এআই যুদ্ধ: পশ্চিমা চিপ আধিপত্য ভাঙতে চীনের গোপন ‘ম্যানহাটন প্রকল্প’

ছবি: রয়টার্স

মানুষ চাকা আবিষ্কার করেছিল জীবন সহজ করতে। সেই উদ্ভাবনের ধারাবাহিকতায় আজ মানুষের চিন্তাকেই চ্যালেঞ্জ করছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই। 

এআই এখন আর শুধু প্রযুক্তির একটি শাখা নয়। এটি মানুষের কাজ, সিদ্ধান্ত এবং ভবিষ্যৎ কল্পনার ধরনও বদলে দিচ্ছে।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে ঘিরে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা আর সফটওয়্যার বা অ্যালগরিদমে সীমাবদ্ধ নেই।

চীন ও পশ্চিমা বিশ্বের মধ্যে চলমান প্রযুক্তিগত প্রতিদ্বন্দ্বিতা ধীরে ধীরে একটি নতুন 'শীতল যুদ্ধে' রূপ নিচ্ছে। 

এই সংঘাতের কেন্দ্রে রয়েছে সেমিকন্ডাক্টর বা উন্নত চিপ উৎপাদনের নিয়ন্ত্রণ। 

রয়টার্সের একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, এই অবরোধ মোকাবিলায় চীন একটি উচ্চঝুঁকিপূর্ণ ও গোপন রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ শুরু করেছে।

এই উদ্যোগকে অনেকেই যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক বোমা তৈরির উদ্যোগ 'ম্যানহাটন প্রকল্পের চীনা সংস্করণ' হিসেবে বর্ণনা করেছেন।

এই প্রতিযোগিতার মূল অস্ত্র হলো এক্সট্রিম আল্ট্রাভায়োলেট (ইইউভি) লিথোগ্রাফি প্রযুক্তি। আর এই প্রযুক্তি ছাড়া আধুনিক এআই মডেল, স্মার্টফোন বা উন্নত অস্ত্র তৈরি সম্ভব নয়।

ইইউভি লিথোগ্রাফি: আধুনিক প্রযুক্তির কেন্দ্র

লিথোগ্রাফি প্রযুক্তির মাধ্যমে মানুষের চুলের চেয়েও হাজার গুণ পাতলা সার্কিট তৈরি করা হয়।

প্রায় ২৫ কোটি ডলার মূল্যের ১৮০ টন ওজনের একটি যন্ত্র আলোর রশ্মি ব্যবহার করে সিলিকনের ওপর অতিসূক্ষ্ম সার্কিট খোদাই করে।

বর্তমানে বিশ্বে কেবল নেদারল্যান্ডসভিত্তিক প্রতিষ্ঠান এএসএমএলের কাছেই এই ইইউভি প্রযুক্তির নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। 

আর এই প্রযুক্তিগত সুবিধার ওপর ভর করেই পশ্চিমা বিশ্বের সামরিক ও অর্থনৈতিক আধিপত্য গড়ে উঠেছে।

আধিপত্যের সংঘাত

যুক্তরাষ্ট্র এই স্বকীয় প্রযুক্তির কারণে নেদারল্যান্ডস ও জাপানের মতো মিত্রদের সঙ্গে সমন্বয় করে চীনের ইইউভি প্রযুক্তিতে প্রবেশাধিকার বন্ধ করে দেয়। 

২০১৯ সাল থেকে এএসএমএলকে তাদের সবচেয়ে উন্নত যন্ত্র চীনের কাছে বিক্রি করতে নিষেধ করে যুক্তরাষ্ট্র। 

পরে ২০২২ সালে ওয়াশিংটন আরও কঠোর রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে।

যার ফলে বৈশ্বিক সেমিকন্ডাক্টর বাণিজ্যে বেইজিংয়ের প্রবেশ হয়ে পড়ে বিচ্ছিন্ন।

চীনের 'ম্যানহাটন প্রকল্প' ও গোপন অগ্রগতি

এই অবরোধের জবাবে স্বনির্ভরতা অর্জনের লক্ষ্যে চীন একটি বিশাল রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত পাল্টা অভিযান শুরু করেছে বলে জানিয়েছে রয়টার্সের ওই প্রতিবেদন। 

প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগে সমন্বয় করছে চীনা প্রযুক্তি জায়ান্ট হুয়াওয়ে। 
আর তত্ত্বাবধানে রয়েছেন কমিউনিস্ট পার্টির উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা। 

রয়টার্স জানায়, শেনঝেনের একটি উচ্চনিরাপত্তা গবেষণাগারে চীনা বিজ্ঞানীরা ইতোমধ্যে এমন একটি যন্ত্র তৈরি করেছেন, যা লিথোগ্রাফির জন্য প্রয়োজনীয় আলো তৈরি করতে পারে। 

