‘রাজনীতিবিদরা ধনী হয় আর আমরা কষ্টে থাকি, তাই সরকার পতন ঘটাতে রাস্তায় নেমেছিলাম’

মাত্র ৪৮ ঘণ্টারও কম সময়ে নেপালের সরকার পতন ঘটিয়েছে দেশটির তরুণ প্রজন্ম—'জেন জি' আন্দোলনকারীরা। দীর্ঘদিনের দুর্বল শাসন, দুর্নীতি এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপব্যবহারের বিরুদ্ধে এটি ছিল এক সর্বাত্মক প্রতিবাদ। কিন্তু এই আকস্মিক বিজয়ের মূল্য দিতে হয়েছে অনেক, যার ক্ষত এখনো দগদগে।
নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডু জুড়ে পোড়া চিহ্ন। পার্লামেন্ট ভবন 'সিংহ দরবার'-এর বিশাল থামগুলো পুড়ে কালো হয়ে গেছে। ক্ষমতার 'অটল' আসনে থাকা সাবেক প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলির বাড়িও ধ্বংসস্তূপ। অলি কোথায় লুকিয়ে আছেন তাও অজানা। এই ধ্বংসাবশেষগুলো নেপালের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় তরুণদের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিক্ষোভে অংশ নেওয়া তনুজা পান্ডে বিবিসিকে গত সপ্তাহে বলেন, 'আমরা যা করেছি তা নিয়ে আমরা গর্বিত। কিন্তু এর সঙ্গে মিশে আছে মানসিক ট্রমা, ক্ষোভ আর অনুশোচনাও।'
হিমালয়ান ছোট এই দেশটিতে সরকারবিরোধী বিক্ষোভে এখন পর্যন্ত ৭৪ জন নিহত হওয়ার ঘটনা গত কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী অস্থিরতা।
এই বিক্ষোভকে নেপালের বর্তমান রাজনৈতিক শ্রেণির বিরুদ্ধে 'দশকের পর দশক ধরে চলা দুর্বল শাসনব্যবস্থা ও রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপব্যবহারের প্রতি একধরনের সর্বাত্মক প্রত্যাখ্যান' হিসেবে বর্ণনা করেছেন ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের সিনিয়র উপদেষ্টা আশীষ প্রধান।
তিনি বলেন, সরকারি সেবাখাতে ক্ষয়ক্ষতি ২০১৫ সালের ভূমিকম্পের প্রভাবের কারণে যে অবস্থা হয়েছিল সেরকম হতে পারে। ওই ভূমিকম্পে প্রায় ৯ হাজার মানুষ মারা গিয়েছিল।
বিক্ষোভে ধ্বংসযজ্ঞ কেবল রাজধানী কাঠমান্ডুতেই সীমাবদ্ধ নয়, নেপালের অন্তত ৩০০ স্থানীয় সরকারের কার্যালয়ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
কাঠমান্ডু পোস্টের হিসাব অনুসারে, আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াতে পারে ৩ ট্রিলিয়ন নেপালি রুপি বা ২১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারে। যা দেশের মোট জিডিপির প্রায় অর্ধেক। গণমাধ্যমটির নিজস্ব অফিসও হামলার আগুন থেকে রক্ষা পায়নি।
'নেপো কিডস'
৮ সেপ্টেম্বরের রক্তক্ষয়ী বিক্ষোভের দু'দিন আগে, ২৪ বছর বয়সী পরিবেশকর্মী তনুজা পান্ডে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি ভিডিও আপলোড করেন। ভিডিওটিতে নেপালের চুরে অঞ্চলের একটি খনি সাইট দেখানো হয়। তিনি লেখেন, 'নেপালের সম্পদ জনগণের হওয়া উচিত, "রাজনীতিবিদদের প্রাইভেট কোম্পানির" নয়। তিনি তার সমবয়সীদের দুর্নীতি ও দেশের সম্পদের অপব্যবহারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের ডাক দেন।
