এক্সপ্লেনার

‘টু স্টেট সলিউশন’ আসলে কী?

অসলো চুক্তিতে সই করার পর পিএলও চেয়ারম্যান ইয়াসির আরাফাতের সঙ্গে হাত মেলাচ্ছেন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী ইৎজাক রাবিন। তাদের মাঝে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন। ফাইল ছবি: রয়টার্স (১৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৩)
অসলো চুক্তিতে সই করার পর পিএলও চেয়ারম্যান ইয়াসির আরাফাতের সঙ্গে হাত মেলাচ্ছেন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী ইৎজাক রাবিন। তাদের মাঝে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন। ফাইল ছবি: রয়টার্স (১৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৩)

ঘটনাটি ঘটেছিল ১৯৯৩ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর। সেদিন ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের শীর্ষ নেতারা একে অপরের অস্তিত্ব আনুষ্ঠানিকভাবে মেনে নেন। স্বীকার করে নেন যে তারা পাশাপাশি পৃথক দুটি দেশ হিসেবে থাকবে। শান্তিপূর্ণ পরিবেশে একে অপরের সঙ্গে সহযোগিতামূলক আচরণ করবে। তারা দীর্ঘদিনের সংঘাতের অবসানের আহ্বানও জানান।

অর্থাৎ, পৃথিবীর মানচিত্রে ইসরায়েলের পাশাপাশি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ফিলিস্তিনও থাকবে।

এই চুক্তি বিশ্ব রাজনীতির ইতিহাসে অসলো চুক্তি হিসেবে খ্যাত। কেননা, নিরপেক্ষ স্থান হিসেবে নরওয়ের রাজধানী অসলোয় গোপন বৈঠকের মাধ্যমে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের নেতারা এমন সমঝোতায় পৌঁছেছিলেন। ১৯৯৩ সালের জানুয়ারিতে শুরু হয়েছিল সেই বৈঠক।

পরে, সেই বছরের ১৩ সেপ্টেম্বর বিশ্ববাসী দেখলো হোয়াইট হাউসের লবিতে এক আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠান। সেখানে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনকে মাঝখানে রেখে করমর্দন করেন ইসরায়েলের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইৎজাক রাবিন ও ফিলিস্তিনের অবিসংবাদিত নেতা ও প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের (পিএলও) প্রধান নেতা ইয়াসির আরাফাত।

অসলো শান্তি প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিতে একমত হয়েছিলেন এই দুই নেতা। সই করেছিলেন প্রথম অসলো চুক্তি।

প্রথম অসলো চুক্তির প্রায় দুই বছর পর ১৯৯৫ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর মিশরের পর্যটন শহর তাবায় দ্বিতীয় অসলো চুক্তি সই হয়। সেই চুক্তিতে শান্তি প্রক্রিয়া চালিয়ে নেওয়ার দিকনির্দেশনা ছিল।

এই দুই চুক্তির মাধ্যমে সিদ্ধান্ত হয় যে, ইসরায়েলের দখল করা ফিলিস্তিন ভূমির একটি অংশে ইসরায়েল রাষ্ট্র ও বাকি অংশে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন করা হবে। ভূমির বিনিময়ে শান্তি ফেরানোর নীতির ওপর ভিত্তি করে চুক্তির ধারাগুলো সাজানো হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে এই শান্তি প্রক্রিয়াকে সমর্থন দেয়। সবাই মিলে একমত হন যে পশ্চিম তীর ও গাজা উপত্যকা নিয়ে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠিত হবে। এই রাষ্ট্রের রাজধানী হবে পূর্ব জেরুসালেম। ১৯৬৭ সালে আরবদের সঙ্গে ছয় দিনের যুদ্ধে ইসরায়েল এসব এলাকা দখল করে নেয়।

অসলো চুক্তির মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখার স্বীকৃতি হিসেবে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী ইৎজাক রাবিন ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী শিমন পেরেস এবং পিএলও নেতা ইয়াসির আরাফাতকে পরের বছর নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয়।

