দেরিতে হাসপাতালে ভর্তিই ডেঙ্গুতে মৃত্যুর প্রধান কারণ

এ বছর ডেঙ্গুতে মারা যাওয়া রোগীদের ৮১ শতাংশই তিন দিন বা তার বেশি সময় জ্বরে আক্রান্ত থাকার পর হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ। এতে স্পষ্ট হয়েছে, দেরিতে হাসপাতালে ভর্তি হওয়াই ডেঙ্গুতে মৃত্যুর প্রধান কারণ।

ভর্তি হওয়ার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই প্রায় ৭৪ শতাংশ রোগীর মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ৫০ শতাংশ মারা গেছেন ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে (ডিএসএস)।

এছাড়া মৃতদের মধ্যে ৪৩ শতাংশ ডেঙ্গু ছাড়াও আরও অন্য কোনো রোগেও আক্রান্ত ছিলেন বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য থেকে জানা যায়।

সম্প্রতি ভাইরাসজনিত এ রোগের প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় প্রাথমিক পর্যায়ে পরীক্ষা ও সময়মতো হাসপাতালে ভর্তি হওয়া অত্যন্ত জরুরি বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা।

রাজধানীর মহাখালীতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কার্যালয়ে সোমবার সংবাদ সম্মেলনে এ বছর ডেঙ্গুতে মারা যাওয়া ১১৪ জন রোগীর মৃত্যুর তথ্য পর্যালোচনার পর এসব পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশ জানায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক মো. আবু জাফর বলেন, 'যথাসময়ে রোগ শনাক্ত করা না গেলে বা দ্রুত চিকিৎসা শুরু করা না হলে ভোগান্তি ও মৃত্যুর হার বেড়ে যায়। এ ক্ষেত্রে জনসচেতনতা অপরিহার্য।'

তিনি বলেন, 'আমরা যা-ই করি না কেন, মানুষকে সচেতন করতে না পারলে কোনো উদ্যোগই সফল হবে না।'

দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা গত বছরের তুলনায় ৮১ শতাংশ এবং মৃত্যুর সংখ্যা ৪৩ শতাংশ বেড়েছে। এতে এ বছরের পরিস্থিতি আরও উদ্বেগজনক হয়ে উঠেছে।

গতকাল সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় আরও দুইজন মারা গেছেন এবং ৬৭৮ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এতে মোট মৃত্যু বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৮১ জনে এবং আক্রান্তের সংখ্যা ৪২ হাজার ৫০৯।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির অধ্যাপক হালিমুর রশিদ জানান, ডেঙ্গুতে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে ২০ থেকে ৩০ বছর বয়সীদের মধ্যে (১৯ জন)। এরপর ০–১০ ও ৪০–৫০ বছর বয়সীদের মৃত্যুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি—১৬ জন করে।

তাদের মধ্যে ৫৩ শতাংশ পুরুষ ও বাকিরা নারী।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ২০–৩০ বছর বয়সীদের মধ্যে মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি। কারণ তারা বাইরে বেশি সময় থাকেন এবং জ্বরের প্রাথমিক পর্যায়ে তুলনামূলকভাবে কম সতর্ক থাকে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর মারা যাওয়া ১১১ জন ডেঙ্গু রোগীর ঠিকানা সংগ্রহ করেছে। এর মধ্যে সর্বাধিক মৃত্যু হয়েছে ঢাকায়—১৭ জন। এরপর বরগুনায় ১২ জন ও নারায়ণগঞ্জে ৮ জনের মৃত্যু হয়েছে।

অধ্যাপক হালিমুর জানান, হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর সর্বাধিক ৩৩ জনের মৃত্যু হয়েছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। এরপর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ১৪ জন এবং রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১২ জন।

এদিকে, হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ৬৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ১৮ জন, ৭২ ঘণ্টার মধ্যে ৫ জন ও ৭২ ঘণ্টার পর ২৫ জন মারা গেছেন বলে তিনি জানান।

৪৭ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হন তিন থেকে ছয় দিন জ্বর থাকার পর। ২৫ জন ভর্তি হন ছয় থেকে ১০ দিন জ্বর থাকার পর এবং ১৬ জন ভর্তি হন নয় দিন বা তার বেশি সময় জ্বরে ভোগার পর।