এশিয়ার অনেক যুব আন্দোলনের মতো, নেপালের 'জেন জি' বিক্ষোভও ছিল নেতৃত্বহীন। নেপাল সরকার ২৬টি সামাজিক মাধ্যম প্ল্যাটফর্ম বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর তনুজার মতো আরও অনেকেই একই ধরনের আন্দোলনের ডাক দেন।
নেপালে গত কয়েক মাস ধরে নেপো কিডসদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ জমে উঠেছিল। এই 'নেপো কিডস'রা বিভিন্ন প্রভাবশালী রাজনীতিকদের সন্তান যাদের বিরুদ্ধে সামাজিক মাধ্যমে তাদের অপ্রদর্শিত সম্পদ দেখানোর অভিযোগ আছে।
সবচেয়ে বেশি ভাইরাল হওয়া ছবিগুলোর মধ্যে একটিতে দেখা যায়, প্রাদেশিক একজন মন্ত্রীর ছেলে সৌগত থাপা— লুই ভিটোন, গুচি এবং কার্টিয়ারের মতো বিলাসবহুল ব্র্যান্ডের বক্স দিয়ে তৈরি একটি ক্রিসমাস ট্রির পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। সমালোচনার জবাবে তিনি বলেন, 'এটি অযৌক্তিক ভুল ব্যাখ্যা'। তার বাবা 'জনসেবার মাধ্যমে উপার্জিত প্রতিটি পয়সা সমাজে ফিরিয়ে দিয়েছেন'।
তনুজা প্রায় সব নেপো কিডসের কন্টেন্টই দেখেছেন। একটি ভিডিও তার মনে গভীরভাবে দাগ কাটে। ভিডিওটিতে একটি রাজনৈতিক পরিবারের বিলাসবহুল জীবনের সঙ্গে একজন সাধারণ তরুণ নেপালির জীবনের তুলনা দেখানো হয়েছিল। যিনি জীবিকার সন্ধানে উপসাগরীয় কোনো দেশে যেতে বাধ্য হয়েছেন।
তিনি বলেন, 'এই দৃশ্য দেখা অত্যন্ত কষ্টের। বিশেষ করে যখন জানি, শিক্ষিত তরুণরাও দেশ ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে, কারণ এখানে মজুরি এতটাই কম যে মর্যাদার সঙ্গে বাঁচা যায় না।'
নেপালে গণতন্ত্রের বয়স খুব একটা বেশি না। দীর্ঘ মাওবাদী-নেতৃত্বাধীন গৃহযুদ্ধের পর ২০০৮ সালে এটি প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়। গৃহযুদ্ধে ১৭ হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছিল।
তবে দেশটিতে প্রতিশ্রুত স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধি বাস্তবে আসেনি। ১৭ বছরে নেপালে ১৪টি সরকার এসেছে এবং কোনো নেতাই পূর্ণ পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষ করতে পারেনি। দেশটির রাজনীতি অনেকটা 'মিউজিক্যাল চেয়ার' খেলার মতো, যেখানে কমিউনিস্ট পার্টি এবং মধ্যপন্থী নেপালি কংগ্রেস পালাক্রমে শাসন করে। জেন জি বিক্ষোভে পদত্যাগ করা কে পি শর্মা অলিসহ তিনজন নেতাও একাধিকবার ক্ষমতায় থেকেছেন।
নেপালের মাথাপিছু জিডিপি ১,৫০০ ডলারের নিচে। দক্ষিণ এশিয়ায় দারিদ্রের দিক থেকে এটি আফগানিস্তানের পরেই। প্রায় ১৪ শতাংশ মানুষ বিদেশে কাজ করে এবং প্রতি তিনটি পরিবারের মধ্যে একটি পরিবার রেমিট্যান্সের ওপর নির্ভরশীল।
তনুজা পান্ডে পূর্ব নেপালের একটি মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে এসেছেন। তার বাবা একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি শিক্ষক। তিন বছর আগে তার মস্তিষ্কে টিউমার ধরা পড়ে, যার চিকিৎসা এখনো চলছে। চিকিৎসার ব্যয়ের চাপ তার পরিবারকে প্রায় দেউলিয়া করে দিয়েছিল। পরিবারের সাহায্যে তার বড় বোন অস্ট্রেলিয়ায় চলে যান।
