্রভাব শুধু সামষ্টিক অর্থনীতিতেই নয়, সামাজিক পরিবর্তনেও গুরুত্বপূর্ণ।

খালেদা জিয়া তার শাসনামলের প্রথম মেয়াদেই প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করেন।

খাদ্যের বিনিময়ে শিক্ষা ও মেয়েদের জন্য উপবৃত্তির মতো কর্মসূচি স্কুলে ভর্তি বাড়ায় এবং ভবিষ্যৎ শ্রমশক্তির রূপও পাল্টে দেয়।

কৃষিখাতে তার সরকার এনজিওগুলোর সঙ্গে অংশীদারত্বে কৃষকদের নানা সেবা পৌঁছে দেয়। নতুন বীজ, সার ও সেচ পদ্ধতি গ্রামপর্যায়ে ছড়িয়ে পড়ে।

আগে কার্যকর ছিল—এমন ব্যবস্থাও তিনি বজায় রেখেছেন। বন্ডেড ওয়্যারহাউস ও ব্যাক-টু-ব্যাক এলসি সুবিধা বহাল থাকায় পোশাক খাত বৈশ্বিক ক্রেতাদের সঙ্গে সম্পর্ক আরও গভীর করতে পেরেছে।

মধ্যপ্রাচ্যে রেমিট্যান্স পাঠানোর চ্যানেলও সম্প্রসারিত হয়, বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বাড়ে এবং রিজার্ভ শক্তিশালী হয়।

কিছু কঠিন সিদ্ধান্তও নিতে হয়েছে খালেদা জিয়াকে। লোকসানে থাকা রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান, যেমন আদমজী জুট মিলকে প্রবল বিরোধিতার মধ্যেই বেসরকারিকরণ করা হয়।

টেলিযোগাযোগ খাতে আসে মোবাইল ফোন। এটি ব্যবসা ও ঘরোয়া যোগাযোগে আনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন।

বাংলাদেশ ব্যাংককে বেশি কার্যকর স্বাধীনতা দেওয়া হয়, যেন দৈনন্দিন রাজনীতি থেকে অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তগুলো কিছুটা আলাদা থাকে।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশিষ্ট ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, খালেদা জিয়া যখন প্রথম ক্ষমতায় আসেন, তখন এক দশকের স্বৈরশাসনের পর সম্পদ ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা ছিল অল্প কয়েকজনের হাতে কেন্দ্রীভূত।

তিনি বলেন, খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে। খালেদা জিয়ার অনেক সিদ্ধান্ত ছিল অজনপ্রিয়, কিন্তু প্রয়োজনীয়।

বাংলাদেশ ইকোনমিক অ্যাসোসিয়েশন তাকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক রূপান্তরের অন্যতম স্থপতি হিসেবে উল্লেখ করেছে।

সংস্থাটির মতে, বেসরকারিকরণ, শ্রমবাজারকে গতিশীল করা, জাতীয় রাজস্ব আহরণের জন্য ভ্যাট প্রবর্তন এবং নিয়ন্ত্রণমুক্তকরণের মতো উদ্যোগের মাধ্যমে তার শাসনামলেই অর্থনীতির ভিত্তি গড়ে ওঠে।

বাংলাদেশ ইকোনমিক অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যসচিব ও মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির নির্বাহী ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন তার সংস্কার উদ্যোগ ও নারী ক্ষমতায়নের কথা স্মরণ করেন।

তিনি বলেন, এরশাদ সরকারের সময়ও কিছু সংস্কার হয়েছিল, তবে সেগুলো ছিল আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা বিশ্বব্যাংকের চাপের মুখে। কিন্তু খালেদা জিয়ার সরকার সংস্কারের ব্যাপারে প্রকৃত রাজনৈতিক অঙ্গীকার দেখিয়েছে। তিনি যখন কোনো সিদ্ধান্ত নিতেন, তা বাস্তবায়নে সর্বোচ্চ চেষ্টা করতেন।

Comments

The Daily Star  | English

Khaleda Zia laid to eternal rest

Buried with state honours beside her husband Ziaur Rahman

12h ago