ধ্বংসস্তূপেই ঘরের খোঁজে গাজাবাসী, শান্তির আশা টিকবে তো?

গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর ইসরায়েলি সেনারা প্রথম পর্যায়ের চুক্তি অনুযায়ী সেখান থেকে সরে যেতে শুরু করেছে। এমন পরিস্থিতিতে লাখো বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনি তাদের বাড়িঘরে ফিরছেন। গত দুই বছরের যুদ্ধে ইসরায়েলি হামলায় তাদের অনেকের বাড়িঘর ধ্বংস হয়ে গেছে।
শুক্রবার উপকূলের বালুকাময় পথ ধরে উত্তরমুখী হন বহু বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনি। কয়েকদিন আগেও যে গাজা সিটি ছিল ইসরায়েলি হামলার প্রধান কেন্দ্র, সেদিকেই ফিরছিলেন তারা। এর আগে ভোরে ইসরায়েলি মন্ত্রিসভা যুদ্ধবিরতি ও বন্দি বিনিময়ের চুক্তিতে অনুমোদন দেয়।
গাজা সিটির শেখ রাদওয়ান এলাকায় ৪০ বছর বয়সী ইসমাইল জায়দা বলছিলেন, 'আমার বাড়ি এখনও ঠিকঠাক আছে। কিন্তু পুরো এলাকার অবস্থা ভয়ঙ্কর, প্রতিবেশীদের বাড়ি ধ্বংস হয়ে গেছে।'
৪০ বছর বয়সী মাহদি সাকলা বলেন, যুদ্ধবিরতির খবর পাওয়ামাত্রই তার পরিবার উত্তরদিকে, গাজা সিটির পথে রওনা দেয়।
তিনি বলেন, 'এখন আর ঘরবাড়ি নেই। সব ধ্বংস হয়ে গেছে। কিন্তু যেখানে আমাদের ঘরবাড়ি ছিল, সেই জায়গায় ফিরতে পারাটাই আমাদের জন্য আনন্দের। গত দুই বছর ধরে আমরা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ঘুরে বেড়াচ্ছি, কষ্টে দিন কাটাচ্ছি।'
দক্ষিণের খান ইউনিস শহর এখন ধুলোয় ঢাকা মরুভূমির মতো রূপ নিয়েছে। এটি গাজার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। ইসরায়েলি সেনারা এই শহর অনেকটাই ধ্বংস করে দিয়েছে। সেখানেও লোকজন তাদের বাড়ির খোঁজে ফিরছে।
মধ্যবয়সী আহমেদ আল-ব্রিম সাইকেলের সামনে ও পেছনে বাঁধা কাঠ নিয়ে এগোচ্ছিলেন। এসব কাঠ তার ঘরের ধ্বংসাবশেষ থেকে উদ্ধার করা। তিনি বলেন, 'আমরা আমাদের এলাকায় গিয়েছিলাম। সব কিছু ধ্বংস হয়ে গেছে। এরপর আমরা কোথায় যাব তা জানি না। আমরা আসবাবপত্র, কাপড় বা শীতের কাপড় কিছুই নিতে পারিনি। কিছুই বাকি নেই।'
ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, ইসরায়েল সেনা প্রত্যাহার করার পর গাজার বিভিন্ন এলাকা থেকে মেডিকেল টিম ১০০টি মরদেহ পেয়েছে।
যে প্রশ্ন সামনে আসছে
গাজার ফিলিস্তিনিরা বাড়ি ফিরলেও প্রশ্ন সামনে আসছে— মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ২০-পদক্ষেপের পরিকল্পনার আলোকে ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতি ও বন্দি-বিনিময় চুক্তি কি সত্যিই স্থায়ী শান্তি আনতে পারবে?