তবে দ্বিতীয় অসলো চুক্তিতে সই দেওয়ার অল্প কিছুদিন পরই আততায়ীর হাতে নিহত হন রাবিন। ১৯৯৫ সালের ৪ নভেম্বর তেল আবিবে ইগাল আমির নামের এক ডানপন্থি ইহুদি শিক্ষার্থী তাকে হত্যা করেন। আইন বিষয়ের শিক্ষার্থী আমিরের মত, রাবিনের অবলম্বন করা নীতি ইহুদিদের ভূখণ্ড ও নিরাপত্তার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার সামিল।

সে সময় ইসরায়েলের বিরোধী দল লিকুদ পার্টির প্রধান ছিলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। তিনিও রাবিনের নীতির, বিশেষত, দুই রাষ্ট্র সমাধানের কড়া সমালোচনা করেন। তিনি জনসম্মুখে বেশ কয়েকবার রাবিনের বিরোধিতা করে উস্কানিমূলক বক্তব্য দেন। অসলো-চুক্তি বিরোধী কফিন মিছিলের আয়োজনও করেন তিনি।  

অসলো চুক্তির প্রতিবাদে কফিন মিছিলের আয়োজন করেন নেতানিয়াহু। ফাইল ছবি: সংগৃহীত
অসলো চুক্তির প্রতিবাদে কফিন মিছিলের আয়োজন করেন নেতানিয়াহু। ফাইল ছবি: সংগৃহীত

বিশ্লেষকদের মত, নেতানিয়াহুর কট্টর অবস্থান আততায়ী আমিরকে 'চরম পদক্ষেপ' নিতে প্রভাবিত করেছিল।

এখনের বাস্তবতা হচ্ছে—অসলো চুক্তির পরও দেশ দুইটির মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। দুই দেশের জনগণের একাংশ এই চুক্তির বিরোধিতা করায় গত ৩২ বছর ধরে এর বাস্তবায়ন অধরাই থেকে গেছে।

চুক্তি পরবর্তী ইসরায়েলের সরকারগুলো দুই দেশ সমাধাননীতি বাস্তবায়নে প্রথমে গড়িমসি এবং পরে অস্বীকার করে। সেই দেশের সরকারগুলো ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের অস্তিত্ব স্বীকার করছে না। তারা দখলকৃত পুরো অঞ্চলেই ইসরায়েলের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। শুধু তাই নয় এখন মিশর থেকে ইরাক পর্যন্ত বিস্তৃত ভূমিতে 'বৃহত্তর ইসরায়েল' গড়ার কথা বলা হচ্ছে।

অন্যদিকে, ফিলিস্তিনি সংগঠন হামাস বলছে—তারা ১৯৬৭ সালের সীমান্তকে অস্থায়ী হিসেবে দেখে। তারা ইসরায়েল রাষ্ট্রের অস্তিত্ব মানে না এবং সেখান থেকে বিতাড়িত সব শরণার্থীর নিজ নিজ এলাকায় ফিরে যাওয়ার অধিকার চায়।

শুধু তাই নয়, তিন দশকের বেশি সময় আগে যে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় 'দুই রাষ্ট্র সমাধান' এসেছিল সেই যুক্তরাষ্ট্র এখনো ফিলিস্তিনকে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। বিপরীতে, অন্যান্য দেশের স্বীকৃতিতে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করছে এবং ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলের দমনপীড়ন এমনকি গণহত্যাকেও প্রশ্নাতীতভাবে সমর্থন করে যাচ্ছে।

এ ছাড়াও, নিরাপত্তা পরিষদে চলমান গাজা যুদ্ধ বন্ধের প্রস্তাবও ক্রমাগত ভেটো দিয়ে খারিজ করে দিচ্ছে ওয়াশিংটন ডিসি।

বর্তমান মার্কিন প্রশাসনের নানা রকম হুমকি উপেক্ষা করে অতিসম্প্রতি দুই পরাশক্তি যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স মধ্যপ্রাচ্যে স্বাধীন দেশ হিসেবে ফিলিস্তিনের অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে। ইউরোপের এই দেশ দুইটি পৃথক ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন রাষ্ট্র সৃষ্টির মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার কথা বলছে।

মূলত অসলো চুক্তি সই করার পর থেকে 'দুই রাষ্ট্র সমাধান' ভাবনাটি বিশ্বব্যাপী পরিচিতি লাভ করে। ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েল জাতিসংঘে স্বীকৃত হলেও সেসময় ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। তাই এখন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান খোঁজা হচ্ছে।

Comments