এবার নেতানিয়াহুর ‘নেতানিয়াহু’ কে হবেন?

প্রবাদে আছে—ইতিহাস ফিরে ফিরে আসে। এটি ৩০ বা ৩২ বছর আগের ঘটনা। ১৯৯৩-১৯৯৫ সালের। তখন বিশ্ববাসী দেখছিলেন ইসরায়েলের দখলদারিত্বে থাকা অগ্নিগর্ভ ফিলিস্তিনে শান্তির সমূহ সম্ভাবনা। সেদিনের সেই আলোচনার মঞ্চে পাদপ্রদীপের আলোয় উদ্ভাসিত হয়েছিলেন ইসরায়েলের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইৎজাক রাবিন। আর এর বিরোধিতা করেছিলেন দেশটির বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। এবার পাদপ্রদীপের আলোয় ভাসছেন নেতানিয়াহু। কিন্তু, তার বিরোধিতায় থাকছেন কে?
এ নিয়েই আজকের আলোচনা। শিরোনামটা হয়ত অনেকের কাছে অবোধ্য। বিশেষ করে, তরুণদের কাছে। তারা এখনকার বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে চেনেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে। তিনি দেশটির ইতিহাসে দীর্ঘতম প্রধানমন্ত্রী। মূল আলোচনায় যাওয়ার আগে একটু দেখে নেওয়া যাক নেতানিয়াহুর অতীত।
ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার এক বছর পর তথা ১৯৪৯ সালে নেতানিয়াহু তেল আবিবে জন্ম নিলেও বেড়ে ওঠেন যুক্তরাষ্ট্রে। ১৯৬৭ সালে ইসরায়েলে ফিরে তিনি দেশটির প্রতিরক্ষা বাহিনীতে যোগ দেন। তারপর ১৯৭২ সালে আবার ফিরে যান যুক্তরাষ্ট্রে।
এরপর, ১৯৭৮ সালে ইসরায়েলে ফিরে নেতানিয়াহু যোগ দেন এক সন্ত্রাসবিরোধী গবেষণা প্রতিষ্ঠানে। ১৯৮৪ সাল থেকে ১৯৮৮ পর্যন্ত জাতিসংঘে ইসরায়েলের রাষ্ট্রদূত হিসেবে কাজ করেন নেতানিয়াহু। সেসময় তাকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ ইহুদি ধর্মগুরু মন্তব্য করেছিলেন—'তুমিই হবে ইসরায়েলের উদ্ধারকর্তা'।
সেই ধর্মগুরুর 'বরে' বলিয়ান হয়ে নেতানিয়াহু দেশে ফিরে হাল ধরেন লিকুদ পার্টির। ১৯৭৩ সালে এই ডানপন্থি দলটি প্রতিষ্ঠিত হয় ব্রিটিশ সরকারের চোখে 'কুখ্যাত সন্ত্রাসী নেতা' হিসেবে পরিচিত মেনাখেম বেগিন ও বিশ্ববাসীর কাছে 'বৈরুতের কসাই' হিসেবে পরিচিত এরিয়েল শ্যারনের হাতে। তারা দুজনই বিভিন্ন মেয়াদে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। লিকুদ পার্টি বা ন্যাশনাল লিবারেল মুভমেন্ট ছিল মূলত কয়েকটি ছোট ছোট ডানপন্থি দলের জোট।

যাহোক, ১৯৯৩ সালে লিকুদ পার্টির প্রধান হয়ে নেতানিয়াহু জাতীয় নির্বাচনে লড়েন। বিজয়ী না হলেও তিনি বিরোধীদলের নেতা হিসেবে বেশ আলোচনায় আসেন। সেসময় মধ্যপ্রাচ্যে চলছিল পরিবর্তনের হাওয়া। পিএলও প্রধান ইয়াসির আরাফাতের নেতৃত্বে ফিলিস্তিনিদের স্বাধীন রাষ্ট্র এক অমোঘ বাস্তবতার দিকে যাচ্ছিল।
সেই বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে নরওয়ের রাজধানী অসলোয় চলছিল মধ্যপ্রাচ্য শান্তি আলোচনা। প্রথম অসলো চুক্তির আলোচনায় অংশ নিয়েছিলেন ইসরায়েলের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী শিমন পেরেস ও ফিলিস্তিনের মাহমুদ আব্বাস। দুই পক্ষের সফল আলোচনার পর ১৯৯৩ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর হোয়াইট হাউসের সবুজ চত্বরে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের উপস্থিতিতে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের শীর্ষ নেতারা প্রথম অসলো চুক্তিতে সই করেন। শুধু বলে রাখা—দ্বিতীয় অসলো চুক্তি হয়েছিল ১৯৯৫ সালে।
সেই অসলো চুক্তির চরম বিরোধিতা করে উগ্র ডানপন্থি ইসরায়েলিদের অবিসংবাদিত নেতা হয়ে ওঠেন বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু।
ঘটনার ঠিক ২০ বছর পর ব্রিটিশ গণমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনের শিরোনাম করা হয়—'এখন এটা পরিষ্কার: নেতানিয়াহুর বিরোধিতায় অসলো চুক্তি ভেঙে পড়েছিল'। এতে বলা হয়, ভালো-মন্দ মিলিয়ে অসলো চুক্তি ছিল একটি ঐতিহাসিক ঘটনা যা ফিলিস্তিনে ইহুদি ও আরবদের শতবর্ষের সংঘাত নিরসনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বাস্তবসম্মত উদ্যোগ। এটি ছিল ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনিদের সংঘাত দূর করার জন্য এই দুই জাতির মধ্যে প্রথম শান্তি চুক্তি।
বিশ্লেষকদের অনেকে এমনকি, প্রখ্যাত চিন্তাবিদ এডওয়ার্ড সাঈদ এই চুক্তির মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের পরাজয় হয়েছে বলে মন্তব্য করেছিলেন। অর্থাৎ, এই চুক্তির মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের নিজস্ব জমিতে ভিনদেশি ইহুদিদের বসবাসের অধিকারকে মেনে নেওয়া হয়েছিল। এর মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের ভূখণ্ড ইহুদিদের সঙ্গে ভাগাভাগির 'চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত'র নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছিল।

