বাশার আল আসাদ: সিরিয়াকে ধ্বংসের পর এবার চিকিৎসা পেশায়?

২০০৮ সালের ২৫ জুন সিরিয়ার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ আলেপ্পো বিমানবন্দরে আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা অরবিসের ফ্লাইং আই হাসপাতাল পরিদর্শন করেন। ছবি: এএফপি

ঘটনাটি ২০১১ সালের। একদল শিশু তাদের স্কুল মাঠে বড় বড় অক্ষরে একটি সতর্ক বার্তা লিখেছিল। তাতে বলা হয়েছিল, 'ডাক্তার সাহেব এবার তোমার পালা'! এরপর একে একে কেটে গেছে ১৩টি বসন্ত। সেই ডাক্তার নিজের দেশ ধ্বংস করে এবার নাকি মন বসাতে চাচ্ছেন চিকিৎসা পেশায়।

সেই ডাক্তার আর কেউ নন, তিনি সিরিয়ার ক্ষমতাচ্যুত ও রাশিয়ায় পলাতক সাবেক প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ।

আরব দুনিয়ার গণতন্ত্রকামী জনতা রাজনৈতিক মুক্তির আশায় ২০১০ এর দশকে শুরু করেছিল স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন। ভূমধ্যসাগরের পশ্চিমপ্রান্তে তথা আফ্রিকার তিউনিসিয়ায় শুরু হওয়া 'আরব বসন্ত' নামের সেই গণআন্দোলনের দমকা হাওয়ায় কেঁপেছিল সেই সাগরের পুব-পাড়ে এশিয়ার দেশ সিরিয়াও। সে সময় আরব দেশগুলোয় 'জনগণ শাসক বদলাতে চায়' স্লোগানটি বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল।

আজ থেকে এক বছর আগে অর্থাৎ ২০২৪ সালের ৮ ডিসেম্বর ভোরে যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে সরকারবিরোধী সশস্ত্র বিদ্রোহীদের প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে দেশ থেকে পালিয়ে যান স্বৈরশাসক বাশার আল আসাদ। ২০১১ সালে সিরিয়ায় গণতন্ত্রের দাবিতে শুরু হওয়া বিক্ষোভকে চরম নির্দয়ভাবে দমনের চেষ্টা করেছিলেন এই একনায়ক।

স্ত্রী আসমা আসাদ ও তিন সন্তানের সঙ্গে বাশার আল-আসাদ। ছবি: এএফপি

তার বিরুদ্ধে মুক্তিকামী মানুষের শান্তিপূর্ণ গণআন্দোলন গড়িয়েছিল গৃহযুদ্ধে। টিকে থাকার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও হাফিজপুত্র বাশার নিজেকে শেষ রক্ষা করতে পারেননি। শুধু তাই নয়, প্রায় ১৩ বছর নিজেকে 'বীর' বলে দাবি করা সেই ব্যক্তি দেশ ছেড়েছিলেন কাপুরুষের মতো।

পৈত্রিক-সূত্রে পাওয়া ক্ষমতাকে কুক্ষিগত রাখতে প্রায় ২৪ বছর বাশার আল আসাদ নিজ দেশের জনগণের ওপর নজিরবিহীন নিপীড়ন চালিয়েছিলেন। সম্প্রতি ব্রিটিশ গণমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে বলা হয়—সিরিয়ার গত ১৪ বছরের গৃহযুদ্ধে অন্তত ৬ লাখ ২০ হাজার মানুষ মারা গেছেন। তাদের ৯০ শতাংশই বেসামরিক ব্যক্তি আর ঘরহারা হয়েছেন প্রায় দেড় কোটি মানুষ।

এসবের দায় থেকে যেন নিজেকে দূরে রাখার চেষ্টা করছেন বাশার আল আসাদ। তাই যেন ফিরতে চাচ্ছেন তার পুরোনো চিকিৎসা পেশায়। নিজ দেশে গণহত্যা চালিয়ে তিনি যেন পরদেশে 'জনসেবা'র পথ বেছে নিচ্ছেন।

