বাস্কেটবল কি মেয়েদের খেলা—যেভাবে বাধা ডিঙিয়ে এগিয়েছেন আশরীন

আশরীন মৃধা তার জীবনের একটা সময় পর্যন্ত কখনো স্বপ্নেও বাস্কেটবল খেলার কথা ভাবেননি। বরং বলা যেতে পারে, লাল কংক্রিটের মেঝের ওপর বলের প্রতিধ্বনি, স্কুলের সিনিয়র মেয়েদের বাস্কেটবল দলের জার্সির শব্দই তাকে খুঁজে নিয়েছে।
শুরুর দিকের কথা মনে করে আশরীন বলেন, 'আমি কখনো টেলিভিশনেও বাস্কেটবল খেলা দেখিনি। আমরা সেই সময় কেবল ক্রিকেট খেলা দেখতাম।'
কিন্তু সেই সময়ই একদিন আশরীন স্কুলের বাস্কেটবল কোর্টের পাশে বসে এমন কিছু দেখেছিলেন যে, খেলাটি সম্পর্কে তার ধারণাই বদলে গিয়েছিল! কী দেখেছিলেন তিনি সেদিন? দেখেছিলেন নারী নেতৃত্ব, নারীর স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ এবং নারীর নিয়ন্ত্রণে থাকা একটি মাঠ। আর সেই মুহূর্তে আশরীন কেবল আট নম্বর জার্সি গায়ে জড়াতে চেয়েছিলেন, বিখ্যাত হওয়ার কোনো স্বপ্নই তার ছিল না।
এটা সেই সময়ের ঘটনা যখন আশরীন চতুর্থ শ্রেণিতে পড়তেন। তখন আট নম্বর জার্সিটি পরতেন স্কুলের বাস্কেটবল দলের প্রধান, তখন সেই কিশোরীই ছিলেন আশরীনের আইডল বা আদর্শ। তিনি বলেন, 'আমি তার খেলা দেখতাম আর ভাবতাম-যখন তিনি খেলা থেকে অবসর নেবেন, তখন তার জার্সিটা আমি পরব।'
এরও অনেক বছর পর যখন সত্যিই স্কুলের বাস্কেটবল দলে জায়গা করে নিলেন আশরীন, আট নম্বর জার্সিটিই হলো তার। এখনো সেই জার্সি নম্বরটি ট্যাটু করে নিজের পায়ে লিখে রেখেছেন তিনি।
এসব শুনে এটা ভেবে নেওয়ার কোনো কারণ নেই যে, আশরীনের সাধারণ খেলোয়াড় থেকে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পথটা খুব মসৃণ ছিল। এটা একেবারেই ভিন্নভাবে এগিয়েছে। আশরীনকে লড়তে হয়েছে গোড়ালির চোটের সঙ্গে, আবার ফেডারেশনের রাজনীতির সঙ্গেও। এমনও হয়েছে, তাকে কোর্টের বাইরে নিতে বাজেটের অজুহাত দাঁড় করানো হয়েছে, বিয়ে করাকেও অজুহাত হিসেবে দেখানো হয়েছে।
তবে এতকিছুর পরেও দেশি বলার্স নামে নারীদের একটি ক্রীড়া উন্নয়ন গ্রুপের মাধ্যমে আবার ফিরেছেন আশরীন। যে আন্দোলনটির সূচনা হয়েছিল তার হাত ধরে, সঙ্গে ছিলেন সহযাত্রী গুলনাহার মাহবুব মনিকা। কেবল ব্র্যান্ডিং বা ছাপ রেখে যাওয়ার জন্য দেশি বলার্সের যাত্রা শুরু হয়নি, এই প্ল্যাটফর্ম সৃষ্টির কারণ পরিস্থিতি। এই প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা ছাড়া আশরীনের সামনে আর কোনো বিকল্প ছিল না।

সবাই বলত, ভুল খেলা বেছে নিয়েছ
আশরীনের বয়স যখন ১৮ বছর, তখনই ডাক পান বাংলাদেশের প্রথম নারী জাতীয় বাস্কেটবল দলে। তিনি বলেন, 'সেসময় আশপাশের সবাই বলত যে, আমি ভুল খেলা বেছে নিয়েছি। তারা কেবল ক্রিকেট বা ফুটবলের নাম শুনেছিল। কিন্তু বাস্কেটবল? এটা কে খেলে!'
