গাজায় ইসরায়েল ‘গণহত্যা’ চালাচ্ছে: জাতিসংঘের তদন্ত দল

জাতিসংঘের তদন্ত দল ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গাজায় 'গণহত্যা' চালানোর অভিযোগ এনেছেন। তারা বলেছেন, 'ফিলিস্তিনিদের ধ্বংস' করার উদ্দেশ্যেই এই গণহত্যা চালানো হচ্ছে। এই কর্মকাণ্ডে উসকানি দেওয়ার জন্য তারা ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্য শীর্ষ কর্মকর্তাদের দায়ী করেছেন।
জাতিসংঘের স্বাধীন আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিশনের (সিওআই) প্রধান নাভি পিল্লাই বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেন, 'গাজায় গণহত্যা সংঘটিত হচ্ছে এবং তা এখনো চলছে।' তিনি আরও বলেন, 'এর দায় ইসরায়েল রাষ্ট্রের।'
গাজার দুই বছর ধরে চলমান ইসরায়েলি ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে মানবাধিকার পরিস্থিতি তদন্তের দায়িত্বপ্রাপ্ত এই কমিশন এই প্রতিবেদন দিল।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে ঢুকে হামাস হামলা চালানোর পর এই যুদ্ধ শুরু হয়। দুই বছরে সেখানে প্রায় ৬৫ হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন। জাতিসংঘ এই পরিসংখ্যানকে নির্ভরযোগ্য বলে মনে করে। গাজার বেশিরভাগ মানুষ অন্তত একবার বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। বর্তমানে ইসরায়েল গাজা সিটি দখলের প্রচেষ্টা জোরদার করায় নতুন করে ব্যাপক বাস্তুচ্যুতি ঘটছে। সেখানে পুরোদমে দুর্ভিক্ষ চলছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ।
সিওআইয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ ও তাদের বাহিনী ১৯৪৮ সালের গণহত্যা সনদে উল্লেখিত পাঁচটি গণহত্যামূলক কাজের মধ্যে চারটি করেছে। এগুলো হলো—কোনো গোষ্ঠীর সদস্যদের হত্যা করা; গোষ্ঠীর সদস্যদের গুরুতর শারীরিক বা মানসিক ক্ষতিসাধন করা; ইচ্ছাকৃতভাবে এমন পরিস্থিতি তৈরি করা, যা গোষ্ঠীটিকে আংশিক বা পুরোপুরি ধ্বংস করে দেয় এবং গোষ্ঠীর মধ্যে জন্মহার রোধ করার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া।
ধ্বংস করাই উদ্দেশ্য
তদন্তকারীরা বলেছেন, ইসরায়েলের বেসামরিক ও সামরিক কর্তৃপক্ষের সুস্পষ্ট বক্তব্য এবং ইসরায়েলি বাহিনীর আচরণের ধরন থেকে এটা স্পষ্ট যে, 'ফিলিস্তিনিদের একটি গোষ্ঠী হিসেবে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যেই' এই গণহত্যা চালানো হয়েছে।
প্রতিবেদনে এই উপসংহার টানা হয়েছে যে ইসরায়েলের প্রেসিডেন্ট আইজ্যাক হারজগ, প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এবং সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট গণহত্যায় উসকানি দিয়েছেন এবং ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ এই উসকানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বা তাদের শাস্তি দিতে ব্যর্থ হয়েছে।
৮৩ বছর বয়সী পিল্লাই প্রতিবেদনে বলেন, 'এই নৃশংস অপরাধের দায় ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের সর্বোচ্চ স্তরের ওপর বর্তায়।'
দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক এই বিচারক একসময় রুয়ান্ডা বিষয়ক আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের প্রধান এবং জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।
এএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়, এই কমিশন কোনো আইনি সংস্থা না হলেও, এর প্রতিবেদন কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টি করতে পারে এবং আদালতের জন্য প্রমাণ সংগ্রহে সহায়ক হতে পারে। পিল্লাই বলেন, কমিশন আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) প্রসিকিউটরের সঙ্গে সহযোগিতা করছে। তিনি বলেন, 'আমরা তাদের সঙ্গে হাজারো তথ্য শেয়ার করেছি।'
নীরবতা সম্মতির শামিল
নিজের চূড়ান্ত প্রতিবেদন উপস্থাপন করে পিল্লাই জোর দিয়ে বলেন, 'গাজায় ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের চালানো গণহত্যার বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় চুপ থাকতে পারে না।' তিনি সতর্ক করে বলেন, 'এটি থামাতে কোনো পদক্ষেপ না নেওয়াটা এতে জড়িত থাকারই নামান্তর।'
যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা, জাতিসংঘের স্বাধীন বিশেষজ্ঞ এবং আন্তর্জাতিক আদালতের পক্ষ থেকে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ তোলা হয়েছে। তবে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ বরাবরই সব অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে।
জাতিসংঘ নিজে গাজার পরিস্থিতিকে এখানো গণহত্যা হিসেবে চিহ্নিত করেনি। তবে সংস্থাটির ত্রাণবিষয়ক প্রধান গত মে মাসে বিশ্বনেতাদের 'গণহত্যা প্রতিরোধে জোরালোভাবে কাজ করার' আহ্বান জানিয়েছিলেন। গত সপ্তাহে জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান ইসরায়েলের 'গণহত্যামূলক বাগাড়ম্বর'-এর নিন্দা করেন।
গত বছরের জানুয়ারিতে আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে) ইসরায়েলকে গাজায় 'গণহত্যা' বন্ধ করার নির্দেশ দেয়। এর চার মাস পর, আইসিসি সম্ভাব্য যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য নেতানিয়াহু এবং গ্যালান্টের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে।
এই পদক্ষেপে ক্ষুব্ধ হয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন গত মাসে আইসিসির দুজন বিচারক ও দুজন প্রসিকিউটরের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে তাদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা এবং সে দেশে থাকা তাদের সম্পদ জব্দ করার উদ্যোগ নিয়েছে।
Comments