যন্ত্রটি এএসএমএলের তুলনায় আকারে বড় ও প্রযুক্তিগতভাবে এখনো অপরিণত। তারপরেও এটি পরীক্ষামূলকভাবে কাজ করছে।
এই অগ্রগতি পশ্চিমা পূর্বাভাসকে চ্যালেঞ্জ করেছে। 

একসময় এএসএমএলের শীর্ষ নেতৃত্বও বলেছিলেন, এই প্রযুক্তি বানাতে চীনের 'অনেক, অনেক বছর' লাগবে। 

তবে প্রকল্পসংশ্লিষ্ট ভেতরের সূত্রগুলো রয়টার্সকে ধারণা দিয়েছে ২০২৮ থেকে ২০৩০ সালের মধ্যেই এআই চিপ উৎপাদনের লক্ষ্যে এগোচ্ছে চীন।

যা আগের অনুমানের চেয়ে অনেক কম সময়।

গ্রে জোন কৌশল ও ভবিষ্যৎ প্রভাব

প্রযুক্তিগত ব্যবধান কমাতে চীন যে কৌশল নিয়েছে, বিশ্লেষকেরা সেগুলোকে 'গ্রে জোন' তৎপরতা হিসেবে বর্ণনা করছেন। এর মধ্যে রয়েছে এএসএমএলের সাবেক প্রকৌশলীদের সক্রিয়ভাবে নিয়োগ। 

চুক্তি স্বাক্ষরের সময় তাদের দেওয়া হচ্ছে ৩০ থেকে ৫০ লাখ ইউয়ান যা প্রায় ৪ থেকে ৭ লাখ মার্কিন ডলারের সমান। আবার নিরাপত্তার স্বার্থে তাদের নাম, পরিচয়ও গোপন করার নির্দেশনা দিয়েছে চীন। 

যেহেতু চীন নতুন যন্ত্র কিনতে পারছে না তাই মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পুরোনো যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ সংগ্রহ করছে। জাপানের নিকন ও ক্যাননের সীমিত সক্ষমতার যন্ত্রের প্রকৃত ক্রেতাকে আড়াল করতেই এই পদ্ধতি নেওয়া হয়েছে। 

আর নিলাম থেকে কেনা যন্ত্র খুলে প্রয়োজনীয় অংশ সংগ্রহ করা হচ্ছে। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া তরুণদের একটি দল অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে সেগুলো আবার জোড়া লাগাচ্ছে। 

ভবিষ্যৎ কাজের সুবিধা করতে পুরো প্রক্রিয়া ভিডিও করে সংরক্ষণও করা হচ্ছে।

চীনের যত বড় চ্যালেঞ্জ

সবচেয়ে কঠিন বাধা হলো জার্মান প্রতিষ্ঠান কার্ল জাইসের তৈরি অতিনির্ভুল অপটিক্যাল সিস্টেম অনুকরণ করতে না পারা। 

লিথোগ্রাফি প্রযুক্তিতে প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ৫০ হাজারবার গলিত টিনে লেজার চালনা করে প্লাজমা তৈরি করতে হয়।

যার জন্য মাসের পর মাস সময় নিয়ে তৈরি বিশেষ আয়নার প্রয়োজন হয়। এটিই তৈরি করে থাকে জাইস।

প্রকল্পের ঘনিষ্ঠ এক সূত্রের ভাষায়, এই 'এআই যুদ্ধ'-এর কৌশলগত লক্ষ্য হলো চীনের সরবরাহশৃঙ্খল থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে শতভাগ ছিটকে দেওয়া।

চীন এই প্রযুক্তিতে দক্ষতা অর্জন করতে পারলে পশ্চিমা বিশ্বের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ কার্যত থমকে যাবে। 

একইসঙ্গে ভবিষ্যতের এআই ও সামরিক আধিপত্যের জন্য প্রয়োজনীয় হার্ডওয়্যার চীনের নিজস্ব নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।

সার্বিকভাবে, এই অগ্রগতি ইঙ্গিত দেয় চীন প্রযুক্তিগত স্বনির্ভরতার পথে দ্রুত এগোচ্ছে। 

ইইউভি প্রযুক্তিতে সফলতা এলে শুধু এআই চিপ নয়, ভবিষ্যতের সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তির ভারসাম্যও বদলে যেতে পারে। 

ফলে বৈশ্বিক প্রযুক্তি প্রতিযোগিতায় পশ্চিমা বিশ্বের দীর্ঘদিনের প্রাধান্য প্রথমবারের মতো বাস্তব চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে যাচ্ছে।

Comments

The Daily Star  | English
inside story of the attack on Daily Star office

Inside a coordinated assault on The Daily Star

Reporter recounts how vandalism, smoke, and security threats shut down the newsroom

5h ago