ভরসা যখন ‘ফাটা ডিম’

বাজারে বিক্রি হয় ‘ফাটা ডিম’ও। ছবি: স্টার

দেশে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির পর নিত্যপণ্যের দাম নাগালের বাইরে চলে যাওয়ায় কম দামে 'ফাটা ডিম' কিনতে শুরু করেছেন নিম্ন আয়ের মানুষ।

রাজধানীর পাইকারি ডিমের দোকানগুলোতে ডিম সরবরাহের সময় প্রতিদিনই কিছু ডিম ফেটে যায়। হালকা ফেটে যাওয়া এই ডিমগুলো পাইকাররা টেপ দিয়ে জোড়া লাগিয়ে কম দামে বিক্রি করে থাকেন।

তেজগাঁও রেলস্টেশন রোডের বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ডিমের আড়ৎ ঘুরে জানা গেছে, একেকটি ট্রাকে প্রায় ৭০ হাজার করে ডিম এখানে আসে। এর মধ্যে পরিবহনের সময় প্রায় ৩০০ থেকে ৪০০ ডিম ফেটে যায়।

মূলত কিছুসংখ্যক নিম্ন আয়ের মানুষ ও ছোট বেকারির দোকানিরাই এই ফাটা ডিমগুলো কেনেন। তবে আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহে ডিমের দাম বেড়ে যাওয়ার পর থেকে ফাটা ডিমের চাহিদা বেড়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।

তেজগাঁও রেলস্টেশন রোডে ৩০ বছর ধরে ডিমের ব্যবসা করছেন মো. দয়াল মিয়া। বি. বাড়িয়া ক্রেকার নামে একটি পাইকারি ডিমের দোকানের মালিক তিনি।

বাজারে বিক্রি হয় ‘ফাটা ডিম’ও। ছবি: স্টার

জানতে চাইলে দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'ফাটা ডিম ৩ ধরনের হয়। কতগুলোতে কোনো লিক থাকে না। সেগুলো টেপ মেরে বিক্রি করা হয়। এগুলোর দাম পিসপ্রতি ৫ টাকা করে। যেগুলোতে হালকা লিক আছে, কিছু তরল বেরিয়ে গেছে কিন্তু ভেতরে কুসুম আছে সেগুলো ৪ টাকা করে বিক্রি করি আর যেগুলো ভাঙা বেশি, অনেক তরল বেরিয়ে গেছে কিন্তু কুসুম আছে, সেগুলোর দাম ২ টাকা করে।'

'যখন ডিমের হালি ৫৫ টাকা হয়ে গিয়েছিল, তখন ৫ টাকার নিচে কোনো ফাটা ডিমও বিক্রি হয়নি। লিক ছাড়া ফাটা ডিম ৭ টাকা করে বিক্রি করেছি। সেসময় চাহিদা অনেক বেড়ে গিয়েছিল। অনেক খুচরা দোকানিরাও এখান থেকে ফাটা ডিম ১০০ হিসাবে কিনে নিয়ে যাচ্ছেন', বলেন তিনি।

নিম্ন আয়ের মানুষের শেষ ভরসা হিসেবে পরিচিত রাজধানীর 'ফকিন্নি বাজার'। তেজকুনিপাড়া সংলগ্ন ফ্লাইওভার ব্রিজের নিচে এই বাজারটিতে মূলত কারওয়ান বাজারের অবিক্রিত ও অবশিষ্ট মালামাল বিক্রি হয়।

ফেটে যাওয়া ডিম কিংবা পচে যাওয়া সবজির পচা অংশগুলো কেটে বাকিটুকু কম দামে বিক্রি করেন এখানকার বিক্রেতারা।

এই বাজারের ডিম বিক্রেতা শাহ আলম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি দিনে ৪০০ থেকে ৫০০ ডিম বিক্রি করি। সাধারণত ৩০০ ভালো ডিম বিক্রি হলে ২০০ ফাটা ডিম বিক্রি হয়। দাম বেড়ে যাওয়ার পর সংখ্যাটি উল্টে হয়ে যায়। ডিমের দাম শুনে ক্রেতারা ফাটা ডিমই কিনে নিতো। তখন দিনে ৩০০ ফাটা ডিম ও ২০০ ভালো ডিম বিক্রি হতো। এখন ডিমের দাম আবার কমে যাওয়ায় সংখ্যাটি ফিফটি-ফিফটি হয়ে গেছে।'

ফাটা ডিমের ক্রেতারা সাধারণত সঙ্গে করে নিয়ে আসা বাটিতে কিংবা পলিথিনে করে ডিম ভেঙে নিয়ে যান।

'ফকিন্নি বাজার' থেকে নিয়মিত কেনাকাটা করেন নাসিমা বেগম (৩০)। তার স্বামী রিকশাচালক।

তিনি ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'আমার ৩ সন্তানের মধ্যে ২ জন স্কুলে যায়। ৫ জনের পরিবার, ৩ হাজার টাকা দিয়ে রুম ভাড়া নিয়ে থাকি। মাছ, মাংসের দাম অনেক, সেগুলো আমাদের সাধ্যের বাইরে। আমরা নিয়মিত ডিম সেদ্ধ করে কেটে ২ ভাগ করে রান্না করে খাই। কিন্তু, ডিমের দাম বেড়ে যাওয়ার পর ফাটা ডিম খেতে হচ্ছে। ফাটা ডিম সেদ্ধ করে খাওয়া যায় না। ভাজি করে খেতে হয়।'

'বাটি নিয়ে দোকানে এলে দোকানি ডিম ফাটিয়ে বাটিতে দিয়ে দেয়। ফাটা ডিমে উপাদান কম থাকে। কিছু তরল পড়ে যায়। কখনো কখনো ডিমের শক্ত আবরণ তরলের সঙ্গে মিশে যায়। প্রায়ই খেতে বসে মুখের ভেতর ডিমের খোসা টের পাই। কিন্তু, কী করব? ১০ টাকা করে ডিম কেনার অবস্থা আমাদের নেই', বলেন তিনি।

বাজারে বিক্রি হয় ‘ফাটা ডিম’ও। ছবি: স্টার

ডিমের দাম কমলেও নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক দামের কারণে ফাটা ডিমই কিনতে হচ্ছে বলে জানান রোজিনা বেগম (৩৪)। তার স্বামী একটি টেইলার্সের দোকানে কাজ করেন।

তিনি বলেন, 'আমার ৪ সন্তান। আগে আমার স্বামী প্রতিদিন ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা আয় করত। এখন আয় অনেক কমে গেছে। দিনে ২০০ থেকে ৩০০ টাকার বেশি আয় করতে পারে না। আমার বাসা ভাড়া দিতে হয় সাড়ে ১৩ হাজার টাকা। নিরুপায় হয়ে আগামী মাস থেকে একটি রুম সাবলেট দিয়েছি। আমি নিজেও একটি দোকানের সেলসে কাজ নিয়েছি।'

'এই বাজারে কম দামে জিনিস পাওয়া যায়। কিন্তু, ১০০ টাকার বেশি খরচ করার অবস্থা আমার নেই। তাই কাটা সবজি, ফাটা ডিম এগুলো খেয়েই থাকতে হচ্ছে', বলেন তিনি।

Comments

The Daily Star  | English
Bangladesh to buy boeing planes and wheat

Reducing US trade GAP: Dhaka turns to Boeing, wheat imports

Bangladeshi officials are preparing for a third round of talks in Washington next week

12h ago