বিক্ষোভের আগে, তনুজা অন্যদের সাথে মিলে অহিংসা ও পারষ্পরিক শ্রদ্ধার উপর জোর দিয়ে কিছু নির্দেশনা তৈরি করেছিলেন এবং অংশগ্রহণকারীদের "অন্তর্ঘাতকারীদের" বিরুদ্ধে সতর্ক থাকতে বলেছিলেন।
৮ সেপ্টেম্বরের সকালে, তিনি কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে কাঠমান্ডুর কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত বিশাল ট্রাফিক আইল্যান্ড, মৈতিঘর মণ্ডলায় পৌঁছান। তিনি ভেবেছিলেন, সর্বোচ্চ কয়েক হাজার মানুষ আসবে – কিন্তু ভিড় ক্রমশ বাড়তে থাকে।
২৬ বছর বয়সী বিক্ষোভকারী আকৃতি ঘিমিরে বলেন, শুরুতে সবকিছু শান্তিপূর্ণ ও স্বাভাবিক ছিল। 'আমরা সবাই বসেছিলাম, পুরোনো নেপালি গান গাইছিলাম। স্লোগান এবং সবকিছু এত মজার ছিল যে আমরা উপভোগ করছিলাম। এর পর আমরা হাঁটতে শুরু করি। পুলিশও সেখানে ছিল যাতে কোনো যানবাহন আমাদের পথে বাধা না হয়।'
দুপুরের দিকে পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করে। তনুজা ও আকৃতি দুজনেই লক্ষ্য করেন ভিড় পার্লামেন্টের কাছে নিউ বানেশ্বরের দিকে এগোতে শুরু করেছে। তারা দুজনেই দেখেন যে কিছু মানুষ মোটরসাইকেলে করে আসছে এবং তাদের বয়স জেন জি- দের তুলনায় বেশি।
আকৃতির বিশ্বাস, তারা অনুপ্রবেশকারী। 'শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারী—যারা সত্যিই কোনো লক্ষ্য নিয়ে এসেছিল—তাদের থেকে সহিংসতা করার উদ্দেশ্য নিয়ে আসা লোকদের আলাদা করা আমাদের জন্য খুব কঠিন হয়ে পড়ে।'
যখন কিছু বিক্ষোভকারী পার্লামেন্টের নিরাপত্তা বেষ্টনী ভাঙার চেষ্টা করে, তখন পুলিশ টিয়ার গ্যাস, জলকামান এবং গুলি ছোড়ে। প্রমাণ রয়েছে যে সেখানে লাইভ রাউন্ড ব্যবহার করা হয়েছিল এবং অভিযোগ আছে স্কুলশিক্ষার্থীদের দিকেও গুলি চালানো হয়েছে। এ ঘটনার তদন্ত চলছে।
পরের দিন পরিস্থিতি আরও বিশৃঙ্খল ও সহিংস হয়ে ওঠে। বিক্ষোভকারীরা পাল্টা হামলায় পার্লামেন্ট, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এবং অন্যান্য সরকারি ভবনে আগুন দেয়। সেদিন ঘরে বসেই অনলাইনে সব ঘটনা দেখছিলেন তনুজা ও আকৃতি।
রাজনৈতিক নেতাদের বাড়িঘরে হামলার কথা উল্লেখ করে আকৃতি বলেন, 'অনেকেই তখন বলছিল অবশেষে রাজনীতিবিদদের তাদের কাজের ফল ভোগ করতে দেখে খুব ভালো লাগছে।' তবে অল্প সময়ের মধ্যেই সেই উচ্ছ্বাস ভয় ও অন্ধকারে রূপ নেয়।
তনুজা বলেন, 'আমি পেট্রোল ভর্তি বোতল হাতে লোক দেখেছি। তারা সেগুলো মোটরসাইকেল থেকে বের করছিল। এরপর তারা পার্লামেন্টে হামলা শুরু করে।'
আইন বিভাগের এই স্নাতক সুপ্রিম কোর্টে আগুন লাগার দৃশ্য দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি বলেন, এটি তার কাছে 'মন্দিরের' মতো পবিত্র ছিল। ঘটনাস্থলে থাকা তার বন্ধুরা আগুন নেভানোর চেষ্টা করছিল, কিন্তু তাদের এই চেষ্টা যে ব্যর্থ হবে তা তারা সবাই জানত। তবুও নিজেদের সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য তারা এটি করেছিল।