তাতেও নাখোশ ছিলেন ইসরায়েলের তৎকালীন বিরোধীদলের নেতা বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। প্রথম অসলো চুক্তির বিরোধিতা তিনি এমন পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন যে তা সইয়ের দুই বছরের মধ্যে এক উগ্রবাদীর গুলিতে প্রাণ হারান তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইৎজাক রাবিন।
রাবিন হত্যাকাণ্ডের ২৩ বছর পর এক স্মরণসভায় প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু বলেছিলেন, দেশের অর্ধেকের বেশি মানুষ অসলো চুক্তির বিরোধিতা করেছিলেন। তাই রাবিনের মৃত্যুর জন্য চুক্তি-বিরোধীদের ঢালাওভাবে দায়ী করা ঠিক নয়। তাকে হত্যাকারীর প্রতি 'সহানুভূতিশীল' রাজনৈতিক নেতা হিসেবেও দেখেন অনেকে।
নেতানিয়াহুর 'নেতানিয়াহু'
এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না নেতানিয়াহুর তীব্র বিরোধিতায় অসলো চুক্তি কার্যকর হতে পারেনি। রাবিন হত্যাকাণ্ড সেই চুক্তিকে বিস্মৃতির গহ্বরে পাঠিয়ে দিয়েছিল। যে নেতানিয়াহু শান্তির বিরোধিতা করেন সেই নেতানিয়াহুর ওপর গত ২৯ সেপ্টেম্বর গাজা পরিকল্পনা 'চাপিয়ে' দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের ভূখণ্ডে হামাসের রক্তক্ষয়ী হামলার পর গাজাকে আক্ষরিক অর্থে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেন নেতানিয়াহু। গত দুই বছর ধরে সেখান চালিয়ে যাচ্ছেন নিকৃষ্টতম গণহত্যা। বেঁচে থাকা মানুষদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছেন দুর্ভিক্ষ। তাতেও থামতে রাজি নন তিনি। যুদ্ধাপরাধীর সমন নিয়ে ঘুরছেন, তবুও গাজা যুদ্ধ চালিয়ে যেতে অনড় তিনি।

এমন পরিস্থিতিতে নেতানিয়াহুকে 'গিলতে' হচ্ছে ট্রাম্পের গাজা পরিকল্পনা।
গত রোববার রয়টার্সের এক প্রতিবেদনের শিরোনাম করা হয়—'ট্রাম্প চাপ দিচ্ছেন গাজা যুদ্ধ বন্ধে আর নেতানিয়াহু আছেন উগ্র ডানপন্থিদের চাপে'। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! যে নেতানিয়াহু প্রায় ৩২ বছর আগে ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে অসলো শান্তিচুক্তির বিরোধিতা করে রাজনৈতিক ভিত্তি পেয়েছিলেন আজ তাকেই সহ্য করতে হচ্ছে গাজা শান্তিচুক্তি বিরোধীদের ক্ষোভ।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, গাজা যুদ্ধ বন্ধ নিয়ে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর উগ্র ডানপন্থি জোট সরকারের মধ্যে বিভেদ দেখা দিয়েছে। তারা মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে মার্কিন শান্তি পরিকল্পনাকে নস্যাৎ করার হুমকি দিয়েছেন।
একদিকে, ট্রাম্প চাপ দিচ্ছেন দুই বছরের গাজা যুদ্ধ শেষ করার। অন্যদিকে, সেই যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য নেতানিয়াহুকে চাপ দিচ্ছেন অতি-উগ্র ডানপন্থি জোট নেতারা। বিশেষ করে, জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী বেন-গভির ও অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মৎরিচ। মূলত তাদের সমর্থনের ওপর ভর করে নেতানিয়াহু যুদ্ধকালীন সরকার চালিয়ে যাচ্ছেন। যুদ্ধ বন্ধ হলে একদিকে যেমন থাকবে না যুদ্ধকালীন সরকার, অন্যদিকে সরকার থাকলেও সৃষ্টি হতে পারে নতুন রাজনৈতিক সংকট।

বিশ্লেষকদের মতে, ট্রাম্পের চাপে নেতানিয়াহু গাজা পরিকল্পনা গ্রহণ করতে বাধ্য হলে তা ইসরায়েলকে আগাম নির্বাচনের পথে ঠেলে দিতে পারে। সেসময় নেতানিয়াহুকে এই সব উগ্রবাদী নেতাদের মুখোমুখি হতে হবে। এখন দেখার বিষয়—কে হন নেতানিয়াহুর 'নেতানিয়াহু', যার কারণে ভেস্তে যেতে পারে ট্রাম্পের শান্তিচুক্তি।
এই ২০ দফা শান্তি পরিকল্পনাকে অনেকে ফিলিস্তিনিদের 'আত্মসমর্পণ' হিসেবে আখ্যা দিলেও বিবদমান পক্ষ হামাস সেই প্রস্তাব মেনে নিয়েছে। তবে কোনও 'অজুহাতে' তা অসলো চুক্তির ভাগ্য বরণ করে কিনা এখন তাও দেখার বিষয়।
Comments