যুক্তরাষ্ট্রে নতুন যুগের সূচনায় জোহরান মামদানি
মার্কিন বামপন্থিদের আস্থার প্রতীক জোহরান মামদানি অবশেষে নিউইয়র্কের মেয়র হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব নিতে চলেছেন। তরুণ এই রাজনীতিবিদ প্রচলিত প্রথা ভেঙে অনাড়ম্বর এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শপথ নেবেন।
আজ বুধবার এই তথ্য জানিয়েছে এএফপি।
অনাড়ম্বর শপথ
আজ দিবাগত রাত ১২টায় ২০২৬ সালকে স্বাগত জানাবে বিশ্ববাসী। এই মাহেন্দ্রক্ষণে একটি পরিত্যক্ত ভূগর্ভস্থ রেলস্টেশনে (সাবওয়ে স্টেশনে) শপথ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় ও সমৃদ্ধ শহরটির দায়িত্বভার নেবেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত জোহরান মামদানি।
সব কিছু ঠিক মতো চললে তিনিই হতে যাচ্ছেন বিশ্ব অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র নিউইয়র্ক মহানগরীর প্রথম মুসলিম মেয়র।
জোহরান মামদানির কার্যালয় থেকে বলা হয়েছে—নতুন মেয়র জনগণের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে চান। শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানকে সাদাসিধে রাখার সিদ্ধান্তে তার প্রতিফলন ঘটেছে।
পুরনো সিটি হল সাবওয়ে স্টেশনের ওই অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে জোহরান মামদানিকে শপথ পড়াবেন নিউইয়র্কের অ্যাটর্নি জেনারেল লেটিশিয়া জেমস। সে সময় মামদানির পরিবারের সদস্যরা থাকবেন।
এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমেই মেয়র হিসেবে তার মেয়াদ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হবে।
বিপুল প্রত্যাশার চাপ
নির্বাচনী প্রচারণায় ৩৪ বছর বয়সী ডেমোক্র্যাট নেতা জোহরান মামদানি নিউইয়র্কবাসীর জীবনযাপনের খরচে রাশ টানার অঙ্গীকার করেছিলেন।
প্রায় এক বছর আগেও অজানা-অচেনা মানুষ ছিলেন জোহরান মামদানি। নিজের নির্বাচনী এলাকাতেও খুব বেশি মানুষ তাকে চিনতো না। তা সত্ত্বেও, জনকল্যাণমুখী নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি তার হাতে তুলে দিয়েছে জনগণের ম্যান্ডেট।
তার প্রতিশ্রুতির মধ্যে আছে সরকারি বাড়ি ভাড়া বাড়তে না দেওয়া, সব শিশুর জন্য স্বাস্থ্যসেবা ও বিনা ভাড়ায় বাসে চড়ার সুযোগ।
বিপুল প্রত্যাশা নিয়ে নিউইয়র্কবাসী তার দিকে চেয়ে আছেন। তিনি কি পারবেন এই প্রত্যাশার চাপ সামলাতে? এটাই বিশ্লেষকদের মূল প্রশ্ন।
নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক জন কেইন মনে করেন, নির্বাচন শেষে 'ভোটাররা আর তাত্ত্বিক বিষয়গুলো নিয়ে আগ্রহী থাকেন না। তারা তখন প্রকৃত ফলকে বেশি গুরুত্ব দেন।'
ট্রাম্পের ভূমিকা
জোহরান মামদানির সাফল্য-ব্যর্থতায় বড় ভূমিকা রাখতে পারেন দেশটির প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
রিপাবলিকান নেতা ট্রাম্প নিজেও নিউইয়র্কের সাবেক বাসিন্দা। তিনি জোহরান মামদানির সমালোচনায় বারবার মুখর ছিলেন। তবে গত নভেম্বরে দুই নেতা হোয়াইট হাউসে অত্যন্ত সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে বৈঠক করায় তা বিশ্লেষকদের বিস্মিত করে।
কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও অধ্যাপক লিঙ্কন মিচেলের মতে, বৈঠকটি পুরোপুরি জোহরানের পক্ষে গেছে। 'এর চেয়ে ভালো কিছু হওয়া সম্ভব ছিল না তার জন্য', যোগ করেন তিনি।
