২৫ বছরে ‘প্রেম তুমি কি?’
২০০০ সালে ঈদ হয়েছিল তিনটি। ঈদুল ফিতর এসেছিল দুবার। এর ভেতর দ্বিতীয় ফিতরের ঈদটি হয়েছিল ২০০০ সালের ২৮ ডিসেম্বর। সে সময় বাংলাদেশে ব্যান্ড মিউজিকের জোয়ার চলছে। চাঁদরাতে অ্যালবাম কিনতে দোকানগুলোতে হতো উপচে পড়া ভিড়। আর সেই ঈদে ক্যাসেটের দোকানে দোকানে মূলত সাড়া ফেলে দিলো একটি অ্যালবাম—'প্রেম তুমি কি?'
এটি আইয়ুব বাচ্চুর সলো অ্যালবাম। এর আগের সলো অ্যালবাম 'সময়' (১৯৯৭) কিংবা 'একা' (১৯৯৯) খুব ভালো মানের কাজ হলেও খুব বেশি বাণিজ্যিক সাফল্য পায়নি। এই অ্যালবামে আইয়ুব বাচ্চু ব্যতিক্রমী একটি সিদ্ধান্ত নেন। সব গান তিনি নিজেই লেখেন। আর সুর-সংগীত তো তিনি নিজেই করতেন বরাবরই।
অ্যালবামটি প্রকাশের পরপরই তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়ে যায়। বিশেষ করে 'উড়াল দেবো আকাশে' গানটি। পপ-রক ঘরানার এই গানে বাচ্চু লেখেন, 'জমিদার শুধু জানে, সব ব্যাটা তারে মানে/ পৃথিবীটা তার দখলে, সবকিছু তার কবলে/ এক নিঃশ্বাসের বিশ্বাস নাই, জমিদার কি জানে?' অসাধারণভাবে গিটার বাজানো আর বাচ্চুর গায়কী গানটিকে তুমুল জনপ্রিয়তা দেয়। আর গানের কথাগুলোর আবেদনও চিরন্তন, যদি কেউ একটু খেয়াল করে শুনে থাকেন।
এই অ্যালবামের আরেকটি তুমুল জনপ্রিয় গান ছিল 'এক চালা টিনের ঘর'। পপ-ফোক রক ঘরানার এই কম্পোজিশনে ফোকের সঙ্গে রকের একটা ভালো মেলবন্ধন তিনি তৈরি করেছেন।
আরেকটি খুব জনপ্রিয় গান 'এই শহর এখন ঘুমিয়ে গেছে'-তে আমরা খুঁজে পাই নব্বই দশকের ভিন্টেজ আইয়ুব বাচ্চুকে। 'শুধু জেগে আছি আমি/ আর জেগে আছ তুমি/ জেগে আছে দূরের ওই রূপালী চাঁদ'—এই কথাগুলো কোনো এক শীতের রাতে নাগরিক নিঃসঙ্গতায় ভারাক্রান্ত যেকোনো মানুষের মন ছুঁয়ে যেতে পারে এখনো। বেশ মেলোডিক রক এই গানটির লিরিকেও বাচ্চুর শক্তিমত্তার প্রমাণ মেলে।
এই অ্যালবামের যেসব গান বেশি হিট, তার বাইরেও কিছু চমৎকার আন্ডাররেটেড গান রয়েছে।
যেমন: অ্যালবামের টাইটেল গান 'প্রেম তুমি কি?'। এই গানটি ক্লাসিক রক ব্যালাডের ধাঁচে নির্মিত। চমৎকার একটি মেলো রক গান এটি। 'প্রথম দেখায় তোমার দু চোখ দেখে ভুলে যাই আমি পৃথিবী/ হঠাৎ দেখি তুমি নেই, পৃথিবী তো ঠিকই আছে, আছে স্বাভাবিক'—এই কথাগুলো বাচ্চুর চমৎকার সুর ও গায়নশৈলীতে মূর্ত হয়ে ওঠে, যেন হারানো প্রেমের স্মৃতি থাকা সব মানুষের হৃদয়ের অব্যক্ত অনুভূতির কথা বলে দেয়।
আবার, 'প্রতিটি ভোর প্রতিটি ক্ষণ' গানটির কথায় যেমন আছে নিবিড় ভালোবাসার প্রকাশ, তেমনি সুরে আছে আন্তরিক মায়াময়তা। 'শুধু এইটুকু চাওয়া এই আমার জীবনে/ যতদিন বাঁচি আমি, বাঁচি যেন এইভাবে/ শিশিরে ভেজা সকাল, যেভাবে মনটা কাড়ে/ আছ তুমি আমার এই হৃদয়জুড়ে'—গানটির এই কথাগুলো তার সরল রোমান্টিক সুরের সঙ্গে মিলে শ্রোতার মন ভালো করে দেয়। প্রথম প্রেমের স্নিগ্ধ অনুভূতি কিংবা অনেকদিন একসঙ্গে কাটানো জীবনসঙ্গীর প্রতি মুগ্ধতা ও কৃতজ্ঞতা—দুটোই সমানভাবে প্রকাশিত এ গানে।
