ছানামুখী কেন এত মজার, রহস্য জানেন কি?

ছানামুখী
ছবি: জাওয়াদ সামি

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাম শুনলে মাথায় চলে আসে ছানামুখীর নামও। এই ছোটখাটো, ঘনকের মতো দেখতে মিষ্টিটিতে রয়েছে আলতো চিনির আবরণ। আর ভেতরে তার ভরপুর ছানার পুর। প্রায় ২০০ বছরের ঐতিহ্য ধরে রেখে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাম উজ্জ্বল করার জন্য বিখ্যাত এই ছানামুখী মিষ্টি। সুদীর্ঘ ইতিহাস আর অন্যরকম স্বাদের জন্য জেলাটির অন্যতম আকর্ষণ এই মিষ্টি।

ঐতিহ্যের স্বাদ

এ অঞ্চলের সবচেয়ে পুরোনো দোকান মহাদেব মিষ্টান্ন ভাণ্ডার অবস্থিত মহাদেব পট্টিতে। তারা প্রায় ১৮০ বছর ধরে ছানামুখী তৈরি করে আসছে। ছানামুখীর এই মিষ্টি গল্পের শুরুটা প্রথমে হয়েছিল মহাদেব পাঁড়ের হাত ধরে। তিনিই এই বিখ্যাত মিষ্টিটি সর্বপ্রথম তৈরি করেছিলেন। কাশী থেকে ভাই দূর্গাপ্রসাদের সঙ্গে কলকাতায় গিয়েছিলেন মহাদেব। সেখানে ভাইয়ের মিষ্টির দোকানে কাজ করতে করতেই মিষ্টি তৈরির কাজে পসার আসে তার।

পরে ভাইয়ের মৃত্যুর পর মহাদেব কাজের খোঁজে ব্রাহ্মণবাড়িয়া আসেন। সেখানে তিনি আশ্রয় পেলেন শিবরাম মোদকের মিষ্টির দোকানে। মহাদেব আসার পর থেকে এ দোকানের সুনামও দিন দিন বাড়তে থাকে।

মারা যাওয়ার আগে তাই শিবরাম এই দোকানটি মহাদেবের নামেই দিয়ে যান। মহাদেব ব্রাহ্মণ ছিলেন। তিনি বিয়েথাও করেননি। মৃত্যুর আগে তিনি দোকানটি পার্শ্ববর্তী একটি মন্দিরের কাছে সঁপে দিয়ে যান। সেই থেকে চার প্রজন্ম ধরে পথচলার পর, বর্তমানে এই দোকানটির দায়িত্ব পালন করছেন নারায়ণ মোদক। তিনিও সুচারুভাবে চালিয়ে যাচ্ছেন দীর্ঘ এক ঐতিহ্যের পরিক্রমা।

ছানামুখী
ছবি: জাওয়াদ সামি

স্বাদের গোপন কথা

দোকানটিতে তৈরি হওয়া ছানামুখীর রন্ধন প্রণালী এখনো সেই একই রয়ে গেছে। একইরকম যত্ন আর ভালোবাসা দিয়ে ময়রারা তৈরি করে থাকে ছানামুখী, তাই মিষ্টতাও কমেনি এক ফোঁটা। এই ধারাবাহিক প্রক্রিয়া ও একনিষ্ঠতার কারণেই মহাদেব মিষ্টান্ন ভাণ্ডার আজও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অন্যতম বিখ্যাত মিষ্টির দোকান। এর আশেপাশেও অনেক দোকান রয়েছে, যেগুলোর বেশিরভাগ এই দোকানের লোকজনেরই আত্মীয়-স্বজন।

ছানামুখীর তারকাখ্যাতি ছাড়াও মহাদেব মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে আরও রয়েছে তালের বড়া, রসমালাই, জাফরান ভোগ, রাজভোগ এবং লেডিকেনি—যার নিজস্ব ইতিহাস অত্যন্ত সমৃদ্ধ। কিন্তু এ মিষ্টিটি এখন আর পাওয়া যায় না এখানে।

দোকানটিতে ২৫ বছর ধরে কর্মরত কর্মচারী সুজিত মদন বলেন, 'এখানে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় ছানামুখী। তবে তালের বড়া আর রসমালাইও মানুষ খুব পছন্দ করে।'

ছানামুখী
ছবি: জাওয়াদ সামি

দুধেল স্বাদের মুনশিয়ানা

দক্ষ ময়রা গোপাল সরকারও এ দোকানের সঙ্গে আছেন দীর্ঘ ২৫ বছর। তিনি আমাদেরকে ছানামুখী তৈরির প্রক্রিয়াটি সম্পর্কে জানিয়েছেন। গাঁয়ের খামারিদের কাছ থেকে সংগ্রহকৃত তাজা দুধ দিয়ে শুরু হয় এর প্রাথমিক ধাপ।

তিনি বলেন, 'ছানা বানানোর জন্য তাজা দুধ ফোটাতে হবে। আধঘণ্টা পর ছানা আলাদা করতে হবে। একটি পরিষ্কার কাপড়ের মধ্যে ছানা বেঁধে পানিটা বের করে নিতে হবে। ছানা ভালো করে শক্ত হয়ে গেলে তা টুকরো করে কেটে আগে থেকে তৈরি করা চিনির শিরায় ডোবাতে হবে।'

এক কেজি ছানামুখীর দাম পড়বে ৭০০ টাকা। মানের সঙ্গে দামটাও তাল মিলিয়েই চলে। সুজিত সরকার আরও বলেন, '২০ কেজি দুধ থেকে মাত্র ৩ কেজি ছানা পাওয়া যায়। তাই দামটা একটু বেশি। তবে খাবারের মানের সঙ্গে কোনো সমঝোতা হয় না।'

ছানামুখী
ছবি: জাওয়াদ সামি

সুস্বাদের শহর

মহাদেব মিষ্টান্ন ভাণ্ডার খুবই ব্যস্ত একটি দোকান। সকাল ৭টা থেকে শুরু করে মাঝরাত পর্যন্ত চলে এর কার্যক্রম। এ এলাকায় আরও অনেক দোকান থাকলেও ছানামুখীর জন্মস্থান হিসেবে এ দোকান সবসময়ই বিশেষ প্রাধান্য পায়। খুব ছিমছাম কিন্তু সমৃদ্ধ স্বাদের কারণে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ক্রেতারা উপভোগ করে আসছেন ছানামুখীসহ আরও অনেক মিষ্টি। কেউ যদি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ঘুরতে যান, তবে একবার ছানামুখী চেখে আসতে ভুলবেন না।

২০২৪ সালে ছানামুখী জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পেয়েছে। তাই আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পরিচয়ের মুকুটে একটি ঝলমলে পালক হিসেবে ছানামুখীর নাম না বললেই নয়।

অনুবাদ করেছেন অনিন্দিতা চৌধুরী

Comments

The Daily Star  | English

Hasina can’t evade responsibility for Khaleda Zia’s death: Nazrul

In 2018, Khaleda walked into jail, but came out seriously ill, he says

2h ago