গ্যাস সংকটে বছরের বেশিরভাগ সময় বন্ধ থাকে সার কারখানা

গ্যাসের ঘাটতির কারণে প্রতি বছর দেশের অধিকাংশ সার কারখানা সক্ষমতার সর্বোচ্চ উৎপাদন করতে পারছে না। অথচ, সরকারকে চাহিদা মেটাতে উচ্চমূল্যে বিদেশ থেকে সার আমদানি করতে হচ্ছে।
দেশের প্রতি বছর ৩০-৩২ লাখ টন ইউরিয়ার চাহিদা রয়েছে। বর্তমানে কৃষি উৎপাদন স্থিতিশীল রাখতে সরকারকে এই চাহিদার প্রায় ৫০ শতাংশ সার আমদানি করতে হচ্ছে।
অথচ, গত অর্থবছরে দেশের ইউরিয়া উৎপাদন সক্ষমতার প্রায় ৬০ শতাংশ অব্যবহৃত ছিল।
নবনির্মিত ঘোড়াশাল-পলাশ সার কারখানা ছাড়া বাকি সব সার কারখানা সক্ষমতার চেয়ে কম উৎপাদন করছে।
উদাহরণস্বরূপ, জামালপুরের যমুনা সার কোম্পানি গত অর্থবছরে ৩৫১ দিন কোনো সার উৎপাদন করেনি। এই কারখানার বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা ৫.৬ লাখ টন। অথচ, তারা উৎপাদন করেছে মাত্র ৪ হাজার টন ইউরিয়া।
সিলেটের শাহজালাল সার কোম্পানি দেশের অন্যতম আধুনিক কারখানা। গ্যাস সংকটের কারণে ১৪৭ দিন বন্ধ ছিল কারখানাটি।
বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি) তথ্য অনুসারে, সরকার গত অর্থবছরে বিদেশ থেকে ১৬ লাখ ৪৪ হাজার টন ইউরিয়াও আমদানি করেছে, আবার বসিয়ে রেখে কারখানাগুলোর কর্মীদের বেতন ও কারখানার রক্ষণাবেক্ষণ খরচও বহন করেছে।
সোমবার বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) আয়োজিত গণশুনানিতে সার কারখানার জন্য গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবের পর এ বিষয়ক তথ্য জমা দিয়েছে বিসিআইসি।
বর্তমানে সার কারখানাগুলোর জন্য প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ১৬ টাকা। গত ১০ আগস্ট পেট্রোবাংলা বিইআরসিতে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ৪০ টাকা নির্ধারণের জন্য আবেদন করে।
বিইআরসির কারিগরি মূল্যায়ন দল গতকাল সার কারখানার জন্য নতুন দাম ৩০ টাকা নির্ধারণের সুপারিশ করেছে।
বিইআরসি ১৩ অক্টোবর পর্যন্ত লিখিত জনমত গ্রহণ করবে এবং পরে সিদ্ধান্ত জানাবে।
গণশুনানিতে আমন্ত্রিত বেশিরভাগ সংগঠন শুনানিতে অনুপস্থিত ছিল। কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এই শুনানি বর্জন করেছে।
ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম বলেন, 'সার শ্রেণিতে গ্যাসের দাম বাড়ানো হলে কিছুদিন পর সারের দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়াও শুরু হবে। আর সারের দাম বাড়লে পুরো কৃষি ব্যবস্থাপনা ভেঙে পড়বে এবং তখন আমাদের খাদ্য আমদানি করতে হবে। দেশ ধীরে ধীরে আমদানিনির্ভর বাজারে পরিণত হচ্ছে।'
খাদ্য নিরাপত্তার স্বার্থে সার কারখানার জন্য গ্যাসের দাম সাধারণত কম রাখা হয় বলে উল্লেখ করেন তিনি।
বিসিআইসির পরিচালক (পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন) মো. দেলোয়ার হোসেন শুনানিতে তার বক্তব্যে বলেন, কর্তৃপক্ষ ২০২২ সালে নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ৪ টাকা ৪৫ পয়সা থেকে গ্যাসের দাম বাড়িয়ে ১৬ টাকা করেছিল। কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা হয়নি।
তিনি বলেন, গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। যদি দাম বাড়াতেই হয়, তাহলে সেটা ১৬ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ২০ টাকা করা যেতে পারে। কৃষকদের স্বার্থ তাহলে কিছুটা হলেও রক্ষা পাবে।
২০০৭-০৮ অর্থবছরে গ্যাসের ঘাটতির মধ্যে 'গ্যাস রেশনিং সিস্টেম' চালু হওয়ার পর থেকে সার কারখানাগুলো প্রয়োজনীয় গ্যাস পাচ্ছে না। ফলে স্থানীয়ভাবে ইউরিয়া উৎপাদন কমছে। ২০০৬-০৭ অর্থবছরে স্থানীয় উৎপাদন ছিল প্রায় ১৮ লাখ টন।
দেলোয়ার জানান, গত অর্থবছরে স্থানীয় ইউরিয়া উৎপাদন ছিল ১০ লাখ টনের বেশি ছিল, যার ৮০ শতাংশই ঘোড়াশাল-পলাশ কারখানা থেকে এসেছে। তার অর্থ, অন্যান্য কারখানাগুলো মাত্র ২ লাখ টন ইউরিয়া উৎপাদন করেছে।
তিনি বলেন, 'আমদানি নির্ভরতা বহুগুণ বেড়েছে। এর ফলে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা বেরিয়ে যাচ্ছে।'
বিসিআইসির জমা দেওয়া তথ্য অনুসারে, যদি গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়, তাহলে প্রতি টন ইউরিয়া উৎপাদনে ৩৮ হাজার টাকা খরচ হবে। এতে বলা হয়েছে, সরকার ভর্তুকি হিসেবে ১৩ হাজার টাকা দেয় এবং তারা ডিলারদের কাছে ২৫ হাজার টাকায় সার বিক্রি করেন।
বিসিআইসির তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রতি টন ইউরিয়া আমদানির খরচ ৫৬ হাজার ৫৪৭ টাকা এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ছিল ৫১ হাজার ৪১৮ টাকা।
সার কারখানার জন্য গ্যাসের দাম ৩০ টাকা নির্ধারণ করা হলেও উৎপাদন খরচ আমদানির তুলনায় কম হবে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি উপ-সচিব মো. মনিরুজ্জামানও গ্যাসের দাম বৃদ্ধির সুপারিশের বিরোধিতা করেননি।
সরকারের পক্ষ থেকে খুচরা পর্যায়ে সারের দাম বৃদ্ধির কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'সরকার যদি ভর্তুকির মাধ্যমে বাড়তি উৎপাদন খরচ মেটায়, তাহলে গ্যাসের দাম বাড়ানো যেতে পারে।'
সার কারখানাগুলোতে প্রতিদিন ২৪৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা রয়েছে, যেখানে পেট্রোবাংলা গড়ে ১১৬ মিলিয়ন ঘনফুট সরবরাহ করেছে।
পেট্রোবাংলার পরিচালক (অর্থ) একেএম মিজানুর রহমান বলেন, 'যদি দাম বাড়ানোও হয়, তারপরও গড়ে ১৮১ মিলিয়ন ঘনফুটের বেশি গ্যাস সরবরাহ করা সম্ভব হবে না।'
'দাম বাড়ালে পেট্রোবাংলার ঘাটতি কমবে। কারণ, গ্যাসের গড় সরবরাহ মূল্যের চাইতে সার খাতে গ্যাসের দাম অনেক কম,' যোগ করেন তিনি।
Comments