শিশুদের ওপর বডি শেমিংয়ের প্রভাব ও পরিবারের করণীয়

শিশুকে বডি শেমিং

একদিন এক শিশু চোখে পানি নিয়ে বাড়ি ফিরল। না, রাস্তায় কোনো বুলিংয়ের শিকার হয়নি সে। বরং এক আত্মীয় ঠাট্টা করে বলেছিল, 'তুই তো একদম রসগোল্লা হয়ে গেছিস!' সবাই হেসেছিল। কিন্তু শিশুটি হাসেনি।

এভাবে বাংলাদেশের অনেক পরিবারে শিশুদের শারীরিক গঠন নিয়ে বেশ হালকাভাবে হাসতে হাসতে বিভিন্ন মন্তব্য করা হয়। কখনো বা 'ভালোবাসা' দেখানোর ছলে নাকি তারা এসব বলে থাকেন। কিন্তু এসব কথার প্রভাব অনেক গভীর এবং তা শুরু হয় অনেক কম বয়স থেকেই। শরীর নিয়ে হীনমন্যতা টিনএজ বা কৈশোর থেকে শুরু হয় না, এটি শুরু হয় শৈশব থেকে। হয় তাদের কাছ থেকেই, যাদের শিশুরা সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করে।

বডি শেমিং আসলে কী?

ফরিদপুর মেডিকেল কলেজের শিশু, কিশোর ও পারিবারিক মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদের মতে, কারো শারীরিক গঠন, মুখের বৈশিষ্ট্য, গায়ের রং, উচ্চতা বা ওজন নিয়ে নেতিবাচক বা সমালোচনামূলক মন্তব্য করাকে বডি শেমিং বলা হয়।

তিনি বলেন, 'এটি হতে পারে সরাসরি অপমান, বিদ্রূপাত্মক মন্তব্য বা এমনকি সূক্ষ্ম রসিকতা যা ওই ব্যক্তি বুঝতে পারে। এ ধরনের মন্তব্য সবসময় মানুষের কাছ থেকেই আসে না। গণমাধ্যম, সিনেমা, বিজ্ঞাপন, এমনকি গানের কথার মাধ্যমেও বডি শেমিংকে প্ররোচনা দেওয়া হয়।'

শিশুদের ওপর বডি শেমিংয়ের প্রভাব

বড়দের জন্য বিদ্রূপাত্মক মন্তব্য তাদের জন্য কষ্টদায়ক হতে পারে, কিন্তু একটি শিশুর জন্য সেটি নীরবে তার নিজের সম্পর্কে ভাবার ধরনটাই পাল্টে দিতে পারে।

ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, 'শিশু ও কিশোর-কিশোরীরা একটি গুরুত্বপূর্ণ মানসিক ও শারীরিক বিকাশের পর্যায়ে থাকে। এই কারণে বডি শেমিং বা শরীর নিয়ে মন্তব্য তাদের ওপর তাৎক্ষণিক এবং দীর্ঘমেয়াদি- এই দুই রকম প্রভাবই ফেলতে পারে।'

প্রাথমিকভাবে এর প্রভাব হিসেবে দেখা যায় আত্মবিশ্বাসে ঘাটতি, সামাজিক কার্যক্রম থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া, উদ্বেগ এমনকি বিষণ্ণতার মতো সমস্যা। যেসব শিশুকে 'খুব মোটা' বা 'খুব কালো' বলে ঠাট্টা করা হয়, তারা অন্যদের এড়িয়ে চলতে পারে, দলগত কাজে অংশ নিতে চায় না, এমনকি নিজের বাসায়ও চুপচাপ হয়ে যেতে পারে।

কিন্তু বডি শেমিংয়ের ক্ষতির পরিমাণ এখানেই থেমে থাকে না।

তিনি সতর্ক করে বলেন, 'একটি বড় উদ্বেগ হলো শিশুদের মধ্যে ইটিং ডিজঅর্ডার তৈরি হতে হতে পারে, যা এক ধরনের খাওয়ার অসুস্থতা। অনেক সময় তারা লুকিয়ে অতিরিক্ত খাওয়া শুরু করে কিংবা বুলিমিয়ার মত অভ্যাস গড়ে ওঠে। যার ফলে তারা খাওয়ার পর জোর করে বমি করে ফেলে।

বুলিং চলতে থাকলে শিশুদের শারীরিক স্বাস্থ্যের ওপরও এর প্রভাব পড়ে, যা দীর্ঘমেয়াদে মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনতে পারে এবং এটা সব সমস্যার মূল কারণ হয়ে উঠতে পারে।'

'বডি শেমিং আমাকে সবার থেকে দূরে ঠেলে দিয়েছে'

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যক্তি শেয়ার করেছেন কীভাবে তার ওপর বডি শেমিং এর মারাত্মক প্রভাব পড়েছিল।

তিনি বলেন, 'প্রাইমারি স্কুলে পড়ার সময় বাচ্চারা আমাকে মোটা বলে ডাকত। হ্যাঁ, আমি খুব কষ্ট পেতাম, মন খারাপ হতো… মনে হতো আমি ক্লাসের সবার থেকে আলাদা, আর অনেক দূরে।'

