ছবিতে ল্যুভর থেকে যেভাবে চুরি

ছবি: সংগৃহীত

প্যারিসের আকাশে তখন সূর্য উঠে গেছে, দর্শনার্থীরাও ল্যুভর জাদুঘরের করিডোরে ঢুকতে শুরু করেছেন— ঠিক তখনই হানা দেয় চোরের দলটি।

বিবিসি বলছে, মাত্র আট মিনিটের মধ্যেই তারা ফ্রান্সের রাজধানীর কেন্দ্রস্থল থেকে দেশের অমূল্য ধনসম্পদ নিয়ে পালিয়ে যায়।

এভাবেই সাম্প্রতিক ইতিহাসের সবচেয়ে চমকপ্রদ চুরির একটি ঘটেছে।

ছবি: সংগৃহীত

চোরেরা যেভাবে ঢুকে

পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি পরিদর্শিত জাদুঘরটি সেইন নদীর তীরে এক বিশাল প্রাসাদে অবস্থিত। রোববার ল্যুভর জাদুঘরের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে অবস্থিত গ্যালারি অব অ্যাপোলোতে নাটকীয় এই ঘটনা ঘটে।

লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির বিখ্যাত 'মোনালিসা'র মতো প্রদর্শিত চিত্রকর্ম দেখতে দর্শনার্থীরা সকাল ৯টায় আইকনিক কাচের পিরামিড-চিহ্নিত প্রধান প্রবেশদ্বার দিয়ে ভেতরে ঢুকতে শুরু করেন।

এর ঠিক ৫৯৩ ফুট দূরে নদীর ওপারে ফুটপাথে একটি ট্রাক থামে— যার ওপর যান্ত্রিক মই বসানো ছিল। এভাবেই ঘটে পৃথিবীকে নাড়িয়ে দেওয়া এক চুরির সূচনা।

ছবি: সংগৃহীত

সকাল সাড়ে ৯টায় চার সদস্যের দলে থাকা দুজন সেই মই বেয়ে একটি বারান্দায় উঠে যায়। ৯টা ৩৪ মিনিটের দিকে তারা মোটরচালিত অ্যাঙ্গেল গ্রাইন্ডার দিয়ে কাচ-কাঠের জানলা কেটে ভেতরে প্রবেশ করে।  

কাচ আর কাঠের প্যানেলগুলো চোরদের মোটরচালিত অ্যাঙ্গেল গ্রাইন্ডারের সামনে কোনো বাধাই হয়ে দাঁড়ায়নি — ফরাসি কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত করেছে যে, ঐশ্বর্যময় গ্যালারিটির জানালাগুলো শক্তিশালী বা সুরক্ষিত নয়।

মুখোশধারী অনুপ্রবেশকারীরা যখন অ্যাঙ্গেল গ্রাইন্ডার হাতে রক্ষীদের দিকে ধেয়ে আসে, তখন নিরস্ত্র নিরাপত্তারক্ষীরা পালিয়ে যায়।

এরপর তাদের আর ধনরত্নের মাঝখানে থাকে কেবল কয়েক ইঞ্চি পুরু কাচ।

ছবি: সংগৃহীত

চোরেরা প্রবেশ করেছিল গ্যালারি অব অ্যাপোলোতে, যে মহিমান্বিত হলে ফরাসি রাজকীয় মুকুট ও অলংকার গত এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে সংরক্ষিত আছে।

চারপাশে সোনালি অলঙ্করণ আর ১৯ শতকের চিত্রকর্মে ঘেরা ওই গ্যালারিতে রাজপরিবার ও সাম্রাজ্যবাদী শাসকদের অলংকারগুলো ধাতব কেবিনেটে রাখা ছিল।

ফরাসি সম্প্রচারমাধ্যম বিএফএমটিভির ফুটেজে দেখা যায়, ভেস্ট পরা এক ব্যক্তি অ্যাঙ্গেল গ্রাইন্ডার দিয়ে একটি প্রদর্শনী কেবিনেট খুলতে চেষ্টা করছেন।

বিবিসিও নিশ্চিত করেছে যে, ফুটেজটি গ্যালারির দক্ষিণ-পশ্চিম কোণ থেকে ধারণ করা হয়েছিল।

ছবি: সংগৃহীত

জাদুঘরের অভ্যন্তরের সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, চোরেরা দুটি কেবিনেট ভেঙে রত্নগুলো নিতে ও পালাতে সময় নেয় মাত্র তিন মিনিট ৫৭ সেকেন্ড — ফ্রান্সের এক মন্ত্রী এ তথ্য জানিয়েছেন।

তিনি বলেন, 'তারা সংগঠিত ও সতর্ক ছিল এবং তারা জানত ঠিক কী নিতে এসেছে।'

