মজার ছলে শিশুদের জীবনমুখী শিক্ষা দিচ্ছে কাকতাড়ুয়া পাপেট থিয়েটার

পাপেট শো

বিভিন্ন ধরনের কাল্পনিক চরিত্রগুলো সবসময়ই শিশুদের আকর্ষণের কেন্দ্রে থাকে। এসব চরিত্র হতে পারে কার্টুনে বা পাপেট শোতে দেখা কিংবা কমিকস বইয়ে পড়া। এই চরিত্রগুলো শিশুকে যেমন বিনোদন দেয়, তাকে নানা কিছু শেখায়ও। একইসঙ্গে শিশুর মানসিক বিকাশেও এগুলো দারুণ ভূমিকা রাখতে পারে।

আধুনিক প্রযুক্তির এই সময়ে পাপেট শো আর আগের মতো জনপ্রিয় নেই। বরং এটা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, শিল্পটি এখন অনেকটা মৃতপ্রায়। কিন্তু এরপরেও সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে 'কাকতাড়ুয়া পাপেট থিয়েটার'। বেশ সাহসিকতার সঙ্গেই তারা করে যাচ্ছে এমন কিছু কাজ, যার প্রশংসা না করলেই নয়।

পাপেট শো

কাকতাড়ুয়া কী?

কাকতাড়ুয়া হলো খড় দিয়ে তৈরি মানব আকৃতির পুতুল বা মূর্তি। সাধারণত যার পরনে থাকে ঢিলেঢালা পুরনো পোশাক। কখনও কখনও মাথায় থাকে টুপি, যে মাথাটি তৈরি করা হয় মাটির হাঁড়ির ওপর চোখ-নাক-মুখ এঁকে। মূলত কৃষিজমির বিভিন্ন স্থানে এগুলোকে বসানো হয়। উদ্দেশ্য পাখিদের ভয় দেখানো, যেন তারা জমিতে এসে ফসল নষ্ট না করে।

ঠিক একইভাবে কাকতাড়ুয়া পাপেট থিয়েটারের লক্ষ্য হলো সমাজ থেকে সমস্ত নেতিবাচকতা ও কুসংস্কার দূর করা, জানালেন এর প্রতিষ্ঠাতা আসাদুজ্জামান আশিক।

তিনি বলেন, এ কারণেই প্রতীকী হিসেবে কাকতাড়ুয়ার নামে থিয়েটারের নাম দেওয়া হয়েছে।

২০১৬ সাল থেকে পাপেট নিয়ে কাজ শুরু করেছেন আশিক। তবে কাকতাড়ুয়া পাপেট থিয়েটারের জন্ম ২০১৯ সালে।

পাপেট শো

পাপেট শোর চরিত্রেরা

কাকতাড়ুয়া পাপেট থিয়েটারে অন্তত ৩০টি পাপেট চরিত্র রয়েছে, যেগুলো বিভিন্ন শোতে মঞ্চায়ন করা হয়। যার মধ্যে কিছু মৌলিক চরিত্র, যেগুলো কাকতাড়ুয়া পাপেট থিয়েটারের সদস্যরাই সৃষ্টি করেছেন। কিছু আছে পৌরাণিক চরিত্র, যেগুলো পুরনো বা ঐতিহাসিক গল্প নতুন করে মঞ্চায়নের সময় ব্যবহার করা হয়।

বাকি চরিত্রগুলো তৈরি করা হয়েছে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বাংলা বইয়ের বিভিন্ন গল্প থেকে। যেন ওই গল্পগুলো মঞ্চে ফুটিয়ে তোলা হলে শিশুরা সহজেই গল্প ও এর অন্তর্নিহিত অর্থ বুঝতে পারে।

আশিক বলেন, `কেবল বই পড়ে যাওয়া খুব সাধারণ বিষয়। কিন্তু আপনি যদি সেই পড়ার বিষয়টাকেই একটি নাটক বা অনুষ্ঠানের মাধ্যেম শিশুদের সামনে উপস্থাপন করেন তাহলে তারা সেটা ভীষণ পছন্দ করবে, সহজেই সেগুলো মনে রাখবে। আর এটা শেখানোর দারুণ একটা উপায়ও হতে পারে। অপু আর দীপুর গল্প আমাদের সবচেয়ে জনপ্রিয় অনুষ্ঠানগুলোর একটি। যেখানে শিশুদের মারামারি ও ঝগড়ার কুফল সম্পর্কে শেখানো হয়।'

কাকতাড়ুয়া পাপেট থিয়েটারের সদস্য সংখ্যা ১০ জন। যার অন্যতম মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম রাসেল, যিনি বেশিরভাগ পাপেটের নির্মাতা। পাপেট ও সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের দায়িত্বে রয়েছেন প্রণয় সরকার। এছাড়া বাকি সদস্যরা প্রয়োজনীয় অন্যান্য কাজ করেন, যাদের মিলিত পরিশ্রমেই এক একটি অনুষ্ঠান বাস্তবে রূপ নেয়।

পাপেট চরিত্রগুলো কখনও কখনও বিভিন্ন গল্প থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তৈরি করা হয়। কখনও এগুলো প্রদর্শনীর গল্প ও প্রয়োজনের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়। আবার এমনও হয় যে, দলের সদস্যরা অনেক চিন্তাভাবনার পর একটি চরিত্র সৃষ্টি করেন।

