যে হামলায় বদলে গেছে মধ্যপ্রাচ্যের সমীকরণ

বাংলার মানুষের কাছে বেহুলা-লখিন্দরের উপকথা মূলত অপ্রতিরোধ্য প্রেমের বাণী বহন করে। এখানে প্রসঙ্গটি টানা হচ্ছে শুধুমাত্র চান সওদাগরের নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থার কথা বিবেচনায় নিয়ে। লোহার প্রাচীরও ভেদ করা যায়—এমন বার্তাও যেন দেয় এই গল্পকাহিনী।
গাজায় ইসরায়েলের সীমানাকে অভেদ্য 'লোহার' প্রাচীরের সঙ্গে তুলনা করলে হয়ত অত্যুক্তি হবে না। আধুনিক সমরবিজ্ঞানের ইতিহাসে ইসরায়েলের এই সীমান্ত নিরাপত্তাকে উদাহরণ হিসেবে ধরা হয়। সমরবিদদের অনেকে রসিকতা করে বলতেন, 'এই সীমানা দিয়ে পাখি উড়ে যাওয়ার আগেও কয়েকবার ভাবে'। কিন্তু, বাংলার লোককথা তা যেন আবারও প্রমাণ করলো—পৃথিবীতে অভেদ্য বলে কিছু নেই।
আজকের আলোচনা একটি হামলার ঘটনাকে নিয়ে; যে হামলায় বদলে গেছে মধ্যপ্রাচ্যের সমীকরণ। হামলাটি চালিয়েছিল ফিলিস্তিনের সশস্ত্র সংগঠন হামাস ও এর সহযোগীরা। আজ থেকে ঠিক দুই বছর আগে। সেদিন ইসরায়েলের কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভেঙে হামাসের সদস্যরা রক্তক্ষয়ী হামলা চালিয়েছিল অবিশ্বাস্য রণকৌশল দেখিয়ে। তারা গিয়েছিলেন গাজা থেকে—জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে। এই গাজাকেই ইসরায়েল অভেদ্য অবরোধের লৌহ কারাগারে পরিণত করে রেখেছে বছরের পর বছর ধরে।
সেদিন দক্ষিণ ইসরায়েলের গাজা সীমান্তের কাছাকাছি এলাকাগুলোয় হামাসের ধ্বংসযজ্ঞ দেখে বিশ্ববাসী বিস্মিত ও স্তম্ভিত হয়েছিলেন। অনেকের মনে প্রশ্ন জেগেছিল—কীভাবে সম্ভব হলো ইসরায়েলের সীমানা ভেদ করা? সেই হামলায় ইসরায়েলের দুর্বলতা প্রকাশ্যে আসে। যে দেশটিকে সবাই 'অজেয়' ভাবেন সেই দেশটির বুকে হামাস এঁকে দেয় বিভীষিকার 'পদচিহ্ন'। এরপরের ঘটনাপ্রবাহ সবার জানা।

