আরব বসন্ত: মধ্যপ্রাচ্যের শাসকরা এখনো আতঙ্কে কেন?
ডিসেম্বর ১৭, ২০১০। স্থান: সিদি বোজিদ। উত্তর আফ্রিকার ভূমধ্যসাগর-ঘেঁষা তিউনিসিয়ার মধ্যাঞ্চলীয় একটি শহর। সেদিন এই শহরের ২৬ বছর বয়সী এক সবজি বিক্রেতা নিজের গায়ে আগুন দিয়েছেন। সরকারি কর্মকর্তাদের লাঞ্ছনার যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে।
সেদিন মোহাম্মদ বোয়াজিজি নামের সেই ব্যক্তির গায়ের আগুন পরবর্তীতে গোটা উত্তর আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্য-পারস্য উপসাগরজুড়ে ভয়াবহ রাজনৈতিক উত্তাপ তৈরি করেছিল। সেই উত্তাল-ডামাডোল ইতিহাসের পাতায় পেয়েছে এক আদুরে নাম—'আরব বসন্ত'। আন্দোলনটা শীতের শেষের দিকে শুরু হয়ে বসন্তের প্রারম্ভে পূর্ণতা পেয়েছিল বলেই হয়ত এমন নাম।
যাহোক, চিকিৎসাধীন বোয়াজিজি মারা গিয়েছিলেন ১৮ দিন পর। অর্থাৎ, ২০১১ সালের ৪ জানুয়ারি। তার মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার পর আত্মীয়রা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তা ক্রমশ বিক্ষোভে রূপ নেয়। একসময় সেই বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে এ শহর থেকে ও শহর। অবশেষে সারাদেশ।
তিউনিসিয়ার জনমানুষের আর্থিক-সামাজিক দুর্দশা সরকারের সব রক্তচক্ষুকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে প্রকাশ্যে চলে আসতে থাকে। দরিদ্র-নিপীড়িত মানুষের বঞ্চনার চিত্র দৃশ্যমান হয়। বেকারত্বের প্রকৃত হার প্রকাশ পায়। জীবনযাত্রার আকাশছোঁয়া খরচ থেকে মুক্তি পাওয়ার বাসনা প্রাধান্য পেতে থাকে। শেষমেশ এটিই হয়ে উঠে আন্দোলনের প্রধান জ্বালানি।
পৃথিবীর আর সব গণআন্দোলনের মতোই ছিল তিউনিসিয়ার সরকারবিরোধী গণবিক্ষোভের চিত্র। সাধারণ মানুষ নেমে আসে রাস্তায়। তাদের ওপর চালানো হয় নির্যাতন। দেশটিতে সেই গণআন্দোলন চলেছিল টানা ১০ দিন। তারপর যা ঘটেছিল তা আলোচিত হয়ে আসছে গত ১৫ বছর ধরে।
গণরোষ থেকে বাঁচতে স্বৈরশাসক জয়নাল আবেদিন বেন আলি তিউনিসিয়ায় তার ২৩ বছরের শাসন ফেলে পালিয়ে যান সৌদি আরব। জয় হয় জনতার। আরব বিশ্বে গণবিক্ষোভের মুখে পালিয়ে যাওয়া প্রথম রাষ্ট্রপ্রধান হন বেন আলি। আর সর্বশেষ উদাহরণ হলেন সিরিয়ার বাশার আল আসাদ। তিনি প্রায় সিকি শতাব্দী ক্ষমতা আঁকড়ে ছিলেন। এখন হয়েছে রাশিয়া তার আশ্রয়স্থল।
আরব বসন্তের জন্মস্থান
নিহত সবজি বিক্রেতা মোহাম্মদ বোয়াজিজির চাচাতো ভাই আলি বোয়াজিজি ঘটনার ১০ বছর পূর্তিতে সংবাদমাধ্যম আল জাজিরাকে বলেছিলেন, 'স্থানীয় সংবাদমাধ্যম ও সাধারণ মানুষ সেখানে জড়ো না হলে ২০১০ সালের ১৭ ডিসেম্বরটা হয়ত আর সব সাধারণ দিনের মতোই হয়ে থাকতো।
বাস্তবতা হলো—তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, সরকারের অন্যায় ও বিচারহীনতার বিরুদ্ধে আর মুখ বন্ধ রাখা যায় না।
নিকষ বাস্তবতায় পিষ্ট মোহাম্মদ বোয়াজিজি বাবা হারান তিন বছর বয়সে। বড় হয়ে তিনি কিছুদিন চাচাতো ভাই আলি বোয়াজিজির দোকানে কাজ করেছিলেন। পরিবারের দেনা মেটাতে একসময় মোহাম্মদ নিজেই শুরু করেন রাস্তার পাশে ফল-সবজি বিক্রির কাজ।
আলি বোয়াজিজি জানান, সেদিন পুলিশ এসে তার ভাই মোহাম্মদের জিনিসপত্র জব্দ করে। কারণ, সে ছিল রাস্তার হকার। তার কোনো সরকারি অনুমতিপত্র ছিল না। তখন ক্ষিপ্ত হয়ে মোহাম্মদ তাদের প্রাদেশিক গভর্নরের কাছে অভিযোগ দিতে যান। তবে গভর্নর তার সঙ্গে দেখা করতে রাজি হননি।
