করোনাভাইরাসের টিকা কি ক্যানসারের বিরুদ্ধেও কার্যকর?

ছবি: রয়টার্স

সর্বজনীনভাবে উৎপাদিত করোনাভাইরাসের টিকাগুলো এমআরএনএ মডেল ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছিল। বৈশ্বিক মহামারির সময়ে এসব টিকা দ্রুত সময়ে উৎপাদন করা হয়েছিল। নতুন এক গবেষণায় দেখা গেছে, এসব টিকা ক্যানসার কোষ শনাক্তকরণে এবং ক্যানসারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে শরীরের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থাকে সাহায্য করে।

গবেষকরা ইঁদুরের ওপর পরীক্ষা করেছেন এবং ক্যানসার রোগীদের মেডিকেল রেকর্ডও বিশ্লেষণ করেছেন। দেখা গেছে, যারা ক্যানসারের ইমিউনথেরাপি শুরু করার আগে কোভিডের এমআরএনএ টিকা নিয়েছিলেন, তাদের ক্ষেত্রে চমকপ্রদ ফলাফল পাওয়া গেছে। ফলাফল হলো, যারা টিকা নেননি, তাদের তুলনায় যারা টিকা নিয়েছেন, তারা অনেক বেশি সময় বেঁচে ছিলেন।  

ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয় এবং টেক্সাসের এমডি অ্যান্ডারসন ক্যানসার সেন্টারের এক গবেষক দল চলতি সপ্তাহে বার্লিনে অনুষ্ঠিত ইউরোপিয়ান সোসাইটি ফর মেডিকেল অনকোলজি কংগ্রেসে তাদের ফলাফল উপস্থাপন করেছেন এবং তা পিয়ার-রিভিউ জার্নাল নেচারে প্রকাশিত হয়েছে।

গবেষকরা জানাচ্ছেন, এই ফলাফল প্রমাণ করে যে এমআরএন টিকা শুধুমাত্র সংক্রমণ প্রতিরোধ করে না, বরং শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকেও সক্রিয় করে এবং টিউমারের বিরুদ্ধে লড়াই করতে উদ্বুদ্ধ করে।

এই আবিষ্কার এমন সময়ে এলো, যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন এমআরএনএ গবেষণার তহবিল কমিয়ে দিয়েছে।

নতুন এই গবেষণাকে কেন এত গুরুত্বপূর্ণ বলা হচ্ছে? এটি ক্যানসারের রোগীদের জন্য কী অর্থ বহন করে? আর কোভিড মহামারি কীভাবে এই অপ্রত্যাশিত আবিষ্কারের সুযোগ তৈরি করল?

এমআরএনএ টিকা কী?

এমআরএনএ টিকা প্রচলিত টিকার মতো নয়। প্রচলিত টিকা ভাইরাসের দুর্বল বা নিষ্ক্রিয় অংশ ব্যবহার করে ইমিউন সিস্টেমকে প্রতিরক্ষা তৈরি করতে শেখায়। আর এমআরএনএ টিকা সরাসরি শরীরের কোষে একটি ছোট জেনেটিক কোডের অংশ বা মেসেঞ্জার আরএনএ পৌঁছে দেয়।

কোষ এই ব্লুপ্রিন্টকে নির্দেশনার মতো অনুসরণ করে ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনের অনুলিপি তৈরি করে। কোষের বাইরে প্রদর্শিত এই অনুলিপি রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে সতর্কতা সংকেত দেয় এবং প্রতিরক্ষা তৈরি করতে শেখায়।

এরপর শরীর অ্যান্টিবডি ও মেমোরি কোষ তৈরি করে, যা ভবিষ্যতে সেই স্পাইক প্রোটিন আবার দেখা দিলে তা চিনতে এবং আক্রমণ করতে প্রস্তুত থাকে।

গবেষকরা কীভাবে এমআরএনএ ও ক্যানসারের মধ্যে সম্পর্ক আবিষ্কার করলেন?

এ ধরনের গবেষণা কয়েক বছর ধরেই চলছিল। গবেষকদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ফ্লোরিডার শিশুক্যানসার বিশেষজ্ঞ ইলিয়াস সায়ুরের নাম  বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

কোভিড মহামারি এ ধরনের গবেষণায় বিশেষ এক সুযোগ তৈরি করে দেয়। মহামারির সময়ে যখন বিশ্বব্যাপী মানুষকে ব্যাপকভাবে টিকা দেওয়া হচ্ছিল, তখন গবেষকরা ক্যানসারের চিকিৎসায় এমআরএনএ প্রযুক্তির সম্ভাবনা নিয়ে গভীরভাবে গবেষণা করার সুযোগ পান।