তিনি আরও বলেন, 'এই কথাগুলো বেশিরভাগই ''বন্ধুদের'' কাছ থেকেই আসত। এখনও এসবের প্রভাব মনে রয়ে গেছে। এখনো যখন কেউ মজা করে কিছু বলে, ভেতরে একটা দুর্বলতা কাজ করে। মনে হয় আমি একা, আত্মবিশ্বাসও কমে যায়।'

যখন তাকে জিজ্ঞেস করা হয়, এসব মন্তব্য থেকে বাঁচার জন্য তিনি নিজেকে পরিবর্তনের চেষ্টা করেছিলেন কি না- তার জবাবটা ছিল খুব সোজাসাপ্টা,  'এখনও চেষ্টা করছি। কিন্তু খুব কঠিন।'

'বুলিং মোটেই ভালো কিছু না। মাঝে মাঝে কেউ বললে হয়তো মাফ করা যায়… কিন্তু বারবার? একেবারেই না', যোগ করেন তিনি।

আরেক ভুক্তভোগী শুভ (১৯) জানান, একবার স্কুলের কোচ তাকে দেখে হাসতে হাসতে বলেছিলেন, 'তোমাকে তো বাতাস উড়িয়ে নিয়ে যাবে।'

'আমি সবার সামনে অপমানিত হয়েছিলাম। এরপর আমি ক্রিকেট খেলাই ছেড়ে দিই', যোগ করেন তিনি।

এই ছোট ছোট কথাগুলো অনেক সময় শিশুর মনে ধীরে ধীরে বিষের মতো কাজ করে। তার আনন্দ আর আত্মবিশ্বাসকে ধ্বংস করে দেয়।

বাবা-মায়ের ভূমিকা

বাচ্চারা বুলিংয়ের শিকার হলে প্রথম বাবা-মায়ের এগিয়ে আসা প্রয়োজন।

ডা. হেলাল আহমেদ বলেন, 'বাবা-মা সন্তানদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারেন। ভালোবাসার নামে আত্মীয়-স্বজনের বুলিং থেকে সন্তানদের রক্ষা করা প্রতিটি বাবা-মায়ের দায়িত্ব। "বাদ দাও" না বলে তাদের অনুভূতিগুলো বোঝার চেষ্টা করতে হবে। তাদের জন্য একটি নিরাপদ জায়গা তৈরি করতে হবে। বুলিংয়ের শিকার হলে বাচ্চাকে "ওজন কমাও" বা "এটা নিয়ে এত ভাবার কিছু নেই"  এ ধরনের কথা একেবারেই বলা উচিত না। বাচ্চাদের আত্মবিশ্বাস ও আত্মসম্মান গড়ে তোলার শিক্ষা দিতে হবে। যদি স্বাস্থ্যজনিত কোনো বিষয় থাকে, তাহলে পুরো পরিবার মিলে স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া ও খেলাধুলার মতো অভ্যাস গড়ে তোলায় উৎসাহ দিতে পারেন। সন্তান যেন অন্যের কথায় হীনমন্যতায় না ভোগে।'

'বুলিং' প্রেরণাদায়ক নয়

বাংলাদেশের অনেক পরিবারে এখনও অনেকে মনে করা হয়, 'তুমি মোটা হয়ে গেছ' বা 'তুমি খুব রোগা' বলা মানে খুব উপকার করা। কিন্তু ডা. হেলাল আহমেদ এর বিরোধিতা করেন।

তিনি বলেন, 'আমার পরামর্শ খুব সহজ—কারো শরীর নিয়ে মন্তব্য করা কখনই তাকে কোনোভাবে সাহায্য করে না। এটা সবসময়ই ক্ষতিকর। বিজ্ঞানভিত্তিক প্রমাণ আছে যে, এই ধরনের মন্তব্য কাউকে অনুপ্রাণিত করে না, বরং আত্ম-মূল্যবোধকে ধ্বংস করে দেয়।'

তিনি প্রাপ্তবয়স্কদের প্রতি আহ্বান জানান, যেন তারা এই তথাকথিত 'মোটিভেশনাল নিষ্ঠুরতা'র পরিবর্তে সম্মানজনক ও উৎসাহব্যঞ্জক কথাবার্তায় মনোযোগ দেন।

তিনি বলেন, 'যদি পরিবারের কেউ বারবার শরীর নিয়ে অপমানজনক মন্তব্য করে তাহলে অন্যদের হস্তক্ষেপ করতে হবে। নীরব দর্শক হওয়া মানে সেই ক্ষতির অংশ হয়ে যাওয়া।'

বডি শেমিং নীরবভাবে বেশ বড় ক্ষতি করে ফেলতে পারে। কিন্তু সচেতনতা আর যত্ন দিয়ে সেটিকে থামানো সম্ভব।

শিশুদের এমনভাবে বড় হওয়া উচিত নয়, যেন তাদের মূল্য নির্ধারণ হয় ওজনের কাঁটা বা কারো একটা মন্তব্যে। তারা বড় হোক সহজাতভাবে দৌড়ে, খেয়ে, হেসে, নিঃশর্তভাবে নিজেকে প্রকাশ করে। যদি ক্ষতির শুরু হয় কথা দিয়ে, তবে নিরাময়ের শুরুও হতে হবে সেখান থেকেই।

অনুবাদ করেছেন সৈয়দা সুবাহ আলম

                                     

Comments

The Daily Star  | English

US tariff at 20% 'satisfactory', says Khosru

Will comment after knowing full details of the deal

52m ago