ইসরায়েল কি এখন যুক্তরাষ্ট্রের ৫১তম অঙ্গরাজ্য?
সম্প্রতি উইটকফ, কুশনার, ভ্যান্স ও রুবিওর মতো কয়েকজন উচ্চপদস্থ মার্কিন কর্মকর্তা ইসরায়েল সফর করেন। তাদের প্রধান লক্ষ্য— প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু সরকার যেন গাজা যুদ্ধবিরতি চুক্তি থেকে সরে না আসে।
যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের চরম ডানপন্থি সরকারকে চাপে রাখতে চায়। এই সরকার অবশ্য যুদ্ধ পুনরায় শুরু করার সুযোগ খুঁজছে। গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধে ৬৮ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনির প্রাণ গেছে। ইসরায়েলে মার্কিন কর্মকর্তাদের এই উপস্থিতিকে 'শিশুদের দেখভাল বা বেবিসিটিংয়ে'র সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে।
কিছু বিশ্লেষক মনে করেন, এসব দেখে বোঝা যায়, ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি অনেকটা নির্ভরশীল এবং ওয়াশিংটন যা আদেশ দেয়, ইসরায়েল শেষ পর্যন্ত তা মেনে নেয়।
সাবেক ইসরায়েলি দূত এবং নিউইয়র্কে নিযুক্ত কনসাল জেনারেল অ্যালন পিঙ্কাস বলেন, ইসরায়েল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্লায়েন্ট স্টেট। তারা যুক্তরাষ্ট্র থেকে কোটি কোটি ডলার সাহায্য পায়। জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্র বারবার ভেটো ব্যবহার করে ইসরায়েলকে সমালোচনা বা নিষেধাজ্ঞা থেকে রক্ষা করে। তাদের সামরিকভাবে সুরক্ষা দেওয়াও এর প্রমাণ।
এখন ট্রাম্প প্রশাসন সেই সমর্থনকে ব্যবহার করে দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিরল পদক্ষেপ নিচ্ছে। আর তা হলো ইসরায়েলকে মার্কিন ইচ্ছা অনুযায়ী কাজ করতে বাধ্য করা এবং ওয়াশিংটনের চাপ দেওয়ার বিষয়টিকে সামনে আনা।
এই চাপের কিছুটা আসছে খোদ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কাছ থেকেই। টাইম ম্যাগাজিনে প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, তিনি নেতানিয়াহুকে গাজায় যুদ্ধ চালিয়ে যেতে বাধা দিয়েছিলেন। 'আমি তাকে থামিয়েছি, নয়তো সে থামত না। যুদ্ধ কয়েক বছর ধরে চলতে পারত।'
একই সাক্ষাৎকারে তিনি আরও জানান, যদি ইসরায়েল অধিকৃত পশ্চিম তীর নিজেদের অন্তর্ভুক্ত করার দিকে এগিয়ে যায়, তবে যুক্তরাষ্ট্র সব সমর্থন বন্ধ করে দেবে। যদিও বুধবার এ সংক্রান্ত প্রস্তাবটি প্রাথমিকভাবে ইসরায়েলি পার্লামেন্টে অনুমোদন পায়। ভাইস প্রেসিডেন্ট জে ডি ভ্যান্সও সংযুক্তি ভোটকে 'খুব বোকামি' বলে সমালোচনা করেন।
নেতানিয়াহু সম্ভবত বার্তাটি বুঝতে পেরেছেন। তার দপ্তর এই ভোটকে 'রাজনৈতিক প্ররোচনা' হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। যদিও তার নিজের সরকারের সদস্যরা প্রস্তাবের সমর্থনে ভোট দিয়েছেন। তিনি নিজেও আগে অন্তর্ভুক্তির পক্ষে ছিলেন।
অসম অংশীদারত্ব
যুক্তরাষ্ট্র সবসময় ইসরায়েলের তুলনায় শক্তিশালী পক্ষ। এটি বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী দেশ। আর ইসরায়েল তাদের মিত্র। যুক্তরাষ্ট্রেও ইসরায়েলের সমর্থন বেশ। তুলনায় প্রভাবশালী হলেও মার্কিন প্রশাসন তেল আবিবের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে সরাসরি দ্বন্দ্ব এড়িয়ে চলেছে।