প্যালিয়েটিভ কেয়ারে ও শিক্ষাদানে পাপেটের ব্যবহার

পাপেট নিয়ে সবচেয়ে বড় অর্জন কী, তা জানতে চেয়েছিলাম আশিকের কাছে। জবাবে তিনি বললেন, `নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও আমি পাপেট নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি কারণ এর মাধ্যমে শিশুদের আনন্দ দিতে পারছি। আমি সিআরপি, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ক্যান্সার রিসার্চ অ্যান্ড হসপিটাল (এনআইসিআরএইচ) এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কয়েকটি শো করেছি। সেখানে এমন শিশুদের সামনে আমরা পাপেট শো প্রদর্শন করেছি যারা শারীরিকভাবে ভীষণ যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল। পাপেট শোয়ের মাধ্যমে কিছু সময়ের জন্য হলেও তাদের মুখে হাসি ফোটাতে পেরেছি আমরা। অনুষ্ঠান শেষে তারা পাপেটগুলোর সঙ্গে হাত মেলাতে চেয়েছিল। একটা ছোট্ট মেয়ে তার ক্যানুলা পরা হাত আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়েছিল। সেই মুহূর্তটি আমি ভুলতে পারি না, সবসময় সেই দৃশ্যটি আমার সঙ্গে পথ চলে।'

নিজের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে আশিক বলেন, 'অনেক মানুষই জানেন না যে, পাপেটকে শিশুর প্যালিয়েটিভ কেয়ারের কাজে কিংবা কিছু শেখানোর জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। পাপেটের বিষয়ে শিশুরা দারুণ আগ্রহী, ফলে পাপেট ব্যবহার করে শিশুদের জন্য আরও অনেক কিছু করা যেতে পারে। এখন শিশুরা ইলেকট্রনিক পর্দায় ভীষণ মগ্ন থাকে। এমন বাস্তবতায় তাদের পর্দার বাইরে টেনে আনতে পাপেট শো দারুণ বিকল্প হতে পারে।'

তবে তিনি এটা জানালেন, পাপেট শোয়ের প্রতিক্রিয়া যত ভালোই হোক না কেন, এর বিস্তারে বা বিকাশে অর্থ সংকট বড় অন্তরায়।

কাকতাড়ুয়া পাপেট থিয়েটার বলা যায় টেনেটুনে চলে। এটিকে পেশা হিসেবে নেওয়া প্রায় অসম্ভব। স্টুডিওর ভাড়া, পুতুল তৈরি ও সেগুলো রক্ষণাবেক্ষণ, প্রদর্শনীর জন্য বিভিন্ন স্থানে যাওয়াসহ অন্যান্য খরচ চালিয়ে যাওয়া দিন দিন কঠিন হয়ে পড়ছে। তবু আশিক হাল ছাড়েননি।

প্রতিক্রিয়া

শিশুদের সামনে পরিবেশিত একটি পাপেট শো সরাসরি দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম। সেখানে দেখেছি, শিশুরা কেবল পাপেটের বিষয়ে আগ্রহীই নয়, তারা পাপেটগুলোর সঙ্গে কথা বলতে চায়, যোগাযোগ করতে চায়। পুরো অনুষ্ঠানজুড়েই তারা শেখার পাশাপাশি পাপেটের সঙ্গে সঙ্গে কথা বলেছে, মাথা নেড়েছে, একাত্ম হয়েছে। এটি পুরোপুরি পাপেটিয়ার বা পাপেট পরিচালকারীদের কৃতিত্ব। সেই সঙ্গে এটাও ঠিক যে, পাপেট চরিত্রগুলোর সঙ্গে শিশুরা একেবারে মিশে গিয়েছিল। এই ধরনের অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শিশুদের বিভিন্ন বিষয় শেখানো যেতে পারে। বিশেষ করে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের জন্য এটি দারুণ শিখনপদ্ধতি হতে পারে।

বিভিন্ন সময়ে অনুষ্ঠান মঞ্চায়নের পর শিশুদের ইতিবাচক সাড়া পাওয়ায়, আশিক ও তার দল সামনের দিনগুলোয় নতুন নতুন সম্ভাবনার ইঙ্গিত পাচ্ছেন।

তিনি বলেন, 'পাপেট শোয়ের বিষয়ে কেউ আগ্রহী হলে কেবল তাকে একটি টেলিফোন করলেই চলবে। বাকি আলাপ তিনি নিজের আগ্রহেই সেরে নেবেন।'

নব্বইয়ের দশকের শিশুরা পুতুল বা পাপেটের সঙ্গেই বড় হয়েছে। সময়ের ব্যবধানে এখন সেসব পুতুল বা পাপেট স্মৃতিকাতরতার উপাদানে পরিণত হয়েছে। ঠিক যেভাবে বায়োস্কোপ বিলুপ্তির পথে চলে, সেভাবেই।

কাকতাড়ুয়া পাপেট থিয়েটার এ দুটি জিনিসকেই নতুন জীবন দিয়েছে এবং কেবল এগুলোকে জনপ্রিয় করার কাজই করছে না; পাশাপাশি এগুলোকে কীভাবে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা যায়, সেজন্যও কাজ করছে। তাদের এই কর্মকাণ্ড অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। সেইসঙ্গে এদিকে সবার মনোযোগও দিতে হবে, যেন তারা প্রদর্শনীগুলো চালিয়ে যেতে পারে। কারণ এ ধরনের আয়োজন কোনোকিছুর অভাবেই বন্ধ হয়ে যেতে পারে না, বন্ধ হয়ে যাওয়া উচিত না।

ছবি: কাকতাড়ুয়া পাপেট থিয়েটার

অনুবাদ করেছেন শেখ সিরাজুম রশীদ

 

Comments

The Daily Star  | English

Khaleda Zia’s body taken to Parliament Complex ahead of janaza

Janaza will be held at Manik Mia Avenue at 2pm

2h ago