এই অ্যালবামে আবার আছে ঠিক বিপরীত অনুভূতিরও প্রকাশ। 'কিছু নেই আমার' গানটির কম্পোজিশনে মেলো রকের অনবদ্য সাক্ষর রেখেছেন বাচ্চু। এটি তার শ্রেষ্ঠ কম্পোজিশনগুলোর একটি। বাংলা মেলো-রকেরও অন্যতম শ্রেষ্ঠ গান এটি। 'বিশ্বাস ভেঙে-চুরে হয়ে গেছে একাকার/ নিঃস্ব এ আমি ছাড়া কিছু নেই আমার' কিংবা 'তোমার আর আমার পাশাপাশি থাকার দিনগুলো ফুরালো কবে/ কেউ দেখেনি তো, কেউ জানেনি তো, একা করে দিলো কে কাকে'—এই কথাগুলো যখন তিনি উচ্চারণ করেন, তখন শ্রোতার আহত হৃদয়ের ক্ষততে তা প্রলেপের মতোই কাজ করে।
আবার, 'শুধু কি আমার ভুল' গানটিও মেলো রক কম্পোজিশনের এক অনন্য উদাহরণ। 'যে পথে এসেছ, সেই পথেই ফিরেছ' লাইনটি আলাদা অনুভূতি বহন করে।
এমন চমৎকার আরেকটি মেলো রক গান 'বাবা তোমার কথা মনে পড়ে'। এই গানের কথাগুলো ব্যতিক্রমধর্মী। কারণ এই গানের বাবা সন্তানদের আদর-স্নেহ-ভালোবাসা দেওয়া বাবা নন, এই বাবা সন্তানদের ছেড়ে যাওয়া বাবা। 'তোমারও কি আমার মতো করে/ ব্যথাগুলো সব গোপনে কাঁদে' কিংবা 'কী জানি কী ভুলে তুমি ছেড়ে গেলে আমাদের/ আমার মায়ের চোখের পানি আমি দেখে দেখে বেড়ে উঠেছি'—কথাগুলো এমন পরিস্থিতিতে বড় হওয়া বহু মানুষের মনের কথা৷
বাচ্চু এই অ্যালবামের 'সুস্মিতা' গানটিতে পপ রকের সঙ্গে ব্যাকগ্রাউন্ডে ব্যবহৃত 'সুস্মিতা মনে রেখ' কথাটির প্রয়োগ ও এর রিদমিক প্যাটার্ন গানটিকে সময়ের চেয়ে এগিয়ে রেখেছে।
তবে 'মৌমিতা' গানটিতে বোল্ড ভোকালে তিনি এক আত্মবিশ্বাসী প্রেমিকের প্রতীক। এখানে পপ ধাঁচের সঙ্গে রকের একরকম সংমিশ্রণ করেছেন।
'প্রতিশোধ' গানটির কথায় যেমন কবিত্ব আছে, তেমনি আছে মেলোডি ও পপের চমৎকার মেলবন্ধন। এই গানটিতে আশির দশকের পপ গানের একটা স্বাদ পাওয়া যায়। 'তোমার জীবনে যখন আসবে ফাগুন, জ্বালবো আগুন/ ঠিক তখনই জেনো আমি জ্বালাবো আগুন'—কথাগুলো প্রচণ্ড মনোবেদনার। তবে এখানে সুরে তীব্র কষ্ট বা সাসপেন্স নেই, বরং আছে একইসঙ্গে আক্ষেপ ও আত্মপ্রত্যয়।
এই অ্যালবামের 'ছবি আঁকো ইচ্ছে মতো' গানটি কথার দিক থেকে ব্যতিক্রমী। এখানে আছে মানুষের নিজেকে ভালোবাসা ও বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা। তবে গানটির সুর খুব গভীর বা ইন্ট্রোস্পেক্টিভ না করে বাচ্চু বেশ গতিশীল ও উচ্ছ্বাসপূর্ণ সুর করেছেন। 'নিঃসংকোচে তুমি বেঁচে থাকো/ নিজের মতো সুখের ছবি আঁকো' কিংবা 'মানুষের মাঝে কেন শান্তি খোঁজো/ সাগরের কাছে গিয়ে চোখটা বোজো'—কথাগুলো হাজারো হতাশ হৃদয়কে অনুপ্রাণিত করতে পারে।
মুক্তির পর তুমুল জনপ্রিয়তা পাওয়া অ্যালবাম 'প্রেম তুমি কি?' এখনো শ্রোতাদের মুগ্ধ করে। বিশেষত মেলোডিক রক ধাঁচের গানগুলো। খুব তীব্র নিরীক্ষা এখানে নেই। কিন্তু আছে অনুভূতির গভীরে পৌঁছানোর মতো কয়েকটি গান। এই অ্যালবামটি আইয়ুব বাচ্চুর ক্যারিয়ারে বাণিজ্যিক সাফল্যের এক রঙিন পালক। একইসঙ্গে এর কয়েকটি গান হৃদয়ের গভীর অনুভূতির সঙ্গে একাত্মতার স্মারক। তাই প্রকাশের ২৫ বছর পরও শ্রোতাদের মুগ্ধ করে 'প্রেম তুমি কি?'


Comments