প্রথা ভেঙে বক্সিং জগতে নিশাত খানের এগিয়ে চলা

বক্সিংয়ে নারী
নিশাত খান। ছবি: সংগৃহীত

শুরুতেই একটি দৃশ্য কল্পনা করুন। একটি চারকোণা বক্সিং রিংয়ে প্রতিপক্ষের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন বাংলাদেশের একজন নারী। বক্সিং কেবল পুরুষদের জন্য- এই ধারণাকে ভেঙে দিয়ে ও চারপাশে টানটান উত্তেজনা সৃষ্টি করে তিনি এগিয়ে যাচ্ছেন প্রতিপক্ষকে মোকাবিলা করতে।

শুনতে অনেকটা সিনেমার গল্প মনে হচ্ছে না? তবে দৃশ্যটা কোনো সিনেমার নয়, নিশাত খানের জীবনের। তিনি একজন পেশাদার বক্সার। বক্সিং জগতে সপ্রতিভ বিচরণের মাধ্যমে তিনি প্রমাণ করে চলেছেন, বক্সিংয়ে দক্ষতা এবং শ্রম প্রয়োজন। এখানে নারী-পুরুষের কোনো ভেদাভেদ নেই।

বক্সার নিশাত খান
ছবি: সংগৃহীত

নিশাত খান একইসঙ্গে একজন ফ্যাশন ডিজাইনারও। সম্পূর্ণ ভিন্ন ঘরানার দুই পেশা বেছে নিয়ে দুটোতেই একইসঙ্গে সফল হওয়া যে সম্ভব, নিশাত খানের দ্বৈত পেশাজীবন যেন তারই উদাহরণ।

ফ্যাশন ডিজাইনার হিসেবে সফল কর্মজীবন থাকা সত্ত্বেও কেন বক্সিয়ের জগতে পা রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, এ প্রশ্নটি করি তাকে।

নিশাত খান বলেন, 'ছোটবেলা থেকেই আমার ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ের প্রতি ঝোঁক। অন্যদিকে বক্সিং কিছুটা দেরিতেই শুরু করেছি। কোভিড মহামারির সময়ে আমার বয়স যখন বিশ থেকে ত্রিশের কোটায় পড়ছিল, তখন বক্সিং শুরু করি। শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ থাকার লক্ষ্যেই বক্সিংয়ের প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়।'

তিনি বলেন, 'ফুকেটে একবার একা ভ্রমণ করা ছিল আমার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি মোড়। আমি সেখানে শুধু ছুটি কাটানোর উদ্দেশ্যে যাইনি, এটি ছিল নিজেকে আবিষ্কারের যাত্রা। নিজেকে খুঁজে পাওয়ার এই যাত্রা আমাকে সামাজিক প্রতিবন্ধকতা দূরে ঠেলে বক্সিংয়ে এগিয়ে যেতে উদ্বুদ্ধ করেছে। যদিও আমাকে বলা হয়েছিল বক্সিং ছেলেদের খেলা এবং আমার বক্সিং শুরু করতে বেশ দেরি হয়ে গেছে।'

নারী দিবস
ছবি: সংগৃহীত

তবে বিচলিত না হয়ে তিনি বক্সার হিসেবে প্রশিক্ষণ চালিয়ে যান এবং প্রমাণ করতে শুরু করেন যে, দক্ষতা এবং চেষ্টা নারী-পুরুষ ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে।

বেড়ে উঠার সময়ে নিশাত খান পরিবার থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন, বিশেষ করে বড় ভাইয়ের বিশেষ প্রভাব ছিল এ সময়টায়। ভিডিও গেমসের শক্তিশালী নারী চরিত্র, যেমন রেসিডেন্ট এভিল ও টম্ব রাইডারের নারী চরিত্রগুলো যেন ছিল তার আদর্শের বাস্তব রূপ।

তিনি বলেন, `এই চরিত্রগুলোর কাউকে হারিয়ে দেওয়ার কৌশল এবং শক্তিশালী চরিত্র আমাকে মুগ্ধ করে রাখত।'