রাগে-দুঃখে-অপমানে গভর্নরের কার্যালয়ের বাইরে রাস্তায় এসে মোহাম্মদ নিজের গায়ে আগুন দেন। আলির অভিযোগ, 'সেদিন কেউই মোহাম্মদের কথা শুনতে চাননি।'
তিনি সেদিন নিজের দোকানে ছিলেন জানিয়ে আলি আরও বলেন, 'সেদিন মোহাম্মদের পাশে থাকলে এমন দুর্ঘটনা ঘটতো না।'
'এ ছাড়াও, সেদিন যখন পুলিশ ঘুষ চেয়েছিল তখন কয়টা টাকা দিয়ে দিলেও এমনটি হতো না,' বলে মন্তব্য করেন নিহত মোহাম্মদের ভাই আলি।
ঘটনার পর তাদের চাচা সালাহ এসে আলির কাছে জানতে চান, 'কে নাকি নিজের গায়ে আগুন দিয়েছে?' আলি বিষয়টি জানতেন না। তাই জানার জন্য বের হন। বেশিদূর যেতে হয়নি। পথেই এক ট্যাক্সিচালক জানিয়ে দিলেন, 'তোমার ভাই, মোহাম্মদ। নিজের গায়ে আগুন দিয়েছে।'
এ ঘটনার পর তার পরিবার ও আত্মীয়রা কয়েকজন মিলে গভর্নরের কার্যালয়ে যান। রাস্তায় দাঁড়িয়ে অনেকে ঘটনাটি দেখছিল। তখনো গভর্নর তাদের সঙ্গে দেখা করতে অস্বীকার করেন।
মোহাম্মদকে হাসপাতালে নেওয়ার পর সরকারি ভবনের বাইরে প্রতিবাদকারীরা সমবেত হন। তাদের সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে।
এরপর আলি সেই বিক্ষোভের ভিডিও পোস্ট করেন নিজের ফেসবুকে। মাত্র দুই মাস আগে অ্যাকাউন্টটি খুলেছিলেন তিনি। তাই ভিডিওটি প্রকাশের সময় ছিলেন ভীষণ আতঙ্কিত।
তার ভিডিওটি দ্রুত শেয়ার হতে থাকে। স্থানীয় সংবাদকর্মীরা খোঁজ নিতে থাকেন—কী হয়েছে সেখানে। সন্ধ্যার দিকে কয়েকটি টেলিভিশন এ ঘটনার সংবাদ প্রচার করে। জাতীয় সংবাদমাধ্যম সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণে থাকায় আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের কর্মীরা সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। আলির ভাষ্য, 'আর তখনই সরকার ভড়কে যায়।'
স্বৈরশাসক বেন আলির বিরোধী ধর্মনিরপেক্ষ প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক পার্টির সংবাদপত্র 'আল মাওকিফ'-এ সরকারের তীব্র সমালোচনা করে নিবন্ধ লিখেন নিহত মোহাম্মদের ভাই আলি। তা অধুনালুপ্ত ওয়েবসাইট 'তিউনিসিয়া নিউজ'-এও ছাপা হয়।
সরকার একদিকে বলতে থাকে, 'এটা বিদেশিদের ষড়যন্ত্র'। অন্যদিকে প্রতিশ্রুতি দেয়, সিদি বোজিবাসীদের অর্থনীতিক উন্নয়নে কোটি কোটি দিনার পাঠানো হবে। তবে জনগণ ততক্ষণে বুঝে যায়, এগুলো সরকারের মিথ্যাচার।
২০১১ সালের ৪ জানুয়ারি মোহাম্মদ বোয়াজিজির মৃত্যুর সংবাদ প্রচারিত হওয়ার পর অনেকে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ শুরু করেন। বিক্ষোভকারীদের অনেককে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। তাদের অধিকাংশই ছিল তরুণ।
১০ জানুয়ারি গ্রেপ্তার হন মোহাম্মদের ভাই আলি ও তার এক আত্মীয়। তাদেরকে আন্দোলনের মূল হোতা হিসেবে দেখে পুলিশ। তাদের ওপর চলে অকথ্য শারীরিক নির্যাতন। দুদিন পর গণদাবির মুখে প্রশাসন তাদেরকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। কিন্তু, ততদিনে সারাদেশ উত্তপ্ত।
নিহত মোহাম্মদের ভাই আলি বোয়াজিজির কারামুক্তির দুদিন পর অর্থাৎ ১৪ জানুয়ারি দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন দেশটির মহাক্ষমতাধর রাষ্ট্রপতি বেন আলি। তার পতন উদযাপিত হয় দেশে দেশে। আর মোহাম্মদের শহর সিদি বোজিদ বিশ্বজুড়ে পরিচিতি পায় আরব বসন্তের জন্মস্থান হিসেবে।
শাসকরা এখনো আতঙ্কে কেন?