সায়ুরের সাবেক ছাত্র ও অনকোলজিস্ট অ্যাডাম গ্রিপিন টেক্সাসের এমডি অ্যান্ডারসন ক্যানসার সেন্টারে ২০১৯ সালের আগস্ট থেকে ২০২৩ সালের আগস্ট পর্যন্ত চিকিৎসা পাওয়া এক হাজারেরও বেশি রোগীর তথ্য বিশ্লেষণ করেন। সেখানে তিনি এক চমকপ্রদ ধারা লক্ষ্য করেন।

যেসব রোগী ইমিউনথেরাপি শুরু করার ১০০ দিনের মধ্যে কোভিডের এমআরএনএ টিকা নিয়েছিলেন, তারা একই চিকিৎসা নেওয়া কিন্তু ভ্যাকসিন না নেওয়া রোগীদের তুলনায় অনেক বেশি সময় বেঁচে ছিলেন।

টিকা নেওয়ার পর ক্যানসার রোগীরা কতদিন বেশি বেঁচে ছিলেন?

জটিল পর্যায়ের ফুসফুস ক্যানসার রোগীদের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, টিকা নেওয়া রোগীদের গড় আয়ু প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। তাদের আয়ু ২০ দশমিক ৬ মাস থেকে বেড়ে ৩৭ দশমিক ৩ মাসে পৌঁছেছে।

আরও উল্লেখযোগ্য হলো, এই উন্নতি সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে তথাকথিত কোল্ড টিউমারের রোগীদের ক্ষেত্রে। এই কোল্ড টিউমার বলতে এমন ক্যানসারকে বোঝায়, যেখানে ইমিউন সিস্টেম বা রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা প্রতিক্রিয়া দেখায় না।

গবেষকরা দেখেছেন, এমআরএনএ টিকা ইমিউন সিস্টেমকে জাগিয়ে তোলে এবং এসব টিউমারকে এমনভাবে পরিবর্তন করে যেন ইমিউন সিস্টেম সেগুলোকে চিনে আক্রমণ করতে পারে।

গবেষকরা আরও জানিয়েছেন, এই ফলাফল ভ্যাকসিনের প্রস্তুতকারক, ডোজ বা দেওয়ার সময়ের তারতম্য নির্বিশেষে একইভাবে পাওয়া গেছে।

গবেষকরা এমন একটি গ্রুপের ওপরও গবেষণা করেছেন, যারা মেটাস্ট্যাটিক মেলানোমায় (এক ধরনের চামড়ার ক্যানসারের সবচেয়ে জটিল পর্যায়) আক্রান্ত ছিলেন এবং ইমিউনথেরাপি নিচ্ছিলেন। 

গবেষণায় দেখা গেছে, এই রোগীদের মধ্যে ৪৩ জন টিকা নিয়েছিলেন, আর ১৬৭ জন নেননি। যারা নেননি, তাদের গড় আয়ু ছিল মাত্র দুই বছরের কিছু বেশি। অন্যদিকে, যারা চিকিৎসা শুরুর আগে টিকা নিয়েছিলেন, তিন বছরেরও বেশি সময় পর্যবেক্ষণ চলার পরও তাদের গড় আয়ু এখনো নির্ধারিত হয়নি। অর্থাৎ তারা তুলনামূলকভাবে বেশি দিন বেঁচে আছেন।

কীভাবে এটি কাজ করে?

গবেষকরা আবিষ্কার করেছেন যে, এমআরএনএ টিকা শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার জন্য একটি সতর্ক সংকেত বা "অ্যালার্ম" হিসেবে কাজ করে। 

টিকা দেওয়া হলে ইমিউন সিস্টেম সচেতন হয়ে যায় এবং আগে যে ক্যানসারের কোষগুলোকে উপেক্ষা করত, সেগুলো এবার চিনতে পারে। একবার ইমিউন সিস্টেম সক্রিয় হয়ে গেলে, এটি ক্যানসারের কোষ আক্রমণ করতে শুরু করে।

তবে ক্যানসারের কোষও পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তোলে। তারা পিডি-এল১ নামের একটি প্রোটিন তৈরি করে, যা ঢালের মতো কাজ করে এবং ক্যানসারের কোষগুলোকে ইমিউন সিস্টেম থেকে "লুকিয়ে" রাখে। তবে কিছু ওষুধ আছে যাদের ইমিউন চেকপয়েন্ট ইনহিবিটর বলা হয়। এরা এই ঢালকে ঠেকাতে পারে।

গ্রিপিন ব্যাখ্যা করেন, যখন টিকা এবং এই ওষুধ একসঙ্গে ব্যবহার করা হয়, তখন ইমিউন সিস্টেম সতর্ক ও শক্তিশালী থাকে, আর ক্যানসার কোষের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে যায়।

গবেষকরা বলেছেন যে তারা এখনও পুরোপুরি প্রক্রিয়াটি বুঝতে পারেননি। তবে তাদের ফলাফল দেখাচ্ছে যে, এমআরএনএ টিকা ক্যানসারের বিরুদ্ধে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে নতুনভাবে প্রশিক্ষণ বা নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যবহার করা যেতে পারে।

ক্যানসার রোগীদের জন্য এই গবেষণা কী বার্তা দেয়?

