যুদ্ধ শেষ হলে গাজার ভবিষ্যৎ কেমন হবে?

ইসরায়েল ও হামাস গাজায় যুদ্ধবিরতি চুক্তির প্রথম পর্যায় বাস্তবায়নে সম্মত হয়েছে বলে জানিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। যুদ্ধবিরতি আলোচনার প্রধান মধ্যস্থতাকারী কাতারও বিষয়টি নিশ্চিত করে জানায়, যুদ্ধবিরতি পরিকল্পনার প্রথম ধাপের 'সমস্ত শর্ত ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া' নিয়ে সমঝোতা হয়েছে।
এক বিবৃতিতে হামাস বলেছে, তারা এমন এক 'চুক্তি সম্পন্ন করেছে, যাতে গাজায় যুদ্ধের অবসান, দখলদার বাহিনীর প্রত্যাহার, মানবিক সহায়তা প্রবেশ এবং বন্দি বিনিময়ে'র বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। অন্যদিকে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, তিনি বৃহস্পতিবার মন্ত্রিসভার বৈঠক ডেকে গাজা যুদ্ধবিরতি চুক্তি অনুমোদনের প্রস্তাব তুলবেন।
যুদ্ধে ইসরায়েল অন্তত ৬৭ হাজার ১৬০ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে। ইসরায়েলি হামলায় আহত হয়েছেন এক লাখ ৬৯ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি। ধ্বংসস্তূপের নিচে এখনও অসংখ্য মরদেহ চাপা পড়ে আছে।
জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞ ও ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব জেনোসাইড স্কলার্স ইসরায়েলের হত্যাযজ্ঞকে গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। তারা বলেছে, ইসরায়েল গাজার হাসপাতাল, বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভিন্ন এলাকা মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছে। ৯০ শতাংশ ভবন ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে ইসরায়েল যুদ্ধ শেষ করলেও গাজা উপত্যকা অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে।
গাজা পুনর্গঠন
গাজার ফিলিস্তিনিরা স্থায়ী যুদ্ধবিরতির আশায় রয়েছেন। তবে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পরও তারা নিজেদের শহর, গ্রাম পুনর্গঠনের দীর্ঘ ও জটিল পথেই থাকবেন। আর তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরাও হবে কষ্টকর।
জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, গাজা পুনর্গঠনের জন্য ৫০ বিলিয়ন ডলারের বেশি খরচ হবে। আর পুরো উপত্যকাকে পুনরায় বাসযোগ্য করতে কমপক্ষে ১৫ বছর সময় লাগতে পারে।
যদি ইসরায়েলের অবৈধ অবরোধ বড় সমস্যা না করে, তাহলেই গাজা পুনর্গঠন সম্ভব। অবশ্য ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের ২০১৭ সালের প্রতিবেদন বলছে, এর আগে ছোট ছোট যুদ্ধের পরও ইসরায়েলি অবরোধ গাজা পুনর্গঠনকে অনেক কঠিন করেছে।
দোহায় অবস্থানরত গাজা বিশেষজ্ঞ আজমি কেশাউই আল জাজিরাকে বলেছেন, যুদ্ধোত্তর যেকোনো পরিকল্পনায় ইসরায়েলের ওপর আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক চাপ থাকা আবশ্যক, যাতে নির্মাণ সামগ্রী প্রবেশ করতে পারে।
ফিলিস্তিনিরা তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে। তবে এই বিশেষজ্ঞ বলছেন, 'কেবল তাদের ইচ্ছা থাকাটাই যথেষ্ট নয়… এটি কেবল তাদের ওপরই নির্ভর করে না।'
দলীয় সংঘাত, অস্থিরতা
ট্রাম্পের পরিকল্পনার একটি শর্ত হলো— হামাসকে ক্ষমতা ছাড়তে হবে। তবে গাজার ভবিষ্যতের জন্য পুনর্গঠন গুরুত্বপূর্ণ হলেও ভয় রয়েছে যে, হামাস ক্ষমতা ছাড়লে উপত্যকাটি অরাজকতা ও সংঘাতে জড়িয়ে পড়তে পারে।
গাজাভিত্তিক সাংবাদিক ইয়াসের আল-বানা বলছিলেন, 'গাজায় হামাস সরকারের একটি সুবিধা হলো তারা নিরাপত্তা বজায় রাখে।'