সাবেক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন গাজা যুদ্ধে প্রথম তিন মাসে ইসরায়েলের প্রতি 'বিয়ার হাগ' নীতি দেখিয়েছিলেন। তার যুক্তি ছিল, গাজায় অতিরিক্ত ধ্বংসযজ্ঞ থেকে বিরত রাখতে ইসরায়েলের প্রতি প্রতি প্রকাশ্যভাবে সমর্থন জানানো প্রয়োজন।
এই নীতি কার্যকর হয়নি, কারণ নেতানিয়াহু বারবার যুদ্ধবিরতির চেষ্টা উপেক্ষা করেছেন। পরিবর্তে ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট পদে ফিরে আসার পর ইসরায়েলের সঙ্গে তুলনামূলকভাবে বেশি মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছেন। এখন পর্যন্ত এটি কার্যকর মনে হচ্ছে। ট্রাম্প তার আগের মেয়াদে সমর্থন দিয়ে ইসরায়েলে বেশ জনপ্রিয় ছিলেন।
চ্যাথাম হাউসের সিনিয়র কনসাল্টিং ফেলো ইয়োসি মেকেলবার্গ আল জাজিরাকে বলেন, 'নেতানিয়াহুকে সতর্ক করা হয়েছে। মার্কিন প্রতিনিধিদল যতই অন্য কথা বলুক, তাদের এজেন্ডা স্পষ্ট।'
সিক্সটি মিনিটস সাক্ষাৎকারের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, সেখানে কুশনার ও উইটকফ কাতারের দোহায় ইসরায়েলি হামলা নিয়ে বিশ্বাসঘাতকতা ও নিয়ন্ত্রণ হারানোর কথা বলেছিলেন।
'আমার মতে, এটি ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যমে দেখা বন্ধুত্বপূর্ণ চিত্রের পুরোপুরি উল্টো। এটি ট্রাম্প প্রশাসনের পরিষ্কার বার্তা— আপনাকে যা বলা হয়েছে তা করুন।'
সাক্ষাৎকারে কুশনার বলেছেন, তার শ্বশুর ট্রাম্প মনে করেছিলেন যে ইসরায়েলিরা তাদের কর্মকাণ্ডে 'কিছুটা নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে'। তারা যেন এমন কাজ করতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়ার সময় এসেছে।
মার্কিন প্রশাসনের ব্যাখ্যা হলো, ইসরায়েলের কর্মকাণ্ড সীমাবদ্ধ রাখার ক্ষেত্রে ট্রাম্পের যে নীতি, সেটি যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল— দুই দেশের জন্যই লাভজনক। এটি দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে মার্কিন প্রাধান্য তুলে ধরে এবং দুই দেশের বন্ধনকেও শক্তিশালী করে।
নেতানিয়াহুর সাবেক সহকারী মিচেল বারাক আল জাজিরাকে বলেন, মার্কিন-ইসরায়েল সম্পর্ক দুই দেশের নীতিতেই খুব গুরুত্বপূর্ণ। এটি ইহুদি-খ্রিস্টান মূল্যবোধের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। পাশাপাশি ইসরায়েল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি মূল্যবান কৌশলগত অংশীদার। এটি আঞ্চলিক নীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি আরও যোগ করেন, 'আরও বড় কথা হলো, আমরা দেখছি যে মার্কিন ব্যবসা এবং ট্রাম্প পরিবারের ব্যবসা— দুইয়ের জন্যই স্থিতিশীলতা ও শান্তি লাভজনক।'
বারাক বলেন, এটা সত্য যে, এই প্রক্রিয়ায় ইসরায়েল কিছুটা স্বাধীনতা হারিয়েছে, কিন্তু এতে নতুন কিছু নেই। আমি মনে করি, এটাই আমরা এখন দেখছি— মার্কিন প্রশাসন যুদ্ধবিরতির ক্ষেত্রে 'ক্যারট অ্যান্ড স্টিক' কৌশল ব্যবহার করছে। ভ্যান্সসহ যারা ইসরায়েল সফর করেন, তারা আসলে স্টিকের বিষয়টি মনে করিয়ে দেন।