ফ্রান্সের রাজকীয় রত্নভাণ্ডারে রয়েছে ১৭৮৯ সালের বিপ্লবের পর উদ্ধার বা সংরক্ষিত সামগ্রী। চুরি যাওয়া অধিকাংশ অলংকার ১৯ শতকের, যা নেপোলিয়ন ও তার ভাতিজা তৃতীয় নেপোলিয়ন পরিবারের ব্যবহৃত ছিল।

ছবি: সংগৃহীত

চুরি যাওয়া রত্নগুলো

মোট আটটি বস্তু চুরি হয়েছে। ফরাসি কর্মকর্তারা এই চুরির মালামালকে 'অমূল্য' বলে বর্ণনা করেছেন। এক মন্ত্রীর ভাষ্যে, মূল্যবান রত্ন ও ধাতুর বাইরেও এগুলোর 'অপরিসীম ঐতিহ্যগত গুরুত্ব' রয়েছে।

চুরি যাওয়া রত্নগুলোর মধ্যে রয়েছে, (১-৩) রানি হরটেন্স ও রানি মেরি-আমেলির পরিহিত টিয়ারা (মকুট বা তাজ), নেকলেস এবং এক জোড়া কানের দুল। (৪-৫) নেপোলিয়ন বোনাপার্টের দ্বিতীয় স্ত্রী মেরি-লুইসকে উপহার দেওয়া পান্নার নেকলেস ও কানের দুল। (৬-৭) সম্রাজ্ঞী ইউজেনির মুক্তো ও হীরের টিয়ারা এবং হীরের ব্রোচ (কারুকার্য করা পিন)। (৮) 'রেলিকুয়ারি ব্রোচ' নামে পরিচিত ব্রোচ। 

ছবি: সংগৃহীত

তবে সব কিছু পরিকল্পনা মতো হয়নি — পুলিশ নিশ্চিত করেছে যে, ইউজেনির ক্রাউন পালানোর পথে পড়ে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত অবস্থায় উদ্ধার হয়েছে।

ফরাসি প্রসিকিউটররা জানিয়েছেন, দুই চোর কিছু সরঞ্জাম ফেলে গেছে, যার মধ্যে একটি ভেস্টও ছিল। পুলিশ এগুলো বিশ্লেষণ করছে।

সকাল ৯টা ৩৫ মিনিটের মধ্যে জাদুঘরের কর্মীদের মধ্যে খবর ছড়িয়ে পড়ে যে, গ্যালারি অব অ্যাপোলোতে কিছু ঘটছে। একটি অ্যালার্ম বাজে নিয়ন্ত্রণ কক্ষে, তবে এটি কতটা শোনা গিয়েছিল তা স্পষ্ট নয়। পুলিশ এখনো তদন্ত করছে সেটি ঠিকভাবে কাজ করছিল কিনা।

এক প্রত্যক্ষদর্শী বিবিসিকে বলেছেন, তিনি দেখেছেন রক্ষীরা দর্শনার্থীদের গ্যালারির দিক থেকে সরিয়ে নিচ্ছিল, আবার অন্যরা দ্রুত সেই দিকেই ছুটে যাচ্ছিল।

তিনি বলেন, শুরুতে অতিথিদের অন্য অংশে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, কিন্তু 'পরিস্থিতি বদলে যায়' যখন নিরাপত্তার রেডিওতে নতুন বার্তা আসে।

ছবি: সংগৃহীত

সকাল ৯টা ৩৮ মিনিটের দিকে পালিয়ে যাওয়ার আগে চোরেরা যে যান্ত্রিক মই ব্যবহার করেছিল সেটিতে আগুন দেওয়ার চেষ্টা করে। এরপর তারা সম্ভবত ইয়ামাহা টিম্যাক্স স্কুটারে চড়ে পালিয়ে যায় — যা ঘণ্টায় ১০০ মাইলেরও বেশি গতিতে চলতে এবং প্যারিসের সরু রাস্তায় অদৃশ্য হয়ে যেতে সক্ষম।

তদন্তকারীরা ধারণা করছেন, চোরেরা দক্ষিণ দিকে এ৬ মহাসড়কের দিকে রওনা দেয়, যা শহর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার প্রধান পথগুলোর একটি।

তারা কোথায় পালিয়েছে, এখন পর্যন্ত তা রহস্যই রয়ে গেছে— তবে তাদের অবস্থান সম্পর্কে কোনো সূত্র ফরাসি পুলিশের কাছে চুরি যাওয়া রত্নগুলোর মতোই মূল্যবান।

 

Comments

The Daily Star  | English

Farewell

Nation grieves as Khaleda Zia departs, leaving a legacy of unbreakable spirit

9h ago