হামাস নির্মূলের কথা বলে ইসরায়েল গাজায় ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। হামাসের গণহত্যার প্রতিশোধে তারাও গাজায় গণহত্যা চালায়। হামাস ইসরায়েলে হামলা চালিয়ে হত্যা করেছে অন্তত ১২ শ জনকে আর এর বিপরীতে ইসরায়েল গাজায় হত্যা করেছে অন্তত ৬৭ হাজার মানুষ। তাদের অধিকাংশই শিশু ও নারী।
বদলে যাওয়া সমীকরণ
গাজা যুদ্ধ শুধু গাজাতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। মুহূর্তেই সেই যুদ্ধের আগুন ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে। তা রূপ নেয় এক আঞ্চলিক যুদ্ধের। ইসরায়েলে হামাসের হামলার প্রতি সমর্থন জানানোর পাশাপাশি নিরীহ গাজাবাসীর ওপর আগ্রাসন বন্ধের দাবি জানিয়ে তেল আবিবের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগ দেয় লেবাননের হিজবুল্লাহ ও ইয়েমেনের হুতি সম্প্রদায়।
গাজায় নির্মম গণহত্যা চালানোর পাশাপাশি অধিকৃত পশ্চিমতীরে ফিলিস্তিনিদের ওপর হত্যাযজ্ঞ চালাতে শুরু করে ইসরায়েলি বাহিনী। সেখানে সঙ্গে নেয় সশস্ত্র সেটেলারদের। শুধু তাই নয়, হিজবুল্লাহ ও হুতিদের লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ইসরায়েল। পরিণামে ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলকে 'বসবাসের অযোগ্য' করে তোলো হিজবুল্লাহ এবং লোহিত সাগরকে 'চলাচলে অনিরাপদ' করে তোলে হুতিরা।
এই সংগঠনভিত্তিক সংঘাত আরও বিস্তৃত হয়। হামাস ও হিজবুল্লাহর শীর্ষ নেতাদের অভিনব পন্থায় হত্যার পর আরও বেশি আগ্রাসী হয়ে ওঠে ইসরায়েল। লেবানন ও ইয়েমেনের মতো সিরিয়াও হয়ে ওঠে ইসরায়েলের রণক্ষেত্র। তাতেও ক্ষান্ত হন না দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। নির্দেশ দেন হামাস-হিজবুল্লাহ-হুতিদের মূল সমর্থক ইরানের ওপর হামলার।
নেতানিয়াহুর বেপরোয়া মনোভাবের ফলে বিশ্ববাসী দেখলো এক নতুন বাস্তবতা। 'বাঘ এলো' গল্পের মতো একদিন সবাই দেখলেন ইসরায়েল থেকে ক্ষেপণাস্ত্র এসে পড়ছে ইরানের শহরগুলোয় আবার ইরান থেকে ক্ষেপণাস্ত্র ছুটছে ইসরায়েলের দিকে। মধ্যপ্রাচ্যে এই দুই বিবদমান দেশকে নিয়ে গত প্রায় অর্ধ শতাব্দী ধরে উত্তেজনা চলছিল। সরাসরি হামলার মাধ্যমে সব আতঙ্ক 'দূর' হয়ে তা এক নতুন বাস্তবতায় গিয়ে পৌঁছায়।
গাজা যুদ্ধ যখন ইসরায়েল-ইরান যুদ্ধের রূপ নেয় তখন সেই যুদ্ধে যোগ দেয় যুক্তরাষ্ট্র। এমন ঘটনা একদিকে অপ্রত্যাশিত, অন্যদিকে ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। ইরানের পরমাণুবিজ্ঞানী, গবেষক, সামরিক নেতা ও শিল্পী-খেলোড়ারসহ এক হাজারের বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়। আবার ইরানের আঘাতে ক্ষয়ক্ষতি হয় ইসরায়েলেরও।

যে ইসরায়েলকে 'ধরা যায়, ছোঁয়া যায় না' সেই ইসরায়েলকেও মোকাবিলা করতে হয়েছে বিরোধীদের মারণাস্ত্র। যারা ইসরায়েলকে বসবাসের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ ভেবেছিলেন তাদেরকেও বুঝে নিয়ে হয়েছে দখলদারিত্ব কখনই নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা দিতে পারে না।
নিজ দেশে প্রবল জনবিরোধিতা সত্ত্বেও নেতানিয়াহু নতুন নতুন অ্যাডভেঞ্চারে বিশ্ববাসীকে মুগ্ধ করতে পারেন—ভক্তদের এমন স্তুতিবাক্যে 'স্ফীত' হয়ে সমস্ত বাস্তবতাকে তুচ্ছ জ্ঞান করে ইসরায়েলি বাহিনী হামলা করে বসে কাতারের রাজধানী দোহায়। উদ্দেশ্য—হামাসের বর্তমান নেতৃত্বকে নিকেশ করা। 'অহংকার পতনের মূল'—বাংলা প্রবাদটির পূর্ণ বাস্তবায়ন দেখা গেল দোহা হামলা ব্যর্থ হওয়ার পর। হামলার পরপরই নেতানিয়াহু সদর্পে ঘোষণা দিয়ে বসলেন যে তিনিই সে হামলার নির্দেশ দিয়েছেন। পরে সেই হামলার জন্য তাকে 'জবাবদিহিতা'র পাশাপাশি 'গিলতে' হয় ট্রাম্পের গাজা পরিকল্পনা, যা তার রাজনৈতিক অস্তিত্বকে ভয়ানক হুমকির মুখে ফেলেছে।
সারাবিশ্ব জানে কাতারে মার্কিন বাহিনীর বড় ঘাঁটি আছে আর হোয়াইট হাউস ইসরায়েলের হামলাকে প্রতিহত তো করলই না এমনকি, সময়মতো তথ্য দিয়েও জানাতে পারলো না। যুক্তরাষ্ট্রের এমন আচরণকে 'বিশ্বাসঘাতকতা' বলে আখ্যা দিতে থাকেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। টনক নড়ে মধ্যপ্রাচ্যের ধনী দেশগুলোসহ প্রভাবশালী মুসলিম দেশগুলোরও।
আজ থেকে ঠিক দুই বছর আগে হামাসের হামলার মাধ্যমে এই সমীকরণ ঘটেছে যে মধ্যপ্রাচ্যে আক্ষরিক অর্থে কেউই নিরাপদ নয়। নিজ নিজ দেশের নিরাপত্তায় শুধু বিদেশি নয়, বিশ্বের শীর্ষ পরাশক্তিকে ভাড়া করে এনেও নিরাপদে থাকা সম্ভব নয়। হামাসের সেই ধ্বংসাত্মক হামলায় প্রমাণিত হলো—ফিলিস্তিন রাষ্ট্র একটি বাস্তবতা, যা অস্বীকার করার উপায় নেই। সেই হামলায় প্রমাণিত হলো—হামাসের বিরোধিতা করেও ইসরায়েলের হামলা থেকে রক্ষা পাওয়ার নিশ্চয়তা নেই।

