বিশ্লেষণ

‘আমেরিকা ফার্স্ট’ যেভাবে ‘ট্রাম্প ফার্স্ট’ হয়ে গেল

লস অ্যাঞ্জেলেস সিটি হলের বাইরে ট্রাম্পবিরোধী বিক্ষোভ। ছবি: রয়টার্স
লস অ্যাঞ্জেলেস সিটি হলের বাইরে ট্রাম্পবিরোধী বিক্ষোভ। ছবি: রয়টার্স

রিপাবলিকান পার্টির মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচনী প্রচারণায় ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছিলেন, তিনি আমেরিকার স্বার্থকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেবেন। স্লোগান তুলেছিলেন, 'আমেরিকা ফার্স্ট'। তার 'চতুরতা' বুঝতে না পেয়ে মার্কিনিরা রেকর্ড সংখ্যক ভোট দিয়ে ব্যবসায়ী ট্রাম্পকে নির্বাচিত করেন নিজেদের প্রেসিডেন্ট বা ভাগ্যবিধাতা হিসেবে।

কিন্তু, হোয়াইট হাউসে ঢোকার পর প্রকাশ পেতে শুরু করে ট্রাম্পের 'আসল চেহারা'। ওভাল অফিসে বসার বছরপূর্তি হতে না হতেই দেখা গেল 'আমেরিকা ফার্স্ট' হয়ে গেছে 'ট্রাম্প ফার্স্ট'।

গত ১৫ অক্টোবর সংবাদমাধ্যম সিএনএন'র এক প্রতিবেদনের শিরোনাম করা হয়—প্রেসিডেন্টের বিশ্বনেতা হওয়ার বাসনা 'আমেরিকা ফার্স্ট'কে 'ট্রাম্প ফার্স্ট' করে দিয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, গাজায় হামাসের অস্ত্র সমর্পণ নিয়ে ট্রাম্পের হুঁশিয়ারির অর্থ দাঁড়ায় সেখানে মার্কিন সেনা পাঠানোর ইচ্ছা, ভেনেজুয়েলায় মাদক ধ্বংসের অজুহাতে মার্কিন সেনাদের অভিযান; এমনকি, আর্জেন্টিনায় বিপাকে পড়া বন্ধু প্রেসিডেন্টকে ২০ বিলিয়ন ডলার আর্থিক সহায়তা দেওয়ার কথা বলে ঝুলিয়ে রাখা—এসবই ট্রাম্পের বিশ্বনেতা হওয়ার বাসনার বহিঃপ্রকাশ বৈকি।

এ দিকে, নিজ দেশে চলছে 'শাটডাউন'। তা কাটানোর কোনো হেলদোল নেই। উল্টো অর্থের অভাবে হাজার হাজার ফেডারেল কর্মীকে ছাঁটাইয়ের পক্ষে যুক্তি দিচ্ছেন তাদের অভিভাবক খোদ প্রেসিডেন্ট।

এ ছাড়াও, ইউক্রেন যুদ্ধকে আরও বেগবান করতে ট্রাম্প সেখানে টমাহক ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র পাঠানোর কথা প্রকাশ্যে বলছেন। এসব ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে রাশিয়ার ভেতরে হামলা করতে পারবে ইউক্রেন। এর মাধ্যমে যেন যুদ্ধকে আরও দীর্ঘ করতে চাচ্ছেন ট্রাম্প।

অর্থাৎ, নিজ দেশের ঝামেলা না মিটিয়ে ট্রাম্প বহির্বিশ্বে নিজের প্রভাব বিস্তারে বেশি ব্যস্ততা দেখাচ্ছেন। তার 'আমেরিকা ফার্স্ট' পরিণত হয়েছে 'ট্রাম্প ফার্স্ট'-এর অহমিকায়।

'রাজা চাই না'

ট্রাম্পের সেই অহমিকাকে ফ্যাসিজমের সঙ্গে তুলনা করছেন তার দেশের আমজনতা। এ নিয়ে অপর এক প্রতিবেদনে সিএনএন জানায়, 'রাজা চাই না' স্লোগানে মুখরিত আমেরিকার রাজপথ। সারাদেশে লাখো মানুষ পথে নেমেছেন ট্রাম্পবিরোধী প্রতিবাদ সমাবেশে।