তবে এই বিশ্লেষক সতর্ক করে বলেন, খুব দ্রুতই ট্রাম্প-মামদানি সম্পর্ক তিক্ততায় মোড় নিতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে অভিবাসীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছেন ট্রাম্প। দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে এই অভিযান। অপরদিকে, অভিবাসীদের সুরক্ষা দেওয়ার প্রতিজ্ঞা করেছেন জোহরান মামদানি।
এ বিষয়টি নিয়ে দুই নেতা বাগবিতণ্ডায় জড়াতে পারেন বলেও আশঙ্কা অনেকের।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প গত নভেম্বরের মেয়র নির্বাচনের আগে জোহরান মামদানিকে জেতানোর পরিণাম নিয়ে নিউইয়র্কবাসীদের সতর্ক করেন। তিনি মামদানিকে 'উন্মাদ কমিউনিস্ট' বলে গালি দেওয়ার পাশাপাশি নিউইয়র্কে কেন্দ্রীয় সরকারের তহবিল কমিয়ে দেওয়ার হুমকি দেন।
অপরদিকে, জোহরান মামদানি ট্রাম্পকে 'ফ্যাসিবাদী' আখ্যা দেন।
বিতর্ক থাকলেও আছে আশার আলো
নতুন দায়িত্বে যোগ দিয়েই জোহরান মামদানি ছোটখাটো বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন। তিনি কুইনসের ভাড়া বাড়ি ছেড়ে ম্যানহাটনে মেয়রের জন্য নির্ধারিত বিলাসবহুল বাড়িতে উঠেছেন।
জীবনযাপনের খরচ কমানো, বাড়ি ভাড়াকে সাধ্যের মতো রাখার প্রতিশ্রুতি দেওয়া মেয়রের জন্য এই উদ্যোগ কতটা যৌক্তিক, তা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন।
তবে এ ক্ষেত্রে জোহরানের যুক্তি, নিরাপত্তার কারণেই মূলত তিনি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
মা-বাবা ভারতীয় হলেও জোহরান মামদানির জন্ম উগান্ডায়। সাত বছর বয়সে পরিবারের সঙ্গে নিউইয়র্কে থিতু হন জোহরান। সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান জোহরান মামদানি খুব বেশিদিন আগে রাজনীতিতে প্রবেশ করেননি। মেয়র পদে নির্বাচিত হওয়ার অল্প সময় আগে তিনি নিউইয়র্ক রাজ্যের স্থানীয় পার্লামেন্টের সদস্য হন।
নিজের অনভিজ্ঞতাকে পুষিয়ে নিতে তিনি বেশ কয়েকজন অভিজ্ঞ ও চৌকস উপদেষ্টা নিয়োগ দিয়েছেন। তাদের বেশিরভাগই সাবেক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসনের সদস্য ও প্রাক্তন মেয়রদের সহযোগী।
পাশাপাশি, জোহরান মামদানি নিউইয়র্কের গুরুত্বপূর্ণ ও শীর্ষ ব্যবসায়ীদের সঙ্গেও বৈঠক ও আলোচনা শুরু করেছেন।
কেউ কেউ পূর্বাভাস দিয়েছিল—জোহরান মামদানি বিজয়ী হলে দলে দলে ব্যবসায়ী ও ধনাঢ্য নাগরিকরা নিউইয়র্ক ছাড়বেন। তবে আবাসন-খাত সংশ্লিষ্টরা এই পূর্বাভাস নাকচ করেছেন। বাস্তবেও এখনো এ ধরনের কোনো প্রবণতা দেখা যায়নি।
ফিলিস্তিনিদের অধিকার আন্দোলনের সক্রিয়কর্মী জোহরান মামদানির কাছ থেকে ইহুদি সম্প্রদায় অন্তর্ভুক্তিমূলক নেতৃত্ব প্রত্যাশা করছে।
তার এক সাম্প্রতিক উদ্যোগে ইহুদিরা সামান্য হলেও আশ্বস্ত হয়েছে বলা যায়। জোহরান মামদানি মেয়র হওয়ার পর যাদেরকে সহকর্মী করছেন, তাদের মধ্যে এক নারীর বিরুদ্ধে ইহুদিবিদ্বেষের অভিযোগ আসে। জানা যায়, দীর্ঘ কয়েক বছর আগে তিনি ইহুদিবিদ্বেষী বার্তা সমাজমাধ্যমে প্রকাশ করেছিলেন।
পরে ওই কর্মী পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
সব মিলিয়ে বলা যায়—বিপুল প্রত্যাশার মুখেও আশার আলো ছড়াচ্ছেন নতুন যুগের নেতা জোহরান মামদানি। সংশ্লিষ্টদের প্রত্যাশা, একটি নতুন যুগের সূচনা করতে যাচ্ছেন এক সময়ের গায়ক ও বহুভাষিক সমাজে একাধিক ভাষায় কথা বলতে পারা মেয়র জোহরান মামদানি।

Comments