গাজায় গণহত্যা চালানোর সময় ইসরায়েল স্বেচ্ছায় গাজার নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের হত্যা করেছে। এ ছাড়া বিভিন্ন কুখ্যাত গোষ্ঠীকে সমর্থন দিয়েছে। এসব গোষ্ঠী ত্রাণ চুরি করে নিয়ে বিক্রির মাধ্যমে সর্বোচ্চ লাভ তুলে নিয়েছে।
যদিও গোষ্ঠীগুলো এখন সমস্যা তৈরি করছে, তবে কেশাওয়ি মনে করেন, ইসরায়েল গাজা ছাড়লে তারা টিকে থাকবে না। কারণ ফিলিস্তিনি সমাজ এমন লোকেদের উপেক্ষা করবে যারা অধিকাংশের চোখে বিশ্বাসঘাতক।
তবে দলীয় সংঘাত, বিশেষ করে ফাতাহ ও হামাসের মধ্যে সংঘাত সমস্যার কারণ হতে পারে বলে তিনি সতর্ক করেন।
আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণ ফাতাহর হাতে। আর গাজা নিয়ন্ত্রণ করে হামাস। ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে গোষ্ঠীটি অনেকাংশেই দুর্বল হয়ে পড়েছে।
২০০৬ সালে হামাস নির্বাচনে জিতে গেলে ফাতাহর সঙ্গে বিরোধ চূড়ান্ত রূপ নেয়। এই দুই গোষ্ঠীর মধ্যে দ্বন্দ্বের সূচনা ১৯৯৩ সালের অসলো চুক্তির সময় থেকে।
হামাস তাদের প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই ইসরায়েলকে স্বীকার করেনি এবং সশস্ত্র প্রতিরোধ ত্যাগ করেনি। ফলস্বরূপ গোষ্ঠীটি যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলোর চোখে 'সন্ত্রাসী সংগঠন' হিসেবে চিহ্নিত হয়।
হামাসকে নির্মূল করতে যুক্তরাষ্ট্র ফাতাহকে সমর্থন দেয়, যা পরিস্থিতিকে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয়। ২০০৭ সালের জুনে হামাস ফাতাহকে উৎখাত করে। এতে ফিলিস্তিনি জাতীয় আন্দোলনের মধ্যে বিভাজন স্থায়ী হয়ে যায়।
কেশাওয়ির মতে, আঞ্চলিক দেশগুলো ও সম্ভবত ইসরায়েলের সমর্থনে নির্বাসিত ফাতাহ নেতাদের কেউ কেউ ফিরে এলে, তারা হামাস ও তাদের মিত্রদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে পারেন।
তিনি বলেন, 'ইসরায়েল যদি নির্বাসিত কয়েকজন ফাতাহ নেতাকে গাজায় ফিরতে দেয়, তারা হামাস সমর্থকদের ওপর প্রতিশোধ নিতে পারেন।'
দীর্ঘস্থায়ী ট্রমা
গাজায় থাকতে বাধ্য ফিলিস্তিনিদের মানসিক ট্রমার সঙ্গে লড়তে হবে। ইসরায়েলি হামলায় তারা পরিবার, বন্ধু, বাড়ি আর ভবিষ্যৎ সব হারিয়েছেন। এসব ক্ষতি মেনে নেওয়ার বা শোক প্রকাশ করার জন্যও তাদের সময় হয়নি। গাজার ফিলিস্তিনিদের লড়াই কেবল শারীরিক নয়, মানসিকভাবেও অত্যন্ত কঠিন।
যুদ্ধ শুরুর আগে ২০২২ সালে সেভ দ্য চিলড্রেনের এক সমীক্ষায় দেখা যায়, গাজার পাঁচটি শিশুর মধ্যে চারটিই অবসাদ, শোক ও ভয়ের মধ্যে জীবন যাপন করছে।
ডক্টরস উইদাউট বর্ডারস (এমএসএফ) জানায়, গাজার ফিলিস্তিনিদের ওপর চালানো এই গণহত্যার কারণে যে সামষ্টিক ট্রমা এসেছে, তা অতীতের সাধারণ যুদ্ধ বা বিপর্যয়ের চেয়ে অনেক গভীর ও ভয়ঙ্কর।
গত বছর জর্দানের আম্মানে এমএসএফের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ আহমদ মাহমুদ আল-সালেম গাজার শিশুদের চিকিৎসা দেন। তিনি দেখেন, বেশিরভাগ শিশু জীবনধারণ করছে জ্বলজ্বলে দুঃস্বপ্ন, অবসাদ ও অনিদ্রার মধ্যে।
লন্ডনের ইনস্টিটিউট অব সাইকিয়াট্রির সিনিয়র লেকচারার ডেরেক সামারফিল্ড আল জাজিরাকে বলেন, 'গাজার শিশুরা যে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তা কল্পনার বাইরে।'
তিনি উল্লেখ করেন, গাজার অন্তত ১৭ হাজার অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশুই এখন একা। তারা আর নিরাপদ ও সুন্দর পরিবেশে বাঁচতে পারবে কি না, সেটিও অনিশ্চিত।
ডেরেক বলেন, 'এই শিশুদের ভবিষ্যৎ শুধু তাদের ট্রমা কাটিয়ে ওঠার ওপরই নির্ভর করে না। তাদের ট্রমা এখনও চলমান।
'এটি নির্ভর করে চারপাশের সমাজের উপর। কিন্তু পুরো সমাজই ধ্বংস হয়ে গেছে, আর এ কারণেই এটিকে গণহত্যা বলা হচ্ছে।'
Comments