আজ থেকে ঠিক ১৫ বছর আগে মোহাম্মদ বোয়াজিজির আত্মাহুতির মধ্য দিয়ে বিশ্ববাসী দেখেছিল আগুনের একটি ফুলকি কিভাবে দাবানলে পরিণত হতে পারে। একজন সাধারণ মানুষের আত্মত্যাগ কিভাবে দীর্ঘদিনের শাসককে দেশ ছাড়তে বাধ্য করে। সেদিন তিউনিসিয়ার সে দৃশ্য দেখেছিলেন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর অনির্বাচিত শাসকরাও।
তারা জানেন, 'আরব বসন্ত' বলতে বোঝায় অগণতান্ত্রিক ও দুর্নীতিবাজ স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধে দারিদ্রক্লিষ্ট সাধারণ মানুষের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন। তাই এই 'বসন্তের' ভয় তাদের মনে বিরাজ করে সারা বছর।
তারা আরও জানেন যে, তাদের দেশে এমন 'মোহাম্মদ বোয়াজিজি' আছেন অগণিত, যারা প্রতিদিন বেঁচে থাকার সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হিমশিম খায়। কোথাও এমন একজন বিপন্ন মানুষের আত্মচিৎকার কোনকিছু বুঝে ওঠার আগেই বজ্রনিনাদ হয়ে নেমে আসতে পারে তাদের ওপর।
গত ১৮ ডিসেম্বর আল জাজিরার এক মতামতের শিরোনাম করা হয়—'আরব বসন্ত শেষ হয়নি, এবং আরব শাসকরা তা জানেন'।
এতে বলা হয়—আরব বসন্ত ১৫ বছরে পড়লো, অনেক দেশের শাসক বিক্ষোভকে বেআইনি করেছে; নির্বাচনের ব্যবস্থা করেছে এবং সংবিধানে পরিবর্তন এনেছে—এটা নিশ্চিত করতে যে তাদের দেশে '২০১১ সাল'-এর দুর্যোগ আর কখনোই ফিরে আসবে না। অর্থাৎ, তাদের রাজত্ব বেকার তরুণদের বিক্ষোভের ঘূর্ণাবর্তে খড়কুটোর মতো উড়ে যাবে না।
এ কথা সবাই জানেন যে, তিউনিসিয়ায় শুরু হওয়া আরব বসন্তের 'বাউলা বাতাস' ঝড়ো হাওয়া হয়ে আরব দুনিয়ার মরক্কো, আলজেরিয়া, লিবিয়া, মিশর, সুদান, ইয়েমেন, সৌদি আরব, ওমান, বাহরাইন, জর্ডান ও সিরিয়ায় আছড়ে পড়ে। সেই ঝড় অনারব ইরানের কর্তৃত্ববাদী সরকারেরও ভিত্তি কাঁপিয়ে দেয়।
বিক্ষোভকারীদের দাবি—পুরোনো-জরাগ্রস্ত-ঘুণে ধরা অভিজাততন্ত্রী শাসনব্যবস্থা দূর করে গণতান্ত্রিক ও সমতাভিত্তিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। তবে, উল্লেখিত দেশগুলোর কোনোটিতেই তাদের দাবি প্রতিষ্ঠা করা এখনো সম্ভব হয়নি। উল্টো দীর্ঘ গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত হয়েছে লিবিয়া, সুদান, ইয়েমেন ও সিরিয়া। এমনকি, সেসব গৃহযুদ্ধে নিহত হয়েছে লাখো মানুষ।
এত হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের পরও অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করেন, 'আরব বসন্ত' মরেনি। আল জাজিরার সেই মতামতটিতে আরও বলা হয়, গণতান্ত্রিক গণআন্দোলনকে নিপীড়ন-নির্যাতনের মাধ্যমে আপাতদৃষ্টিতে দমন করা গেলেও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবি চিরদিন টিকে থাকে। আর তাই স্বৈরশাসকদের প্রতিনিয়ত ভয়ে থাকতে হয় আরব বসন্তের।


Comments