গুলিস্তানের সাচ্চু মামার বিরিয়ানি-স্টাইল ঝালমুড়ি তার গল্পের মতোই ‘স্পেশাল’

ঝালমুড়ি
ছবি: জান্নাতুল বুশরা

আপনি যদি কখনো গুলিস্তানের পথেঘাটে ঘুরে থাকেন, তাহলে এ কথা নিশ্চয়ই মানবেন যে এখানে একেবারে নিলামের মতো করে হকারদের বুলি শোনা যায়। ট্রাফিকের কোনো নিয়ম না মেনে চলা রিকশারা তো এখানকার রাজা।

এমনকি গুলিস্তানের বাসগুলোকেও দেখে মনে হয় কোনো জ্বালাও-পোড়াও অভিযানে নেমেছে। আর গুলিস্তানের রাস্তায় মানুষ তো পিঁপড়ার সারির মতো এখান ওখান থেকে উঁকি মারে। এখানকার বাতাসে এতটাই নিরলস গতির পসরা বসে যে দেখে মনে হয় কোনো জম্বি সিনেমা থেকে তুলে আনা দৃশ্য!

ঝালমুড়ি
ছবি: জান্নাতুল বুশরা

দেশের সবচেয়ে বড় মসজিদ আর স্টেডিয়াম দুটোই পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকে গুলিস্তানে। অবশ্য দাঁড়িয়ে দেখার মতো দৃশ্যের কোনো অভাব নেই এখানে। কেউ প্রস্তুত থাকুক চাই না থাকুক— গুলিস্তানের ধাক্কায় সবাই সচল হতে বাধ্য। আর এই সব পাগলামির মধ্যে একজনকে আলাদা করে দেখা যায়। লোকে তাকে সাচ্চু মামা বলে ডাকে। তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে গুলিস্তানের মাটিতে শেকড় গেড়ে আছেন এই ব্যক্তি। পুরো নাম মোহাম্মদ সাচ্চু মিয়া।

তার আশপাশের জীবন যখন ছুটে চলে, সাচ্চু মিয়া যেন থেমে থাকেন। আস্তেধীরে তার জাদুকরী ভঙ্গিতে মুড়ি মাখান। কিন্তু এই মুড়ি যে-সে মুড়ি নয়। তার কাছে এ যেন বিরিয়ানির মতোই বিশেষ কিছু — সুগন্ধি, ঝাল ঝাল আর বহু চমকে মোড়ানো একটি ঠোঙা।

প্রায় ৩৫ বছর ধরে সাচ্চু মিয়া এই একই জায়গায় (শুধু শুক্রবার ছাড়া) তার এই বিখ্যাত ঝালমুড়ি আর হালিম বিক্রি করে আসছেন। বিক্রেতা সামনে এলেই তার হাতের ঘূর্ণন জাদুর ছড়ির মতো ছড়িয়ে যায়। কুচি কুচি করে কাটা শসা, টমেটো, কাঁচা মরিচ, পেঁয়াজ, গোপন কিছু মশলা, চিকেন উইংস, ডিম এবং কখনো কখনো তার মুড়ি মাখানোর পাত্রে দেখা যায় বড় বড় মাংসের পিসও। আর ফলাফল? এমন এক ঝালমুড়ি, যার স্বাদ বিরিয়ানির হাঁড়ির কথাই বেশি মনে করাবে।

সাইনবোর্ডে 'ঝালমুড়ি এবং হালিম' দেখে আমরা এক বাটি হালিমের আশা করে পুরোটাই নিরাশ হলাম। আমাদের চেহারা দেখে মামা বুঝলেন। বললেন, 'হালিম শুধু শীতকালে পাওয়া যায় মামা!'

তখন বোঝা গেল, রন্ধনের এই জাদুকর ঋতু বদলানোর সঙ্গে সঙ্গে বিরিয়ানির মতো ঝালমুড়ি থেকে হালিমের ওস্তাদ হয়ে ওঠেন।

সাচ্চু মিয়ার গল্পটা যেন ঢাকার নিজস্ব শহুরে লোককথা। তার জন্ম ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। সেখান থেকে সাত বছর বয়সে মামার একটি শার্ট গায়ে দিয়ে তিনি চলে এসেছিলেন ঢাকায়। মামা কাজ করতেন গুলিস্তানের স্টেডিয়াম মার্কেটে। সময়টা তখন আশির দশকের শুরুর দিক। অজপাড়াগাঁর এই শিশু এই শহরে এসে থালাবাসন ধুচ্ছিল, ফুট-ফরমাশ খাটছিল আর ঢাকার ব্যস্ত রাস্তার মানচিত্র নিজের মাথায় এঁকে নিচ্ছিল। অনেক বছর ধরে এসব কাজ করে করে সাচ্চু মিয়া সব কাজই শিখলেন। এরপর নিজের ব্যবসা শুরু করলেন। ছোলাবুট, ঘুগনি, হালিম, বিরিয়ানি— কিছুই বাদ যায়নি তার তালিকা থেকে। 