এই হামলায় আরও প্রমাণিত হলো—জায়নবাদীদের শতবর্ষী 'বৃহত্তর ইসরায়েল' গঠনের প্রচেষ্টা আটকানোর এখনই শ্রেষ্ঠ সময়। সেই বৃহত্তর ইসরায়েলের সীমানা ধরা হয়েছে মিশর থেকে ইরাক পর্যন্ত। এই হামলার মাধ্যমে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো—মধ্যপ্রাচ্যে কেউ ইসরায়েলের বন্ধু নয়।
ঘৃণার আরেক নাম যেন ইসরায়েল
ইসরায়েলের বাইরে বসবাস করেও যারা দেশটিকে আপন মনে করেন তারাও পড়েছেন বিপাকে। কেননা, তারা দেখছেন যে তাদের আপন দেশ গণহত্যা চালাচ্ছে। তাদের আপন দেশের নেতা আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ে গণহত্যাকারী। তাদের আপন দেশের কর্মকাণ্ড দেশে দেশে ধিক্কৃত। তাদের আপন দেশের নেতা দেশে দেশে ঘৃণিত। তাদের আপন দেশের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখাতে লাখো মানুষের সমাবেশ হয়। তাদের আপন দেশের কথা প্রকাশ্যে বলা যায় না।

তারা আরও দেখছেন যে দিকে দিকে ইসরায়েল বর্জনের ডাক উঠেছে। ইসরায়েলের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃবৃন্দ যাই ভাবুক না কেন দেশটির অধিকাংশ অধিবাসী এখন ইসরায়েলকে যুক্তরাষ্ট্রের বাড়তি অর্থ ও সামরিক সহায়তা দেওয়ার বিরোধী। দ্য নিউইয়র্ক টাইমস ও সিয়েনা ইউনিভার্সিটির জরিপে দেখা গেছে—যুক্তরাষ্ট্রে ইসরায়েলবিরোধী মনোভাব সর্বকালের সর্বোচ্চ।
শুধু তাই নয়, যে ব্রিটেনের হাতে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে জোরপূর্বক ইসরায়েলকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সেই ব্রিটেনকে নিজ দেশের বাসিন্দাদের প্রবল চাপে পড়ে বলতে হয়েছে—'ফিলিস্তিন স্বাধীন রাষ্ট্র'। অপর পরাশক্তি ফ্রান্সও স্বীকৃতি দেয় ফিলিস্তিনকে। প্রভাবশালী স্পেন আটকে দেয় ইসরায়েলগামী মার্কিন অস্ত্রের চালান। নিজেকে ইসরায়েলের প্রভাবমুক্ত করার ঘোষণা দেয়। বাতিল করে অস্ত্র ও বাণিজ্য চুক্তি।
বিশ্বব্যাপী ইসরায়েল বিরোধিতা শুধুমাত্র রাজনীতির মধ্যে সীমিত নয়, তা শিল্প-সাহিত্য-খেলাধুলার অঙ্গনেও ঢেউ তুলেছে। ইসরায়েলি পণ্যের বাজার ছোট হয়ে আসছে বলেও প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যমে।
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো জানাচ্ছে—পৃথিবীতে যারা বিশ্বাস করেন ঘৃণার আরেক নাম ইসরায়েল, তাদের সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। আর এসব কিছু ঘটেছে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর।
Comments