একটি বক্সিং ম্যাচে অংশগ্রহণ করে তার এই আগ্রহ আরও বেড়ে যায়। দলের সহযোগিতার মনোভাব এবং পরিবেশ তাকে অনেক বাধা অতিক্রম করতে সাহায্য করেছে।

নিশাত খান বলেন, 'আমার প্রথম বক্সিং প্রতিযোগিতা আমাকে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। বক্সিং আমাকে শান্ত, শৃঙ্খলাবদ্ধ এবং মনোযোগী হতে শিখিয়েছে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো এটি আমাকে বিনয়ী ও কৃতজ্ঞ হতে শিখিয়েছে।'

তার মতে, বক্সিং শুধু তাকে শারীরিকভাবে সুস্থ রাখেনি, জীবনকে একটি আশীর্বাদ হিসেবে উপলব্ধি করতে শিখিয়েছে।

একইসঙ্গে একজন ফ্যাশন ডিজাইনার এবং বক্সার হিসেবে তিনি কীভাবে তার কর্মজীবনে ভারসাম্য বজায় রাখেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'কন্যা, পুত্রবধূ, স্ত্রী, বন্ধু, উদ্যোক্তা, ক্রীড়াবিদ এতগুলো দায়িত্ব পালন করা সহজ কথা নয়। তবে জীবনে অগ্রাধিকার দেওয়া শিখতে হবে। আপনি সবসময় সবকিছু করতে পারবেন না, আবার সবাইকে খুশিও করতে পারবেন না।'

কোন মুহূর্তে কোন জিনিসটিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত তা মেনে কাজ করেন তিনি। 

নিশাত খানের রুটিন দেখেই বোঝা যায় তিনি কতটা নিয়ম মেনে চলেন। ট্রেনিং ক্যাম্প চলাকালীন তার রুটিন একইসঙ্গে বেশ কঠিন ও গোছানো থাকে। দৌড়ের মাধ্যমে দিন শুরু করে সকালে দুই থেকে তিন ঘণ্টা ট্রেনিং থাকে তার। তারপর বিশ্রাম নিয়ে আবার বিকেলে ট্রেনিং করতে হয় তার।

ট্রেনিং ক্যাম্প ছাড়াও তিনি সবসময় বেশ নিয়ম মেনে চলেন। সপ্তাহে পাঁচ থেকে ছয় বার এবং মাঝে মাঝে দিনে দুই বার ওয়ার্কআউট করেন। ওয়ার্কআউটের মধ্যে ইয়োগা, বক্সিং এবং বিভিন্ন ট্রেনিং করে থাকেন।

এ ক্ষেত্রে নিশাত খান পুষ্টিকর খাবারের গুরুত্ব সম্পর্কে বলেন, 'স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে ভুলবেন না। কারণ একটা কথা প্রচলিত আছে যে, আপনি যা খাচ্ছেন আপনি তা-ই।'

নিশাত খান মানুষকে অনুপ্রেরণা দেওয়ার ও নতুন কিছু উদ্ভাবন করার স্বপ্ন দেখেন।

তিনি বলেন, 'আমি সেরা বক্সার হতে চাই না, আমি কেবল আমার পছন্দের কাজটি করে যেতে চাই এবং বলতে চাই ''কেন নয়?''

নিশাত খানের যাত্রা হাজারো বাধা অতিক্রম করে এগিয়ে যাওয়ার একটি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। বক্সিং রিংয়ের ভেতরে এবং বাইরে আমরা যখন নিশাত খানের জয়ী হয়ে ওঠার কথা বলছি, তখন আমরা যেন ভুলে না যাই, সমতার লড়াই এখনও শেষ হয়নি। তার গল্প শুধু গতানুগতিক ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করতেই অনুপ্রাণিত করে না, সেসব ধারণাকে ভেঙে সবার জন্য সমঅধিকার সৃষ্টির অনুপ্রেরণাও জোগায়।

অনুবাদ করেছেন সৈয়দা সুবাহ আলম

Comments

The Daily Star  | English

Victory day today: A nation born out of blood and grit

The tide of war had turned by mid-December in 1971. The promise of freedom was no longer a dream. It had hardened into tangible certainty.

7h ago