‘অব্যাহত সামরিক অভিযানের’ মধ্যেই মিয়ানমারে নির্বাচন কাল

মিয়ানমারে নির্বাচন বয়কটের আহ্বান জানিয়ে নাগরিকদের বিক্ষোভ। ছবি: সংগৃহীত

সামরিক অভ্যুত্থানের পর পাঁচ বছর ধরে চলমান গৃহযুদ্ধের মধ্যেই মিয়ানমারে আগামীকাল রোববার শুরু হতে যাচ্ছে সাধারণ নির্বাচন। 

দেশটির রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম গ্লোবাল নিউ লাইট অব মিয়ানমারের তথ্য অনুযায়ী, ৩৩০টি প্রশাসনিক অঞ্চলের মধ্যে ২৬৫টি এলাকায় নির্বাচন আয়োজন করেছে জান্তা সরকারের অধীনে থাকা প্রশাসন।

তবে, বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো নাগরিকদের ভোটকেন্দ্র না যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।

২৮ ডিসেম্বর ও ১১ জানুয়ারি—প্রথম দুই ধাপে মোট ২০২টি অঞ্চলে ভোটগ্রহণ হবে। তৃতীয় ধাপে আগামী ২৫ জানুয়ারি ৬৩টি অঞ্চলে ভোট অনুষ্ঠিত হবে। 

ভোট গণনা ও নির্বাচনের ফল ঘোষণার তারিখ এখনো নির্ধারণ করা হয়নি।

মিয়ানমারের যেসব এলাকায় নির্বাচন হচ্ছে। ছবি: সংগৃহীত

সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার প্রতিবেদনে এ নির্বাচনকে 'কমেডি শো' হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।

এতে বলা হয়, জান্তা প্রধান মিন অং হ্লাইংয়ের নেতৃত্বাধীন সরকার এই নির্বাচনের আয়োজন করেছে, যা ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমালোচনার মুখে। নির্বাচনের আগে নতুন আইনে গ্রেপ্তার অভিযান চালানো হয়েছে। 

গতকাল শুক্রবার ইয়াঙ্গুনে দীর্ঘদিনের কারফিউ তুলে নেওয়া হলেও বিরোধী ও বিদ্রোহী সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মি নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় সামরিক অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এ অবস্থায় জনগণের মধ্যে ভয় ও অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে।

মিয়ানমারের সংবাদমাধ্যম ইরাবতির প্রতিবেদনে বলা হয়, জান্তা প্রধান মিন অং হ্লাইং সম্প্রতি এক বক্তব্যে বলেছেন, মানুষ যেন এমন প্রার্থীদের ভোট দেয় যারা সামরিক বাহিনীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে কাজ করতে সক্ষম।

নির্বাচনে কারা অংশ নিচ্ছে

মিয়ানমারের নির্বাচনে সেনা সমর্থিত দল। ছবি: সংগৃহীত

২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে নোবেলজয়ী অং সান সুচি সরকারের বিরুদ্ধে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে। সুচির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি ২০১৫ ও ২০২০ সালে নির্বাচনে জয়ী হয়েছিল, কিন্তু এবার তারা অংশ নিতে পারছে না।

এবারের নির্বাচনে মূলত ৬টি দল কেন্দ্রীয় পর্যায়ে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করছে। যাদের মধ্যে সামরিক সমর্থিত ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির (ইউএসডিপি) জেতার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। ইউএসডিপি জিতলে মিন অং হ্লাইং শক্তিশালী অবস্থানে থাকবেন। 

মিয়ানমারে জান্তা সমর্থিত দলের নেতা। ছবি: সংগৃহীত

মানবিক সংকট

রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলমান গৃহযুদ্ধ ও একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগ—বিশেষ করে মার্চে বড় ধরনের ভূমিকম্পের পর দেশটির মানবিক পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। 

এতে আরও বলা হয়, ক্ষমতাসীন সামরিক জান্তা দেশের খাদ্য সংকটের তথ্য গোপন করতে গবেষক ও ত্রাণকর্মীদের ওপর চাপ দিয়েছে। একইসঙ্গে অভ্যুত্থানের পর থেকে সাংবাদিকদের ওপরও কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে।

জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, মিয়ানমারের প্রায় ৫ কোটি ১০ লাখ মানুষের মধ্যে ২ কোটি মানুষের জরুরি মানবিক সহায়তা প্রয়োজন। মূল্যস্ফীতির কারণে দেশের প্রায় অর্ধেক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে। 

সংস্থাটি আরও জানায়, ৫ বছর ধরা চলমান সংঘাতে এখন পর্যন্ত বাস্তুচ্যুত হয়েছেন ৩৬ লাখের বেশি মানুষ এবং নিহত হয়েছেন ৬,৮০০-এর বেশি বেসামরিক নাগরিক। 