এত কথার পরেও বাস্কেটবল খেলা চালিয়ে গিয়েছেন আশরীন। তার কারণ এটা নয় যে এই খেলা সহজ, বরং কারণ ছিল—অন্য কেউ এই খেলা চালিয়ে যাচ্ছিল না।
আশরীন তার ক্যারিয়ারের সেরা সময়েও ফেডারেশন থেকে কোনো বেতন পাননি। একবারের জন্যও না! তিনি বলেন, '১০ বছর আমি জাতীয় দলে খেলেছি। কিন্তু এই দীর্ঘ সময়ে কোনো বেতন পাইনি, ভাতা পাইনি। আমরা নিজেরাই প্রবেশ ফি দিয়ে মাঠে ঢুকতাম। প্রশিক্ষণের জন্য যে মাঠ ভাড়া করেছিলাম, সেটিও নিজেদের উদ্যোগে, নিজেদের খরচে। ফেডারেশনের এসব নিয়ে কোনো মাথাব্যথাই ছিল না।'
এবং এটা নিয়ে ফেডারেশন কোনো লুকোছাপাও করত না। নারীদের জন্য কোনো লীগের আয়োজন করা হতো না। মেয়েদের জন্য আলাদা কোনো কোচও ছিল না। এমনকি কোনো ফিজিও থেরাপিস্ট, চিকিৎসক বা পরিকল্পনাও ছিল না।
ক্যারিয়ারের শীর্ষে বা ফর্মে থাকা অবস্থাতেই ২৬ বছর বয়সে বিয়ে করেন আশরীন। আর এরপরেই নতুন ধরনের বৈষম্যের শিকার হন তিনি।
আশরীর বলেন, 'যে মুহূর্তে আপনি বিয়ে করবেন বা সন্তান জন্ম দেবেন, সে মুহূর্ত থেকে আপনার সঙ্গে এমন আচরণ করা হবে যেন আপনি ফুরিয়ে গেছেন। যেন আপনার শরীর আর আপনার নেই, অন্য কারও হয়ে গেছে।'
এই বৈষম্য কেবল প্রাতিষ্ঠানিক নয় বরং ব্যক্তিগত পর্যায়ের, মনে করেন আশরীন। কারণ, আশরীনের মতে, তার স্পষ্টভাষী চরিত্রই তাকে সমস্যায় ফেলেছিল। ২০১৯ সালে সাউথ এশিয়ার গেমসের ঠিক আগ মুহূর্তে দল থেকে আশরীন আর তার এক সতীর্থকে বাদ দেওয়া হয়। তিনি বলেন, 'কারণ আমরা বেতন সম্পর্কে প্রশ্ন করেছিলাম। কারণ আমরা ন্যায্যতা চেয়েছিলাম।'
দেশি বলার্সের যাত্রা শুরুর গল্প
আপনি চাইলে দেশি বলার্সকে বিদ্রোহের তকমা দিতে পারেন। কিন্তু এটা খুব চমক জাগাতে সৃষ্টি হয়নি, বরং ধীরস্থিরভাবে নিজের লক্ষ্য অর্জনে অবিচল থেকেছে।
২০১৮ সালে আশরীন ও মনিকার হাত ধরে এর যাত্রা শুরু হয়। ফেডারেশনের সঙ্গে এর কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল না। আশরীন বলেন, 'বছরজুড়ে মেয়েদের জন্য কোনো টুর্নামেন্টের আয়োজন করা হতো না। তাই আমরা নিজেরাই খেলার ব্যবস্থা শুরু করলাম। টুর্নামেন্ট, প্রশিক্ষণ শিবির এবং নারী কোচদের নিয়ে আলাদা একাডেমি তৈরি করলাম। আমরা এমন ব্যবস্থা করলাম যেন মেয়েরা সারাবছরই খেলার মধ্যে থাকতে পারে।'
জয়ের লক্ষ্য নিয়ে মাঠে নামেনি দেশি বলার্স। বরং তাদের লক্ষ্য ছিল বাস্কেটবল জগতে যে নীরবতা বিরাজ করছিল, তা ভেঙে এগিয়ে যাওয়া। তিনি বলেন, 'আমি এটা প্রমাণ করতে চেয়েছিলাম যে একজন নারী বিবাহিত হতে পারেন, ৩০ বছরের বেশি বয়সী হতে পারেন, সন্তানের মা-ও হতে পারেন; এসবের পাশাপাশিও তিনি খেলা চালিয়ে যেতে পারেন। আমি সেসময় সন্তান জন্ম দেওয়ার পরিকল্পনা করতেও ভয় পেতাম, কারণ জানতাম যে সন্তান জন্ম নিলে আমি আর বাস্কেটবল কোর্টে ফিরতে পারব না। ভাবতে পারেন? কেমন একটা ভয় নিয়ে আমরা বাস করতাম?'