বাশার আল আসাদের বংশলতিকা। ছবি: ইউনিভার্সিটি অব ইলিনয় আরবানা-শ্যাম্পেইন

চাপে পড়ে প্রেসিডেন্ট

ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ সিরিয়া থেকে পালিয়ে গেলেও তিনি ও তার বাবা হাফিজ আল আসাদ দুজনেই কঠোর হাতে অর্ধশতকেরও বেশি সময় দেশটি শাসন করেছিলেন।

১৯৭০ সালে সিরিয়ার সমাজতান্ত্রিক বাথ পার্টির নেতৃত্ব নেন সামরিক কর্মকর্তা হাফিজ আল আসাদ। এর পরের বছর তিনি রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণ করে নিজেকে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট ঘোষণা দেন।

২০২৪ সালের ৯ ডিসেম্বর সিএনএনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের ঘনিষ্ঠ মিত্র বাবা হাফিজ আল আসাদের ছায়াতলে বেড়ে উঠেন ছোট ছেলে বাশার আল আসাদ। ২০০০ সালে মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত হাফিজ আল আসাদ সিরিয়ার শাসক ছিলেন।

ধর্মীয় সংখ্যালঘু আলাওয়াইত সম্প্রদায়ভুক্ত হওয়ায় হাফিজ তার ধর্মবিশ্বাসের মানুষদের শীর্ষ রাজনৈতিক, সামাজিক ও সামরিক পদে নিয়োগ দেন। বাশার তার বাবার পদাঙ্কই অনুসরণ করে চলেছিলেন।

তবে সিরিয়ার ক্ষমতায় বাশারের আসার কথা ছিল না। তার পড়ালেখা লন্ডনে। চক্ষু চিকিৎসাবিদ্যায়। ১৯৯৪ সালে হাফিজের বড় ছেলে বাসেল সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হলে ছোট ছেলে বাশারকে তিনি টেনে আনেন রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে। বাসেলকে গড়ে তোলা হচ্ছিল হাফিজের উত্তরসূরি হিসেবে। কিন্তু তার অকাল মৃত্যুতে বাবার ইচ্ছাপূরণে এগিয়ে আসতে হয় বাশারকে।

রাজনীতির জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না বাশার আল আসাদ। বড় ভাইয়ের মৃত্যুর পর তাকে দেশে ফিরতে হয়। ভর্তি হতে হয় সামরিক বাহিনীতে। যুদ্ধবিদ্যায় পড়ালেখার পর তিনি সিরীয় সেনাবাহিনীর কর্নেল হন। এরপর জাতির সামনে নতুন প্রজন্মের নেতা হিসেবে বাশারকে রাজনৈতিক প্রচারের পাদপ্রদীপের নিচে আনা হয়।

২০২৪ সালের ডিসেম্বরে বাশার আল আসাদের পতনের পর দামেস্কে তার ব্যানার-পোস্টার নামিয়ে ফেলা হয়। ছবি: রয়টার্স

তরুণ বাশার নেতৃত্বে এলে সিরিয়ার উন্নতি হবে এমন আশা ছিল দেশবাসীর মনে। সিএনএনের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়—পশ্চিমের সরকারগুলোও আশা করেছিল, লন্ডনে পড়ালেখা করা বাশার সিরিয়াকে আধুনিক-প্রগতিশীল রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলবেন। তার স্ত্রী সিরীয় বংশোদ্ভূত আসমা আল আসাদ লন্ডনে বেড়ে উঠেন। বিয়ের আগে তিনি ছিলেন ব্যাংক কর্মকর্তা। ফলে দেশবাসীর প্রত্যাশার পারদ ছিল অনেক ওপরে। তবে সবার মোহ ভাঙতে বেশি সময় লাগেনি।

২০০০ সালের জুনে বাবা হাফিজের মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে দেশটির সংবিধানে প্রেসিডেন্টের বয়স সংক্রান্ত ধারা বদলে ফেলা হয়। সংবিধানে প্রেসিডেন্টের বয়স নূন্যতম ৪০ বছর থাকার কথা ছিল। তখন বাশারের বয়স ছিল ৩৪ বছর।

সংবিধান পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বাশার ক্ষমতায় আসেন এবং বিরোধী দলহীন দেশে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেন। বাবার মতো তিনিও লেবাননের সশস্ত্র দল হিজবুল্লাহ ও ফিলিস্তিনের সশস্ত্র দল হামাসের সঙ্গে সখ্যতা বজায় রাখেন।