এরপর গল্পে এল ১৯৮৮ সালের বন্যা। ঢাকার বেশিরভাগ অংশই ভেসে গেল। ভেসে গেল ইসলামবাগে সাচ্চু মিয়ার ছোট ঘরটিও। এরপর পরিবারের সবাই মিলে টিকাটুলিতে চলে এলেন। কিন্তু স্টেডিয়াম মার্কেটে নোঙর গাড়া সাচ্চু মিয়ার রাঁধুনি হওয়ার সেই স্বপ্নটি বাঁধা পড়ে গেল।

অনেক বছর ধরে তিনি শুধু পরীক্ষা-নিরীক্ষাই চালিয়ে গেছেন। বিরিয়ানির মশলাপাতি থেকে হালিমের রন্ধনশিল্প সবটাই তিনি মিশিয়ে দিয়েছেন তার ঝালমুড়িতে। একটু ওই মশলা, দু চিমটি অন্য মশলার সহযোগে শেষমেশ যে খাবারটি তৈরি হলো তাতেই বেড়ে গেল ক্রেতার আনাগোনা।

সাচ্চুর কথা বেশ পরিষ্কার— 'অন্য বহু বাবুর্চির চেয়ে আমি মশলাপাতি ভালো চিনি। আমি বহুদিন ধরে নিজের হাতে রান্না করে, বহু লোককে খাইয়েদাইয়ে রান্নাটা রপ্ত করেছি। আমার স্ত্রী আর ছেলে আমাকে সাহায্য করে। তাই এই ব্যবসাটা একেবারেই পারিবারিক ব্যবসা।'

আসলেই ব্যবসাটা আপাদমস্তক পারিবারিক। ছোট একটি টেবিলের পেছনে বসে সাচ্চু নিজের জাদুর ছড়ি ঘোরান। ওদিকে তার স্ত্রী বসে বিভিন্ন কায়দা-কানুন শেখাচ্ছেন তো ওদিকে ছেলে খদ্দেরদের কাছ থেকে টাকা-পয়সা সংগ্রহ করছে। আবার বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরও দিচ্ছে। অফিসগামী লোকজন, ভ্লগার আর আমাদের মতো হুটহাট কৌতূহলী সাংবাদিকরা তো রয়েছেই।

আশপাশে কাউকে জিজ্ঞেস করলে বহু গল্প জানা যায়। রাসেল মাহমুদ স্টেডিয়াম মার্কেটে কাজ করছেন এক দশকেরও বেশি সময় ধরে। তার কাছে সাচ্চু মামার প্রশংসার শেষ নেই।

তিনি বলেন, 'মামার হাতে জাদু আছে। আমি বহু জায়গা থেকে এখানে মানুষকে আসতে দেখি। গুলশান বা ধানমন্ডি থেকেও আসে। ইউটিউবের ভ্লগাররাও মামার হাতের মুড়ি আর হালিমের ভক্ত। আমরা বাজারের মানুষ। আমরা এগুলো খুব ভালো বুঝি। মানুষের ভিড় দেখে বোঝা যায় মামার ব্যবসার পসার।'

লোকের সত্যি কমতি নেই এখানে। অফিসপাড়ার মানুষ, বাজার করতে আসা লোকজন, রিকশাওয়ালা, পর্যটক এমনকি কিছু বেশ বড়সড় ইনফ্লুয়েন্সার— সবাই মিলে যেন এই রসনাপ্রেমের মুহূর্তটি কব্জা করতে ব্যস্ত। সাচ্চু নিজের হাতের মুড়িভর্তা পরিবেশন করতে করতে সবার দিকেই মিষ্টি একটা হাসি ছুড়ে দেন।

সন্ধ্যার আলো যখন শহরের মজলিস ভরিয়ে দেয়, যখন বায়তুল মোকাররম থেকে ভেসে আসে আজানের ধ্বনি, সাচ্চু মিয়া তখনো মুড়ি মেখে চলেছেন। পরিবেশন করে যাচ্ছেন ক্রেতাদের কাছে, আর সেইসঙ্গে এদিক-ওদিক কারো দিকে চোখ টেপা হাসি তো কারো দিকে প্রশ্রয়ের চাহনি।

আর এইসব দৃশ্যই জন্ম নেয় বায়তুল মোকাররম মসজিদের ছয় নম্বর গেটের সামনের বাজারটায়। সাচ্চু মামার মুড়িমাখার দাম শুরু হয় ৩০ টাকা থেকে। তবে যাদের সবকিছুই একটু করে চাই, তাদের জন্য ডিম, মুরগি, সব ধরনের মশলা আর গল্পে ভরপুর মুড়িভর্তার দাম চড়ে ১২০ টাকা পর্যন্ত। একেবারে সাচ্চু মামার 'স্পেশাল'!

অনুবাদ করেছেন অনিন্দিতা চৌধুরী

 

Comments

The Daily Star  | English

Fire at building in Mirpur’s Kalshi under control

Seven fire engines brought the fire under control at 12:05am today

2h ago