ইরানের পারমাণবিক বোমা তৈরিতে এনপিটি চুক্তিই কি একমাত্র বাধা

প্রতীকী ছবি

ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে চলমান যুদ্ধের মধ্যে ইরান জানিয়েছে, তারা পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ চুক্তি-এনপিটি থেকে সরে যাওয়ার বিষয়ে পার্লামেন্টে একটি বিল আনার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

সোমবার দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র এসমাঈল বাঘাঈ এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, 'সাম্প্রতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় আমরা একটি উপযুক্ত সিদ্ধান্ত নেব।' তিনি জানান, প্রস্তাবটি এখনো খসড়া পর্যায়ে রয়েছে এবং পরবর্তী ধাপে সংসদের সঙ্গে সমন্বয় করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

এর আগে ইসরায়েল ইরানের একাধিক পরমাণু ও সামরিক স্থাপনায় নজিরবিহীন হামলা চালায়, যাতে শীর্ষ পর্যায়ের বিজ্ঞানী ও সামরিক কর্মকর্তারা নিহত হন। পাল্টা জবাবে ইরানও ইসরায়েলের বিভিন্ন অঞ্চলে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালিয়েছে। এ পর্যন্ত ইসরায়েলের হামলায় ইরানে নিহতের সংখ্যা ২২০ ছাড়িয়েছে, যাদের মধ্যে ৭০ জন নারী ও শিশু। ইরানের হামলায় ইসরায়েলে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ২০ জন।

এই উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে এনপিটি থেকে সরে যাওয়ার হুমকি ইরানের পারমাণবিক ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।

এনপিটি কী?

পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ চুক্তি বা এনপিটি হলো একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি, যার মূল লক্ষ্য হলো পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্তার রোধ এবং শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে পারমাণবিক প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করা।
১৯৬৮ সালের ১ জুলাই এটি স্বাক্ষরের জন্য উন্মুক্ত করা হয় এবং ১৯৭০ সালের ৫ মার্চ কার্যকর হয়।

চুক্তি অনুযায়ী—

  • পারমাণবিক অস্ত্রধারী দেশগুলো অস্ত্র হস্তান্তর বা অন্য দেশকে তা বানাতে সহায়তা করতে পারবে না।
  • যেসব দেশে পারমাণবিক অস্ত্র নেই, তারা তা অর্জনের চেষ্টা করতে পারবে না।
  • পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারে প্রতিটি দেশ অধিকারী থাকবে— তবে আন্তর্জাতিক পারমাণবিক সংস্থার তত্ত্বাবধানে।
  • কোনো দেশ চাইলে 'অনিবার্য পরিস্থিতিতে' তিন মাসের নোটিশে এনপিটি থেকে সরে যেতে পারে।

বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স—এই পাঁচটি দেশকে চুক্তির আওতায় স্বীকৃত পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র হিসেবে ধরা হয়।

ইরান কেন সরে যাওয়ার কথা বলছে?

ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসউদ পেজেশকিয়ান জানিয়েছেন, দেশটির পরমাণু কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ গবেষণা ও বিদ্যুৎ উৎপাদনেই সীমাবদ্ধ এবং এনপিটির নীতিমালার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তিনি আরও বলেন, সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনির একটি ধর্মীয় নির্দেশ অনুযায়ী গণবিধ্বংসী অস্ত্র ব্যবহার ইসলামবিরোধী।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বাঘাঈ বলেন, 'এই অঞ্চলে একমাত্র পারমাণবিক অস্ত্রধারী রাষ্ট্র হলো ইসরায়েল। অথচ তারাই ইরানের বিরুদ্ধে অস্ত্র নির্মাণের অভিযোগ তুলছে।'

ওয়াশিংটনভিত্তিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ সংস্থা আর্মস কনট্রোল অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক কেলসি ড্যাভেনপোর্ট বলেন, 'ইসরায়েলি হামলা ইরানের ভেতরে এই বিতর্ক উসকে দিচ্ছে—ভবিষ্যতের হামলা ঠেকাতে কি এখন পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করা প্রয়োজন?'

তিনি আরও বলেন, 'ইরান যদি এনপিটি থেকে সরে যায়, তবে এটি হবে একটি শক্ত বার্তা যে, তারা অস্ত্র নির্মাণের চিন্তাভাবনা করছে।'

যদিও এনপিটি থেকে সরে যাওয়া মানেই পারমাণবিক অস্ত্র বানানো নয়, তবে এটি আইএইএ-এর তত্ত্বাবধান থেকে সরে আসার পথ খুলে দেবে। এতে ইরানের প্রকৃত পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে সন্দেহ বাড়বে এবং মধ্যপ্রাচ্যে অস্ত্র প্রতিযোগিতা শুরু হতে পারে।

ড্যাভেনপোর্ট সতর্ক করে বলেন, 'ইরান যদি এনপিটি থেকে বেরিয়ে গিয়ে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করে, তাহলে অন্য দেশগুলোর মধ্যেও একই পথে হাঁটার প্রবণতা দেখা দিতে পারে।'

তিনি এনপিটিকে 'পারমাণবিক বিস্তার রোধের গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি' হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, এই চুক্তি অকার্যকর হয়ে গেলে অনেক বড় ধরনের অস্থিতিশীলতা তৈরি হবে।

তার মতে, এখনো কূটনৈতিক সমাধানের সুযোগ আছে। আইএইএর পরিদর্শকদের ফিরিয়ে এনে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করা জরুরি।

সেই সঙ্গে, ইরানকে চুক্তিতে রাখার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে কৌশলগতভাবে কাজ করতে হবে বলেও মত দেন তিনি।

এনপিটিতে কারা আছে, কারা নেই?

২০২৫ সাল পর্যন্ত ১৯১টি দেশ এনপিটির সদস্য। এটি বিশ্বে অন্যতম বিস্তৃত অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তি। তবে ভারত, পাকিস্তান, ইসরায়েল ও উত্তর কোরিয়া চুক্তিতে স্বাক্ষর করেনি। এর মধ্যে উত্তর কোরিয়া একসময় এনপিটিতে থাকলেও ২০০৩ সালে সরে যায়।

ভারত দীর্ঘদিন ধরে এনপিটিকে 'বৈষম্যমূলক ও অসম' বলে প্রত্যাখ্যান করে আসছে। তাদের যুক্তি, এই চুক্তি একটি নির্দিষ্ট তারিখের আগে পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণকারী দেশগুলোকে স্বীকৃতি দিলেও অন্যদের জন্য তা নিষিদ্ধ করেছে।

এদিকে, সম্প্রতি আইএইএ ইরানের বিরুদ্ধে যে নিন্দা প্রস্তাব পাস করেছে, তেহরান বলছে তা ইসরায়েলি হামলার পথ সুগম করেছে। মুখপাত্র বাঘাঈ বলেন, 'যারা ওই প্রস্তাবে ভোট দিয়েছে, তারাই ইসরায়েলের হামলার পথ তৈরি করেছে।'

ইরান এনপিটি থেকে সরে যাওয়ার হুমকি দিলেও এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে চুক্তি থেকে সরে গেলে পুরো অঞ্চলজুড়ে পারমাণবিক উত্তেজনা বাড়তে পারে। পরমাণু অস্ত্রের বিস্তার রোধে এখনো কূটনীতি ও সংলাপকেই সবচেয়ে কার্যকর পথ বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

Comments

The Daily Star  | English

Khaleda Zia’s janaza held

The namaz-e-janaza of BNP Chairperson Khaleda Zia was held at the South Plaza of the Jatiya Sangsad Bhaban today

6h ago