কেউ বিরোধী হতে পারে সন্দেহ হলেই বাবার মতো তা নির্দয়ভাবে দমন করতে শুরু করেন বাশার। প্রতি সাত বছর পরপর তিনি নির্বাচনের মাধ্যমে নিজেকে বিজয়ী ঘোষণা করতেন এবং প্রেসিডেন্টের ক্ষমতাকে আরও করায়ত্ত করে বিরোধীদের ওপর দমন-পীড়ন চালাতেন। এর এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ২০১১ সালের গণবিক্ষোভকে নির্মমভাবে দমনের ঘটনা।

২০২১ সালের ২৮ মে বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সিরিয়ায় সবে শেষ হওয়া রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বাশার আল আসাদ '৯৫ শতাংশ' ভোট পেয়েছেন। একইদিনে আল জাজিরার এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, গৃহযুদ্ধের মধ্যে অনুষ্ঠিত ২০১৪ সালের নির্বাচনে আসাদ দাবি করেছিলেন যে তিনি ৮৯ শতাংশ ভোট পেয়ে পুনঃনির্বাচিত হয়েছেন।

পাঠক মনে স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন জাগতে পারে যে এত 'জনপ্রিয়' এক নেতার এমন করুণ পরিণতি হলো কেমন করে? তবে অন্যান্য স্বৈরাচারের মতো তিনিও বুঝতে পারেননি যে, জনরোষে একদিন সব একনায়কই পরাভূত হন।

২০১১ সালের মে মাসে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা সিরিয়ায় বাশার আল আসাদের শাসন সম্পর্কে বলেছিলেন, 'তারা নিজ দেশের জনগণকে হত্যা ও গ্রেপ্তারের' পথ বেছে নিয়েছে। এরপর, তিনি বাশারকে গণতন্ত্রের পথে আসার আহ্বান জানিয়ে বলেন, তা না হলে 'বিদায় নিতে হবে'।

সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে দামেস্কে রোগী দেখতেন বাশার। ছবি: ইন্সটাগ্রাম

চিকিৎসা পেশায় ফিরতে চান আসাদ

শুধু সিরিয়াকে ধ্বংস করেই নয়, নিজেও দেশহারা হয়ে বাশার আল আসাদ এখন চাচ্ছেন চিকিৎসা পেশায় ফিরতে। গত ১৫ ডিসেম্বর ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান জানায়, বাশার আল আসাদের পরিবার রাশিয়ার রাজধানী মস্কোর এক অভিজাত এলাকায় বিলাসী জীবনযাপন করছে এবং বাশার চাচ্ছেন চোখের চিকিৎসায় ফিরতে।

বাশারের পারিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা এক বন্ধুর বরাত দিয়ে গণমাধ্যমটি আরও জানায়, 'বাশার রুশ ভাষা শিখছেন। তিনি তার চিকিৎসা পেশা আবার শুরু করতে চান।' তবে সেই বন্ধুর নাম প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়নি।

'ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্টের টাকার প্রয়োজন নেই। তিনি টাকার জন্য চিকিৎসা পেশায় ফিরছেন না। তিনি এটা ভালোবাসেন। তাই এই পেশায় ফিরতে চান,' উল্লেখ করে সংবাদ প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, 'সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে তিনি প্রায় নিয়মিত দামেস্কে রোগী দেখতেন।'

বাশার আল আসাদ সম্পর্কে সেই পারিবারিক বন্ধু আরও জানান যে, রাশিয়ায় বাশার বেশ শান্তজীবন কাটাচ্ছেন। বলতে গেলে বাইরের কারও সঙ্গে তার যোগাযোগ নেই। তবে পতিত সরকারের দু-একজনের সঙ্গে তার কথা হয়ে থাকতে পারে।

যাই হোক, চক্ষু চিকিৎসক বাশার আল আসাদ এতদিন নিজ দেশের মানুষকে চিকিৎসাসেবা দিলেও এবার তাকে সেবা দিতে হবে ভিনদেশের নাগরিকদের। যদি তিনি শেষমেশ আবার রোগী দেখা শুরু করেন।

Comments

The Daily Star  | English
Khaleda Zia contribution to Bangladesh democracy

A leader who strengthened our struggle for democracy

Khaleda Zia leaves behind an enduring legacy of service.

13h ago