জাতিসংঘের মতে, মিয়ানমার বিশ্বের সবচেয়ে কম অর্থায়ন পাওয়া ত্রাণ কার্যক্রমগুলোর একটি। এখন পর্যন্ত প্রয়োজনীয় সহায়তার মাত্র ১২ শতাংশ তহবিল পেয়েছে দেশটি। 

আগামী বছর ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ তীব্র খাদ্য সংকটে পড়বে এমন আশংকার কথা জানিয়েছে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি। এর মধ্যে অন্তত ১০ লাখ মানুষের জীবনরক্ষাকারী সহায়তা প্রয়োজন হবে।

নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন

কারাগারে বন্দি প্রধান বিরোধী দলীয় নেত্রী সুচি

অং সান সুচিসহ প্রধান বিরোধী দলের অধিকাংশ নেতাদের কারাবন্দি রাখা, জনপ্রিয় রাজনৈতিক দলকে ভোটে অংশ নিতে না দেওয়া এবং বিরোধী সশস্ত্র গোষ্ঠী নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় সামরিক অভিযান অব্যাহত রাখা— নির্বাচনের বৈধতা ও স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। 

সংবাদমাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের অর্ধেকের বেশি এলাকাকে বাইরে রেখে কেবলমাত্র জান্তা নিয়ন্ত্রিত এলাকায় ভোট কতোখানি গ্রহণযোগ্য হবে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। 
এছাড়া প্রথমবারের মতো সরকারের ডিজাইন করা ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন ব্যবহার করা হচ্ছে, যা ভোটের বৈধতা নিয়ে আরও অনিশ্চয়তা তৈরি করবে।

প্রথমবারের মতো ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের ব্যবহার। ছবি: সংগৃহীত

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, গৃহযুদ্ধপূর্ণ এই পরিস্থিতিতে নির্বাচনের মাধ্যমে স্থিতিশীলতা আনা কঠিন।

তবে জান্তা সরকারের দাবি, এ নির্বাচনে জনগণের সমর্থন রয়েছে। 

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ও স্বাধীন পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলোও জান্তা সরকারের নির্বাচন আয়োজনকে 'লজ্জাজনক' অ্যাখ্যা দিয়েছে।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলির সংগঠন আসিয়ান জানিয়েছে, তারা ভোট অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে কি না, তা দেখার জন্য পর্যবেক্ষক পাঠাবে না।

নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, কেবলমাত্র চীন এ নির্বাচনের সমর্থন দিয়েছে। 

যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও কম্বোডিয়া ইঙ্গিত দিয়েছে, নির্বাচন হলে বিরল প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর মিয়ানমারের সাথে ব্যবসা পুনরায় শুরুর ন্যায্যতা পাবে। 

গত মাসে মিয়ানমারের 'অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন' অনুষ্ঠানের পরিকল্পনাকে 'উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির' প্রমাণ হিসেবে উল্লেখ করে ট্রাম্প প্রশাসন। একইসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় নেওয়া মিয়ানমারের শরণার্থীদের দেশে ফেরত যাওয়ার নির্দেশ দেয়। 

সর্বশেষ পরিস্থিতি

রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, নির্বাচনকে সামনে রেখে সম্প্রতি মিয়ানমারের বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলগুলোতে হামলা বাড়িয়েছে সামরিক বাহিনী। 

গত ৫ ডিসেম্বর সাগাইং অঞ্চলে ফুটবল খেলার মাঠে বিমান হামলায় ১৮ বেসামরিক মানুষ ও ১০ ডিসেম্বর রাখাইনে হাসপাতালে বিমান হামলায় কমপক্ষে ৩৪ জন নিহত হয়। 

গত ২৩ ডিসেম্বর জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক প্রধান ভলকার টুর্ক এক বিবৃতিতে বলেন, 'মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন সামরিক জান্তা আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে দেশটির নাগরিকদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ভোট দিতে বাধ্য করছে। উদ্দেশ্য পূরণে সহিংসতা ও ভয়ভীতিকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে জেনারেল মিন অং হ্লাইং-এর সরকার।'

অন্যদিকে দেশটির বিদ্রোহী গোষ্ঠী জনগণকে ভোটকেন্দ্র থেকে দূরে থাকার জন্য সতর্ক করেছে এবং ভোটকেন্দ্রে যারা যাবে তাদের ওপর সহিংসতার হুমকি দিয়েছে।

 

Comments

The Daily Star  | English

Khaleda Zia laid to eternal rest

Buried with state honours beside her husband Ziaur Rahman

12h ago