একসময় চলত ‘চাঁদ সওদাগরে’র নৌকা, সতী এখন সরু খাল

হাড়িভাঙ্গা এলাকায় সতী নদীর করুণ দশা। ছবি: এস দিলীপ রায়

বছরের পর বছর দখল, দূষণ ও অনিয়মে এখন মৃতপ্রায় লালমনিরহাটের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী সতী নদী। একসময় নদীটির গড় প্রস্থ ছিল প্রায় ৫০০ ফুট। কিন্তু লালমনিরহাট শহরের বাসস্ট্যান্ডের উজানে হাড়িভাঙ্গা ও বালাটারী এলাকায় এ নদীর প্রস্থ নেমে এসেছে মাত্র ছয় থেকে সাত ফুটে। 

পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, হাতীবান্ধা উপজেলার পারুলিয়া এলাকায় তিস্তা নদী থেকে উৎপন্ন সতী নদী। এটি আদিতমারী ও লালমনিরহাট সদর উপজেলা পেরিয়ে পুনরায় তিস্তায় মিশেছে। পথে আদিতমারীর ভাদাই ইউনিয়নে ভেটেশ্বর নদে মিলিত হয়ে 'মরা সতী' নামে নতুন প্রবাহে বিভক্ত হয়। কোথাও এটি 'দিকসতী', কোথাও আবার মূল নামেই প্রবাহিত হলেও প্রায় সর্বত্রই নদীর করুণ চিত্র চোখে পড়ে। সতী নদীর দৈর্ঘ্য ৪৯ কিলোমিটার। 

স্থানীয়রা জানান, কোথাও নদীর জায়গা দখল করে পুকুর, কোথাও চাষাবাদ চলছে। অসংখ্য পুকুর খননের ফলে স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত হচ্ছে। ছোট সেতু ও কালভার্ট নির্মাণ, অবৈধ স্থাপনা ও ভয়াবহ দূষণ নদীর প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। কয়েক দশক আগেও সারা বছর এ নদীতে পানি ও প্রচুর মাছ থাকত। লোককথা আছে, একসময় চাঁদ সওদাগরের ডিঙা এ নদী ধরেই চলাচল করত।

হাড়িভাঙ্গা এলাকার কৃষক মহির উদ্দিন (৭০) জানান, তিনি তার বাবা মৃত আফজাল হোসেনের কাছে শুনেছিলেন, একসময় হাড়িভাঙ্গা এলাকায় সতী নদী দিয়ে নৌকা চলাচল করত। বাণিজ্যের জন্য বিভিন্ন স্থান থেকে সওদাগররা নৌকা নিয়ে আসতেন। তারা হাড়িভাঙ্গা এলাকায় নৌকা রেখে পণ্য কেনাবেচা করতেন। এটি এখন শুধুই গল্প। 

'ছোটবেলায় আমিও মরা সতী নদীতে পানিপ্রবাহ দেখেছি। নৌকা চলাচল করতে দেখেছি। এখন আর নদী নেই। সেখানে গড়ে উঠেছে ঘর-বাড়ি ও অফিস,' তিনি বলেন।

বালাটারী এলাকার কৃষক আবেদ আলী (৬৫) জানান, একসময় সতী নদীতে সারাবছরই মাছ ধরা যেত। এখন আর নদীর চিহ্নই নেই। সরু একটি খালে পরিণত হয়েছে। চোখের সামনেই মরা সতী নদীটি মরে গেল। জেলা প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ড উদ্যোগ নিলে নদীটিকে রক্ষা করতে পারতো। 

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক তুহিন ওয়াদুদ বলেন, 'আমি একাধিকবার সতী নদী পরিদর্শন করেছি। এটি পরিদর্শন করে খুবই কষ্ট পেয়েছি। অনেক এলাকায় সতী নদীর কিছুটা অস্তিত্ব থাকলেও কিছু এলাকায় নদীর অস্তিত্ব প্রায় বিলীনের পথে। এ নদীকে এখনো রক্ষার সুযোগ রয়েছে।' 

'সতী নদী রক্ষার জন্য আমি জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত আবেদন করেছি এবং এ বিষয়ে কিছু প্রস্তাবনা তুলে ধরেছি,' তিনি বলেন।

তিনি আরও বলেন, 'প্রশাসনের আন্তরিক উদ্যোগ ও দ্রুত পদক্ষেপ নিলে সতী নদীকে তার পুরোনো রূপে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। সেজন্য অবৈধ দখল উচ্ছেদ ও ব্যক্তিমালিকানা বাতিল করতে হবে, নদীর প্রকৃত প্রস্থ অনুযায়ী সেতু পুনর্নির্মাণ ও ছোট কালভার্ট অপসারণ করতে হবে, তিস্তার সঙ্গে সংযোগ পুনরুদ্ধারে বাধা অপসারণ জরুরি এবং দিয়ারা জরিপের মাধ্যমে সব প্রবাহকে নদী হিসেবে রেকর্ডভুক্ত করতে হবে।'

লালমনিরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সুনীল কুমার বলেন, 'সতী নদীর আরেক প্রবাহ মরা সতী নদীর বহু অংশে এখনো পানি প্রবাহ থাকলেও সরকারি রেকর্ডে নদী হিসেবে উল্লেখ নেই। পুরোনো প্রবাহের কিছু স্থানে গুচ্ছগ্রাম গড়ে তোলা হয়েছে। নদীর উৎসস্থলও দখল ও বাঁধের কারণে তিস্তার সঙ্গে প্রাকৃতিক সংযোগ হারিয়েছে।'

'জেলা প্রশাসকের নির্দেশে পানি উন্নয়ন বোর্ড নদীটির বিভিন্ন স্থানে জরিপ কার্যক্রম চালাচ্ছে। খুব দ্রুত জেলা প্রশাসনের কাছে জরিপের প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে,' তিনি বলেন। 

জেলা নদী রক্ষা কমিটির সভাপতি ও জেলা প্রশাসক এইচ এম রকিব হায়দার বলেন, 'সতী একটি ঐতিহ্যবাহী নদী এটা সবাই জানেন, আমরাও জানি। কিন্তু নদীর কিছু অংশে নদী হিসেবে কোন রেকর্ড পাওয়া যাচ্ছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডকে জরিপ করে তদন্ত দিতে বলা হয়েছে।'

'জরিপ প্রতিবেদন পাওয়ার পর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে দিয়ারা জরিপের মাধ্যমে সতী নদীকে পুনরুদ্ধার করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে,' বলেন তিনি।

Comments

The Daily Star  | English

Fire breaks out at building in Mirpur's Kalshi

Cause of the fire could not be known immediately

14m ago