নেপালে আন্দোলন ‘হাইজ্যাকের’ অভিযোগ তরুণদের

কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ অস্থিরতার কবলে পড়েছে নেপাল। দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির বিরুদ্ধে শুরু হওয়া বিক্ষোভ থেকে কেপি শর্মা অলির সরকারের পতন হয়েছে। সংসদ ভবনে অগ্নিসংযোগ এবং বিভিন্ন সরকারি স্থাপনায় হামলার পর অস্থির হয়ে উঠেছে হিমালয়ের এই দেশটি। সহিংসতা ঠেকাতে দেশজুড়ে কারফিউ জারি করেছে সেনাবাহিনী।
তবে আন্দোলনের সূচনাকারী 'জেন জি' বা তরুণ প্রজন্ম এই সহিংসতার দায় নিতে নারাজ। তাদের দাবি, 'সুবিধাবাদী' অনুপ্রবেশকারীরা তাদের আন্দোলনকে 'হাইজ্যাক' করে ভিন্ন পথে নিয়েছে। এই ধ্বংসযজ্ঞের দায় তারা নেবে না বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে বিবিসি।
বুধবার রাজধানী কাঠমান্ডুর পরিস্থিতি শান্ত থাকলেও বিভিন্ন ভবন থেকে ধোঁয়া উড়তে দেখা গেছে। রাস্তায় রাস্তায় পড়ে আছে পুড়ে যাওয়া যানবাহনের ধ্বংসাবশেষ।
সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত দেশজুড়ে কারফিউ বলবৎ থাকবে। সহিংসতা ও ভাঙচুরের সঙ্গে জড়িতদের কঠোর শাস্তির হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে। এখন পর্যন্ত সহিংসতা ও লুটপাটের অভিযোগে ২৭ জনকে গ্রেপ্তার এবং ৩১টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে সেনাবাহিনী।
সোমবার পুলিশ-বিক্ষোভকারী সংঘর্ষে ১৯ জনের মৃত্যুর পর বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে নেপাল। এর পরদিনই ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন প্রধানমন্ত্রী। নিহতের সংখ্যা এখন ২০ ছাড়িয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলির পদত্যাগের পর দেশটিতে নেতৃত্বের সংকট তৈরি হয়েছে। তার জায়গায় কে আসছেন বা ভবিষ্যতে কী ঘটবে, তা নিয়ে গভীর অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।

আন্দোলন 'হাইজ্যাকড'
আন্দোলনে সামনের সারিতে থাকা তরুণরা আশঙ্কা করছেন, অনুপ্রবেশকারীরা তাদের আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করেছে।
তাদের পক্ষ থেকে দেওয়া এক বিবৃতিতে বলা হয়, 'নেপালের জেনারেশন জি স্বচ্ছতা, জবাবদিহি এবং দুর্নীতির অবসানের মতো সুস্পষ্ট লক্ষ্য নিয়ে এই আন্দোলন শুরু করেছিল। আমাদের আন্দোলন অহিংস ও শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত।'
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, তারা দায়িত্বশীলতার সঙ্গে নাগরিকদের সুরক্ষা দিতে এবং সরকারি সম্পত্তি রক্ষা করতে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে মাঠে কাজ করছেন। বুধবার থেকে তাদের নতুন কোনো বিক্ষোভের কর্মসূচি নেই বলেও তারা উল্লেখ করেছেন এবং প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে কারফিউ কার্যকর করতে সেনাবাহিনী ও পুলিশকে আহ্বান জানিয়েছেন।
বিবৃতিতে বলা হয়, 'সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা ব্যাহত করা বা আমাদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে অন্যের দ্বারা অপব্যবহার হতে দেওয়া কখনোই আমাদের উদ্দেশ্য ছিল না।'
একই অভিযোগ করেছে সেনাবাহিনীও। সেনাবাহিনীর মুখপাত্র রাজারাম বাসনেট বিবিসিকে বলেন, 'বিভিন্ন ব্যক্তি ও নৈরাজ্যবাদী গোষ্ঠী' বিক্ষোভে অনুপ্রবেশ করে সরকারি-বেসরকারি সম্পত্তিতে হামলা চালিয়েছে। আমরা মূলত সেই সব ব্যক্তিকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছি, যারা পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও বিভিন্ন সহিংস ঘটনা ঘটাচ্ছে।

বিক্ষোভের নেপথ্যে কী?
গত সপ্তাহে হোয়াটসঅ্যাপ, ইনস্টাগ্রাম ও ফেসবুকসহ ২৬টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিষিদ্ধ করার সরকারি সিদ্ধান্তের পর নেপালে বিক্ষোভের সূত্রপাত হয়। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, তরুণদের বিক্ষোভের পেছনে ছিল নেপালের রাজনৈতিক অভিজাতদের বিরুদ্ধে জমা হওয়া গভীর অসন্তোষ। সামাজিক মাধ্যম নিষিদ্ধ করার পর তাতে বিস্ফোরণ ঘটে।
এই নিষেধাজ্ঞার কয়েক সপ্তাহ আগে থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে 'নেপো কিড' হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করে রাজনীতিবিদদের সন্তানদের বিলাসবহুল জীবনযাপন এবং দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে ব্যাপক প্রচারণা চলছিল। আন্দোলনের মুখে সোমবার রাতে সরকার তড়িঘড়ি করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলেও ততক্ষণে আন্দোলন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।
মঙ্গলবার বিক্ষোভকারীরা কাঠমান্ডুতে ক্ষমতাসীন জোটের শরিক দল নেপালি কংগ্রেস পার্টির সদর দপ্তর এবং দলের নেতা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শের বাহাদুর দেওবার বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। শত শত বিক্ষোভকারী সংসদ ভবনে ঢুকে ভাঙচুর করে এবং দেয়ালে দুর্নীতিবিরোধী স্লোগান লিখে আগুন ধরিয়ে দেয়।
আগুনে আদালত ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় সব মামলার শুনানি অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করেছে সুপ্রিম কোর্ট।
তরুণ বিক্ষোভকারীরা তাদের বিবৃতিতে ভবিষ্যতের রূপরেখা দিয়ে বলেছে, 'আমরা এমন একটি স্বচ্ছ ও স্থিতিশীল সরকার চাই, যা দুর্নীতিবাজ ব্যক্তি বা রাজনৈতিক অভিজাতদের স্বার্থে নয়, বরং জনগণের স্বার্থে কাজ করবে। আমাদের লক্ষ্য পরিষ্কার: যোগ্য এবং দুর্নীতিমুক্ত নেতাদের নিয়ে একটি সঠিক সরকার গঠন করা।'
Comments