তিনি বলেন, মাত্র ২১ জন রোগী জ্বরের এক থেকে তিন দিনের মধ্যে ভর্তি হয়েছেন।

রোগীদের গড়ে হাসপাতালে থাকার সময়কাল ছিল প্রায় আড়াই দিন।

যে ৯০ জন রোগীর পূর্ববর্তী স্বাস্থ্যগত অবস্থা জানা গিয়েছিল, তাদের মধ্যে ৩৯ জনের অন্য শারীরিক জটিলতা ছিল বলে অধ্যাপক হালিমুর জানান।

অন্তত ৫৬ জন রোগী মারা গেছেন ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে (ডিএসএস) এবং ৩৬ জন মারা গেছেন এক্সপ্যান্ডেড ডেঙ্গু সিনড্রোমে (ইডিএস)।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক জানান, ডিএসএস হলো ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারের গুরুতর রূপ। এ অবস্থায় রক্তনালী থেকে অতিরিক্ত প্লাজমা লিক হয়ে রক্তচাপ, নাড়ি ও প্রস্রাবের মাত্রা মারাত্মকভাবে কমে যায় এবং রোগী সংকটাপন্ন অবস্থায় চলে যায়। ইডিএস হলো ডেঙ্গুর আরেকটি গুরুতর রূপ, যা একাধিক অঙ্গকে প্রভাবিত করে।

অধ্যাপক হালিমুর জানান, বর্তমানে ডেঙ্গুতে মৃত্যুহার দাঁড়িয়েছে ০.৪২ শতাংশে, যা গত বছরের ০.৫৭ শতাংশের তুলনায় কম।

২০২৪ সালের আক্রান্ত ও মৃত্যুর পরিসংখ্যান উল্লেখ করে অধ্যাপক আবু জাফর বলেন, সেপ্টেম্বরে আক্রান্তের সংখ্যা আরও বাড়বে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মশা নিয়ন্ত্রণ ও ডেঙ্গু কমানোর ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার বিভাগের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

তিনি বলেন, 'আমরা ইতোমধ্যে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি, তবে সমন্বয়ের ক্ষেত্রে কিছু ঘাটতি থাকতে পারে।'

আরেক প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, স্বাস্থ্যকর্মীর ঘাটতি থাকা সত্ত্বেও তারা যেসব এলাকায় সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন—যেমন: বরগুনা—সেখানে অতিরিক্ত চিকিৎসক মোতায়েন করেছেন।

জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলো ডেঙ্গু রোগী সামলানোর জন্য প্রস্তুত কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি দাবি করেন, হাসপাতালগুলো যথেষ্ট প্রস্তুত। যদিও অনেকে চিকিৎসার জন্য ঢাকায় আসছেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল) আবু হুসাইন মো. মঈনুল আহসান জানান, তারা ইতোমধ্যে সব সরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীদের জন্য আলাদা ওয়ার্ড ও মেডিকেল টিম গঠনের নির্দেশনা দিয়েছেন এবং উন্নত চিকিৎসা নিশ্চিত করতে বলেছেন।

তিনি আরও বলেন, এসব হাসপাতালে পর্যাপ্ত টেস্ট কিট ও ফ্লুইড সরবরাহ রয়েছে।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'আমরা নিয়মিত ডেঙ্গু চিকিৎসা প্রটোকল হালনাগাদ করি এবং সে অনুযায়ী চিকিৎসক ও নার্সদের প্রশিক্ষণ দিই।'

মঈনুল আরও জানান, চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি হাসপাতালে দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন থাকার পরও এক ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যুর ঘটনা তারা তদন্ত করছেন। বিষয়টি অস্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দুই অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক খায়ের আহমেদ চৌধুরী ও অধ্যাপক শেখ সাইদুল হক ওই ব্রিফিংয়ে উপস্থিত ছিলেন।

 

Comments

The Daily Star  | English

Hasina can’t evade responsibility for Khaleda Zia’s death: Nazrul

In 2018, Khaleda walked into jail, but came out seriously ill, he says

3h ago