হোয়াইট হাউসে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় ট্রাম্প আশ্বাস দেন, যুদ্ধবিরতি বজায় থাকবে। তিনি বলেন, 'তারা সবাই লড়াইয়ে ক্লান্ত।' ট্রাম্প আরও উল্লেখ করেন, পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে 'সম্মিলিত মত' আছে, যদিও কিছু বিষয় এখনো সমাধান করা বাকি রয়েছে।
ইসরায়েলি সেনারা জানিয়েছে, যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছে। ট্রাম্পের পরিকল্পনার প্রথম পর্যায় অনুযায়ী, শহরাঞ্চল থেকে ইসরায়েলি সেনাদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সরে যেতে হবে, যদিও তারা গাজার অর্ধেকের বেশি এলাকা নিয়ন্ত্রণে রাখবে।
হামাস অস্ত্র না ছাড়লে 'কঠিন পথে' হাঁটবেন নেতানিয়াহু
ট্রাম্পের পরিকল্পনার পরবর্তী পর্যায়ে বোর্ড অব পিস নামের আন্তর্জাতিক সংস্থা গাজার যুদ্ধোত্তর প্রশাসনে ভূমিকা নেবে। এতে নেতৃত্ব দেবেন ট্রাম্প এবং এতে থাকবেন সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারও।
তবে হামাস শুক্রবার বলেছে, তারা 'বৈদেশিক অভিভাবকত্ব' মেনে নেবে না। তাদের মতে, গাজার শাসনভার সম্পূর্ণরূপে ফিলিস্তিনিদের বিষয়।
প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু এক টিভি ভাষণে বলেন, ইসরায়েলি সেনারা গাজার মধ্যে থাকবে হামাসকে অস্ত্রমুক্ত করতে। 'যদি সহজভাবে হয়, তাহলে ভালো। না হলে কঠিনভাবে এটি করা হবে।'
মৃত জিম্মিদের ফেরত পাবে ইসরায়েল?
সেনা প্রত্যাহারের জিম্মিদের মুক্তি দেওয়ার জন্য হামাসের কাছে ৭২ ঘণ্টা সময় থাকবে। ট্রাম্প বলেছেন, জিম্মিরা সোমবার দেশে ফিরবেন।
বিপরীতে ইসরায়েল ২৫০ দীর্ঘমেয়াদে সাজাপ্রাপ্ত ফিলিস্তিনি বন্দি ও এক হাজার ৭০০ যুদ্ধকালীন বন্দিকে মুক্তি দেবে। প্রতিদিন শত শত ট্রাক খাদ্য ও চিকিৎসা সামগ্রী নিয়ে গাজায় ঢুকবে।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর মুখপাত্র ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এফি ডেফরিন সতর্ক করে বলেন, গাজার বাসিন্দাদের সেনা নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকা এড়িয়ে চলতে হবে। 'চুক্তি মেনে চলুন, নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন।'
যুদ্ধবিরতি নিয়ে হামাসের নির্বাসিত গাজা শাখার প্রধান খালিল আল-হাইয়া বলেন, তিনি যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য মধ্যস্থতাকারীদের কাছ থেকে যুদ্ধের অবসানের নিশ্চয়তা পেয়েছেন।
ধারণা করা হচ্ছে, গাজায় এখনও ২০ জন জিম্মি জীবিত আছেন। আর ২৬ জিম্মি মারা গেছেন। আর দুজনের ভাগ্য অজানা। হামাস জানিয়েছে, মরদেহ উদ্ধারের কাজে জীবিত জিম্মিদের মুক্তি দেওয়ার চেয়েও বেশি সময় লাগতে পারে।
চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে
চুক্তিটি পুরোপুরি বাস্তবায়িত হলে এটি হবে যুদ্ধ থামানোর ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় অগ্রগতি। তবে অনেক কিছুই এখনো অনিশ্চিত।
ট্রাম্পের প্রস্তাবিত ২০ দফা শান্তি পরিকল্পনার বেশ কয়েক ধাপ এখনো চূড়ান্ত হয়নি— এর মধ্যে রয়েছে যুদ্ধশেষে ধ্বংসস্তূপে পরিণত গাজা কে পরিচালনা করবে এবং ইসরায়েলের দাবি অনুযায়ী হামাস অস্ত্র ছাড়বে কি না, সেই প্রশ্নও অনির্ধারিত।
হামাস-নিয়ন্ত্রিত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ইসরায়েলি সেনারা যেসব এলাকা থেকে সরে গেছে, সেখানে তারা নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন করবে। তবে সশস্ত্র যোদ্ধারা আবার রাস্তায় ফিরবেন কি না, তা স্পষ্ট নয়। এমন হলে ইসরায়েল তা উসকানি হিসেবে দেখবে।
Comments