কেন এত মানুষ পথে নেমেছেন তাও তুলে ধরা হয়েছে সেই সংবাদ প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়—পেগি কোল তার ৭০তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন করেছেন রাস্তায় নেমে, ট্রাম্পবিরোধী স্লোগানে-স্লোগানে। গতকাল শনিবার তিনি মিশিগানের এক দূরবর্তী শহর থেকে ১০ ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে ওয়াশিংটন ডিসিতে এসেছিলেন শুধু ট্রাম্পের বিরুদ্ধে স্লোগান তোলার আশায়।

যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় অঙ্গরাজ্যে ট্রাম্প-বিরোধী বিক্ষোভ। ছবি: এএফপি
যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় অঙ্গরাজ্যে ট্রাম্প-বিরোধী বিক্ষোভ। ছবি: এএফপি

তিনি নিজের তাড়না থেকে এই ট্রাম্পবিরোধী সমাবেশে যোগ দিয়েছেন। তিনি মনে করেন, আমেরিকার জনগণ ও গণতন্ত্রের জন্য 'ভয়ানক সময়' যাচ্ছে। তার ভাষ্য, 'মনে হচ্ছে ট্রাম্প আমাদের সরকার ও গণতন্ত্রকে খেয়ে ফেলছ। আমরা যদি চুপ করে বসে থাকি তাহলে তিনি রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে ধীরে ধীরে ধ্বংস করে ফেলবেন।'

গতকাল যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে ট্রাম্পবিরোধী ২৭ শর বেশি 'নো কিংস' সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছিল। তারা ডোনাল্ড ট্রাম্পের স্বৈরতান্ত্রিক ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন। গত জুনে এমন সমাবেশে প্রায় ৫০ লাখ মার্কিনি যোগ দিয়েছিলেন। সেসময় তারা ওয়াশিংটনে সেনাদের কুচকাওয়াজের প্রতিবাদ করেছিলেন।

আয়োজকদের বরাত দিয়ে সিএনএন-এর সংবাদ প্রতিবেদনে বলা হয়, গতকালের সমাবেশে প্রায় ৭০ লাখ মার্কিনি যোগ দিয়েছিলেন। শুধু নিউইয়র্কে যোগ দিয়েছিলেন এক লাখের বেশি মানুষ। বড় বড় শহরের পাশাপাশি ছোট ছোট শহরগুলোতেও মানুষ রাস্তায় নেমেছিলেন 'রাজা চাই না' প্ল্যাকার্ড-ব্যানার হাতে নিয়ে। ছিল ফ্যাসিবাদবিরোধী ফেস্টুনও। তারা কেন্দ্রীয় সরকারের অভিবাসননীতির তীব্র বিরোধিতা করে স্লোগান দেন। অভিবাসীদের ওপর দমনপীড়ণ বন্ধের আহ্বান জানান।

'আমেরিকা ফার্স্ট' থেকে 'ট্রাম্প ফার্স্ট'

ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যবহার করা 'আমেরিকার ফার্স্ট' স্লোগানটির মূল ভিত্তি ১৯৩০ দশকে। সেসময় যারা বলতেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের জড়ানো উচিত নয়, তারা এই স্লোগান দিতেন। বহু বহু দশক পর ট্রাম্পের সেই স্লোগানের ব্যবহার অনেককে মুগ্ধ করেছিল। তারা আশা করেছিলেন, বহির্বিশ্বে মার্কিন মাতব্বরির পেছনে যে পরিমাণ অর্থ খরচ হয় তা নিজ দেশের জনগণের কল্যাণে ব্যবহার করা হবে। কিন্তু, জনগণ চায় এক, আর তাদের নেতা চান আরেক।

বাস্তবতা হচ্ছে—ট্রাম্প হয়ত ইরাক বা আফগানিস্তানের মতো স্থল অভিযান পছন্দ করেন না কিন্তু, দূর থেকে ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে ইরানকে শায়েস্তা করতে তার আপত্তি নেই। এই 'যুদ্ধবিরোধী' নেতা ন্যাটো সদস্যদের চাপ দিচ্ছেন প্রতিরক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর জন্য। এসব তিনি করছেন রাষ্ট্রীয় নীতির বাইরে গিয়ে, নিজের পছন্দমাফিক। দেশের পরিবর্তে ব্যক্তি ইমেজকে তিনি বেশি ব্যবহার করছেন।

আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তার বক্তব্যে 'আমি' শব্দটির বহুল ব্যবহার তার আমিত্বকেই বারবার তুলে ধরছে। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় নীতিমালা ভেঙে নিজের পছন্দ-অপছন্দকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। তিনি কোন রাষ্ট্র প্রধানের সঙ্গে কেমন ব্যবহার করবেন বা কোন দেশের ওপর কী পরিমাণ শুল্ক ধরবেন তা কোনো কূটনৈতিক মানদণ্ডের ওপর নির্ভর করছে না। মূলত নির্ভর করছে ঠিক সেসময় তার মনের অবস্থার ওপর। আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মগুলোকে তিনি 'রঙ্গমঞ্চ' বানিয়ে ফেলছেন।

আমেরিকার ভেতরে ও বাইরে তিনি তার ব্যক্তিত্বকে এমন পর্যায়ে তুলে ধরছেন যা তার একনায়কত্বকে ফুটিয়ে তুলছে। তিনি অন্যের মত গ্রহণের মানসিকতার পরিবর্তে অন্যের ওপর নিজের মত চাপিয়ে দেওয়ার মানসিকতা ক্রমাগত দেখিয়ে যাচ্ছেন।

ট্রাম্প বারবার বলছেন, 'আমি যুদ্ধ থামিয়েছি'। অর্থাৎ, একমাত্র তিনিই যুদ্ধ থামানোর ক্ষমতা রাখেন। তিনি আমেরিকার পরিবর্তে বারবার নিজেকেই তুলে ধরছেন। তিনি 'আমেরিকা ফার্স্ট' নীতিকে রাষ্ট্রীয় নীতি করার পরিবর্তে 'ট্রাম্প ফার্স্ট'কে রাষ্ট্রীয় নীতি বানিয়ে ফেলেছেন।

বিরোধীদের অভিযোগ—ট্রাম্প রিপাবলিকান পার্টির অভিবাসননীতিকে রাষ্ট্রীয় নীতি বানিয়ে ফেলেছেন। তিনি ভিন্ন মতকে ভীষণভাবে দূরে সরিয়ে দিচ্ছেন। তার নীতির সঙ্গে অন্য কারও নীতির মিল না হলে তিনি সেই ব্যক্তিকে তীব্র ভাষায় তিরস্কার করছেন। এ ক্ষেত্রে জ্বলন্ত উদাহরণ নিউইয়র্ক নগরীর মেয়র প্রার্থী জোহরান মামদানি।

এয়ার ফোর্স ওয়ানে গণমাধ্যমের প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন ট্রমাপ। ছবি: এএফপি
এয়ার ফোর্স ওয়ানে গণমাধ্যমের প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন ট্রমাপ। ছবি: এএফপি

নির্বাচনী প্রচারণায় স্রেফ সাধারণ মানুষের কল্যাণের কথা বলে এই ডেমোক্র্যাট নেতা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কাছ থেকে 'কমিউনিস্ট' তকমা পেয়েছেন। শুধু তাই নয়, জোহরান মামদানিকে নির্বাচনে হারানোর জন্য তিনি নিজে উদ্যোগী হয়েছেন তার পছন্দের প্রার্থীকে বিজয়ী করার জন্য। তার কথা শুনলে তিনি জোহরান মামদানির বিরোধীদের নতুন 'কাজ' পাইয়ে দেবেন বলেও ঘোষণা দিচ্ছেন।

ট্রাম্প দেশে-বিদেশে ব্যক্তি প্রশংসাকে এমন পর্যায়ে নিয়ে গেছেন যে তার বিরোধিতা প্রায় রাষ্ট্রের বিরোধিতার সামিল হয়ে গেছে। নিজ দেশে তিনি সংবিধান ও আইন-আদালতকে পাশ কাটিয়ে নিজের মতকে সবার ওপর চাপিয়ে দিচ্ছেন।

বিদেশেও তিনি আমেরিকার পরিবর্তে তার নিজের প্রশংসাকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। তার নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে কয়েকটি রাষ্ট্র ট্রাম্পের কাছে বিশেষ সুবিধা পাওয়ার আশায় চাটুকারিতাকে পররাষ্ট্রনীতিতে যুক্ত করেছে। তারা বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্রনায়ক ট্রাম্পকে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য রাষ্ট্রীয় মনোনয়ন দিচ্ছে।

এসব ঘটনা ট্রাম্পের 'আমেরিকা ফার্স্ট'কে ভুলিয়ে দিয়ে 'ট্রাম্প ফার্স্ট'কে প্রতিষ্ঠিত করছে বলেই মনে করেন অনেক বিশ্লেষক।

Comments