টুর্নামেন্ট সংক্রান্ত প্রচুর প্রচার-প্রচারণার পর অবশেষ ২০২৩ সালে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত হয় নারী বাস্কেটবল লিগ। এতে আটটি ক্লাব অংশ নেয়। সেবারই প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের মেয়েরা খেলার বিনিময়ে অর্থ উপার্জন শুরু করেন।
আশরীন বলেন, 'আমরা নিজেদের দল গঠন করেছি। দলের ১২ খেলোয়াড়কে বেতন দিয়েছি এবং এর জন্য আমাদের কারও অনুমতির অপেক্ষা করতে হয়নি।'

আসন নিশ্চিত হলো
২০২৪ সালে সরকারের একটি সংস্কারের ফলে বাস্কেটবল ফেডারেশনের জন্য অ্যাডহক কমিটি গঠন করে দেওয়া হয়। যে কমিটির ১৬ সদস্যের মধ্যে একজন হলেন আশরীন, বাকি ১৫ জনই পুরুষ।
তিনি বলেন, 'এটা বেশ কঠিন। কমিটির যে পুরুষ সদস্যদের সঙ্গে আমাকে কাজ করতে হচ্ছে তারা সবাই আমার চেয়ে কয়েক দশকের বড়। মেয়ে খেলোয়াড়দের বিষয়গুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়ার ব্যাপারটি তাদের বোঝানো অনেকটা ভারী পাথর পাহাড় বেয়ে ওপরে তোলার মতো ব্যাপার। কিন্তু আমি যেহেতু কমিটি পর্যন্ত পৌঁছেছি, নিশ্চয়ই প্রয়োজনের সময় চুপ করে থাকব না।'
কমিটির সদস্য হয়ে দাবি আদায়ে নরম হয়ে যাননি আশরীন। বরং তার সংকল্প আরও তীক্ষ্ণ হয়েছে। তিনি বলেন, 'যেহেতু আমি বিশেষ টেবিলে বসার জায়গা পেয়েছি, সেহেতু কেবল নিজের কথা বলব না। আমি প্রতিটি মেয়ের জন্য কথা বলব যাদের এতদিন চুপ করে থাকতে বলা হয়েছিল, দূরে থাকতে বলা হয়েছিল।'
কেবল খেলোয়াড় নন, নেতাও
আশরীন এখন আর কেবল পদক জয়ের মধ্যেই সাফল্য দেখতে পান না। তিনি বলেন, 'খেলা থেকে অবসর নিলে খেলোয়াড়ের কাছে রয়ে যায় কেবল কিছু ট্রফি। কিন্তু আমার জন্য এটাই যথেষ্ট নয়। আমি চাই মানুষের জীবন বদলে যাক।'
আর তাই দেশি বলার্সকে নিয়ে তার লক্ষ্য অনেক বড়। তিনি কেবল টুর্নামেন্ট আয়োজনেই খুশি থাকতে চান না। তিনি আরও নারী কোচ চান, নারী রেফারির সংখ্যা বাড়াতে চান এবং এমন মেয়েদের সংখ্যা বাড়াতে চান যারা প্রশ্ন করতে ভয় পাবে না।
আশরীন বলের, 'একটা সময় আমি কথা বলতে ভয় পেতাম। কিন্তু এখন এমন ৫০ জন মানুষ আছে যারা যেকোনো সময় কথা বলতে প্রস্তুত, এমনকি আমাদের মধ্যে কাউকে চুপ করিয়ে দিলেও অন্যরা ঠিকই কথা বলবে। এটাই পরম্পরা। যেটা কেবল আমার নয়, দেশি বলার্সেরও। বরং সেই ধারণার পরম্পরা যে, মেয়েরাও প্রয়োজন পড়লে নিজের জায়গা নিজেরাই বেছে নিতে পারে। আর নিজের জায়গা করে নেওয়ার জন্য কারও কাছে ক্ষমাও চাইতে হয় না।'

এরপরের ধাপ কী?
আশরীন এখনো খেলছেন, কোচ হিসেবেও কাজ করছেন। কোচ হিসেবে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সনদ আছে তার। ভবিষ্যতে কোনোদিন জাতীয় দলে কোচিং করানোর স্বপ্নও দেখেন আশরীন, এমনকি পুরুষ দলকেও প্রশিক্ষণ দেওয়ার আশা তার।
দেশি বলার্সকে নিয়ে কী পরিকল্পনা তা জানতে চাইলে আশরীন বলেন, 'আমি চাই এটা ভাইরাসের মতো ছড়িয়ে যাক। যেন আমার মৃত্যুর পরও এর সংস্পর্শে আসা প্রতিটি মেয়ের মধ্যে এটি বেঁচে থাকে।'
আশরীন এমন একজন খেলোয়াড় যাকে নিয়ে কোনো ব্র্যান্ডের মাতামাতি নেই, জনসংযোগের ঝক্কি নেই। যার আছে কেবল একটি আট নম্বর জার্সি। আর আছে মনের মতো একটি খেলা, যা তাকে নিজের স্থান করে নিতে শিখিয়েছে।
অনুবাদ করেছেন জ্যোতি রশীদ
Comments