ক্যারটের দিক বিবেচনা করলে নেতানিয়াহু যা চান তা গুরুত্ব দিয়ে দেখছেন ট্রাম্প। আর তা হলো রাজনৈতিক সাফল্য এবং প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার আইনি সমস্যার সমাধান।
অক্টোবরের শুরুতে যুদ্ধবিরতি উপলক্ষে নেসেটে ভাষণ দেওয়ার সময় ট্রাম্প ইসরায়েলের প্রেসিডেন্ট আইজ্যাক হারজগের প্রতি আহ্বান জানান, নেতানিয়াহু ২০১৯ সালের পর থেকে যে একাধিক দুর্নীতি মামলার মুখোমুখি হয়েছেন, তা থেকে তাকে যেন অব্যাহতি দেওয়া হয়।
মেকেলবার্গ বলেন, 'ট্রাম্প তা করতে পারেন। তিনি হয়তো নেতানিয়াহুকে বলতে পারেন, দেখুন, আমি আসব, নেসেটে কথা বলব, এমনকি আপনার জন্য ক্ষমাও চাইতে পারি, কিন্তু এর বিনিময়ে আপনাকে যা বলা হয়েছে, আপনি তা মেনে চলবেন।'
'অযৌক্তিক বক্তব্য'
ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে তার স্বাধীনতার অনেকটা হারিয়েছে বলে যে ধারণা সামনে আসছে, তা নেতানিয়াহুকে কিছুটা বিরক্ত করেছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'আমি এটা স্পষ্ট করতে চাই। এক সপ্তাহে তারা বলে, ইসরায়েল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ করে। আবার পরের সপ্তাহে তারা বলে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে নিয়ন্ত্রণ করে। এসব সম্পূর্ণ অযৌক্তিক।'
যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আপত্তি আছে নেতানিয়াহুর। কিন্তু প্রমাণগুলো তো তাকে পুরোপুরি সমর্থন করে না। এসব প্রমাণের মধ্যে রয়েছে, নেতানিয়াহুকে যুদ্ধবিরতি চুক্তি কার্যকরে বাধ্য করার জন্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টা। পাশাপাশি আরও কিছু ঘটনা রয়েছে, যেখানে ট্রাম্প প্রশাসনকে ইসরায়েলের নীতি নির্ধারণ করতে দেখা গেছে।
যুদ্ধবিরতি ঘোষণা হয় নেতানিয়াহুর সর্বশেষ ওয়াশিংটন সফরের সময়। কিছু বিশ্লেষক মনে করেন, এটি প্রধানমন্ত্রীকে চুক্তির শর্তগুলো প্রকাশ্যভাবে মেনে নিতে বাধ্য করার কৌশল ছিল।
একই সফরে, নেতানিয়াহু দোহায় আঘাতের জন্য কাতারের প্রধানমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ বিন আব্দুলরহমান বিন জাসিম আল থানির কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা জানাতে বাধ্য হন।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল জুনে ইরানের সঙ্গে ইসরায়েলের ১২ দিনের যুদ্ধ শেষ হওয়ার সময়টা। তখন যুদ্ধবিরতি শুরু হওয়ার পর ট্রাম্পই নেতানিয়াহুকে পরিকল্পিত হামলা বন্ধ করতে নির্দেশ দেন।
পিঙ্কাসের মতে, এসব পদক্ষেপ নেতানিয়াহু এবং অন্যদের মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, ইসরায়েল-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক অসম, বিশেষ করে ট্রাম্প প্রশাসনের এই সময়টায়।
তিনি বলেন, 'তারা ইসরায়েলের চলাফেরার স্বাধীনতার সীমা নির্ধারণ করে দিচ্ছে। নেতানিয়াহু ও অন্যদের জানানো হচ্ছে, তারা পরামর্শ ছাড়াই একটি নির্দিষ্ট পর্যায় পর্যন্ত যেতে পারেন, কিন্তু তার বেশি নয়।'
তারা নেতানিয়াহুকে মনে করিয়ে দিচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রে তার বিকল্প শেষ। ডেমোক্র্যাটরা বিরক্ত, জনমত বিপরীতে, রিপাবলিকানরাও প্রশ্ন তুলছে। এখন তিনি আর দুই পক্ষে একে অন্যের বিরুদ্ধে খেলাতে পারবেন না, এটাই শেষ সীমা।


Comments