'মানুষ বলছে যারা আগুন লাগিয়েছে তাদের উদ্দেশ্যই ছিল এসব পুড়িয়ে দেওয়া... এই লোকগুলো কারা? ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, এসব লোকের মুখে মুখোশ পরা।'
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সেনাবাহিনী মোতায়েন করার পর কিছুটা শান্তি ফিরে আসে। কয়েক দিনের জন্য কারফিউ জারি করা হয়। ওই সপ্তাহের শেষের দিকে সাবেক প্রধান বিচারপতি সুশীলা কার্কিকে অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। বিক্ষোভকারীরা তাকে এই পদে সমর্থন জানিয়েছিল।
তনুজা আশা করেন, সুশীলা কার্কি দক্ষতার সঙ্গে দেশ পরিচালনা করবেন, নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন এবং জনগণের হাতে ক্ষমতা তুলে দিতে পারবেন।
কিন্তু নেপালের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ রয়েই গেছে।
কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়া বিশেষজ্ঞ রুমেলা সেন বলেন, সেনাবাহিনীকে "শান্তি ও স্থিতিশীলতার কণ্ঠস্বর" হিসেবে নজিরবিহীনভাবে প্রশংসা করা "উদ্বেগজনক"।
এ ছাড়া সেনাবাহিনীর আমন্ত্রণে আলোচনার প্রাথমিক ধাপে দুর্গা প্রসাইয়ের সম্পৃক্ততাতেও অনেকেই অস্বস্তি বোধ করছেন। গত মার্চে সহিংস রাজতন্ত্রপন্থী বিক্ষোভে অংশ নেওয়ার অভিযোগে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। পরে তিনি ভারতে পালিয়ে গেলেও নেপালে ফিরিয়ে আনা হয়। তার সম্পৃক্ততার প্রতিবাদে জেন জি আন্দোলনকারীরা আলোচনা থেকে সরে দাঁড়ান।
২৩ বছরের ছেলে যোগেন্দ্রকে বিক্ষোভে হারিয়েছেন তার বাবা যুবরাজ নিউপানে। তিনি বলেন, 'আমরা আমাদের ছেলেকে হারিয়েছি। এই শোক সইবার নয়। এখনো জানি না ঠিক কীভাবে তার মৃত্যু হয়েছে।'
ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পার্লামেন্ট ভবনের কাছে মাথায় পেছন দিকে গুলি লেগেছিল যোগেন্দ্রের।
দক্ষিণ-পূর্ব নেপালে বসবাসরত এই পরিবারের বড় ছেলে যোগেন্দ্র পড়াশোনার জন্য কাঠমান্ডুতে এসেছিলেন। তার স্বপ্ন ছিল সরকারি কর্মকর্তা হওয়ার। তার বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনরা জানায়, সে সবসময় পড়াশোনার মধ্যেই ডুবে থাকত।
কিন্তু ৮ সেপ্টেম্বর দেশের পরিবর্তন আনার স্বপ্ন নিয়ে সে তার বন্ধুদের সাথে বিক্ষোভে যোগ দিয়েছিল। পরিস্থিতি উত্তপ্ত হতে শুরু করার পর যখন সে তার পরিবারকে ফোন করে, তখনই কেবল তারা জানতে পারেন যে সে সেখানে ছিল।
যোগেন্দ্রের চাচা সৌভাগ্য বলেন, 'আমাদের প্রিয়জনেরা পরিবর্তনের ডাক দিতে গিয়ে জীবন দিল। তাদের রক্ত ও আত্মত্যাগকে স্বীকৃতি দিতে হবে, যেন ভবিষ্যতে অন্য তরুণদের আর রাস্তায় নামতে না হয়।'
তনুজা পান্ডে বলেন, তার প্রজন্মের জন্য এটি একটি রাজনৈতিক জাগরণ।
তনুজা বলেন, 'আমরা আর চুপ থাকব না বা অন্যায় মেনে নেব না। এটি কেবল একটা হালকা ধাক্কা নয়, বরং এটি এমন এক ব্যবস্থার প্রতি সাহসী চ্যালেঞ্জ, যা দশকের পর দশক ধরে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রেখেছে।'
Comments