গবেষণার ফল এখনও প্রাথমিক পর্যায়ের। তবে যদি এই গবেষণা ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে নিশ্চিত হয়, তাহলে এটি ক্যানসারের চিকিৎসায় বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে।

গ্রিপিন বলেন, এসব টিকা শক্তিশালী টিউমার-বিরোধী ইমিউন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, যা ক্যানসার রোগীদের বেঁচে থাকার সময় উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়ে দেয়।

সায়ুরের কথা হলো, এর প্রভাব অসাধারণ—এটি ক্যানসারের চিকিৎসার পুরো ক্ষেত্রকেই বৈপ্লবিকভাবে পরিবর্তন করতে পারে। তিনি বলেন, আমরা এমন একটি টিকা তৈরি করতে পারি যা ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী ও নতুনভাবে প্রস্তুত করবে। এটি হবে সর্বজনীন ক্যানসারের টিকা।

স্টিভেন লিনের সঙ্গে এই গবেষণায় নেতৃত্ব দেওয়া গ্রিপিন জানান, তার দল একটি ফেজ ৩ ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু করছে। এর উদ্দেশ্য হলো গবেষণার প্রাথমিক ফল সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া এবং তা খতিয়ে দেখা কোভিডের এমআরএনএ টিকা ক্যানসার রোগীদের নিয়মিত চিকিৎসার অংশ হওয়া উচিত কি না।

ইঁদুরের ওপর পরীক্ষায় বিজ্ঞানীরা কী খুঁজে পেয়েছেন?

ইঁদুরের ওপর ওপর পরীক্ষায় দেখা গেছে, যখন কোভিডের এমআরএনএ টিকা সরাসরি একটি টিউমারে দেওয়া হয়, তখন ডেনড্রিটিক কোষ অধিক সতর্ক হয়ে যায়। এটি এক ধরনের শ্বেত রক্তকণিকা, যা শরীরকে সংক্রমণ বা বিপদের বিষয়ে সতর্ক করে।

ডেনড্রিটিক কোষ যখন টিউমারের উপস্থিতি শনাক্ত করে, তখন তারা সংকেত পাঠায়, যা টি-কোষকে (টি সেল) টিউমারের দিকে আকৃষ্ট করে এবং আক্রমণ করতে উদ্বুদ্ধ করে। কিছু ইঁদুরের ক্ষেত্রে ক্যানসারের বৃদ্ধি ধীর হয়ে যায়।

এখানে কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। সবাই স্বাভাবিকভাবে এমন টি-কোষ ধারণ করে না যা ক্যানসারের কোষ ধ্বংস করতে পারে। অনেকের ইমিউন সিস্টেম টিউমারকে বিপজ্জনক মনে করতে পারে, কিন্তু তাদের নির্দিষ্ট টি কোষ তা ধ্বংস করতে জানে না।

এই কারণেই ইমিউনথেরাপি কিছু রোগীর জন্য কার্যকর হয়, আবার কিছু রোগীর ক্ষেত্রে হয় না। ইমিউন থেরাপি ইমিউন সিস্টেম বা রোগ প্রতিরোধ ক্যানসারের বিরুদ্ধে লড়াই করতে শেখায়।  

কোভিডের এমআরএনএ টিকা আপনার শরীরে টিউমার-বিরোধী নতুন টি-কোষ তৈরি করবে না। তবে প্রাথমিক গবেষণার ভিত্তিতে দেখা যাচ্ছে, এটি ডেনড্রিটিক কোষকে আরও সচেতন করে তুলতে পারে এবং টি-কোষগুলোকে কার্যকরভাবে টিউমারের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সাহায্য করতে পারে।

Comments

The Daily Star  | English

BTRC wants 5.5% of revenue from broadband operators

The Bangladesh Telecommunication Regulatory Commission (BTRC) has proposed a new licensing framework that would require broadband operators and fixed-line telephone service providers to share 5.5 percent of their annual revenue with the regulator -- similar to the system already in place for mobile operators.

2h ago