ক্যাসেটের গান ও ফেলে আসা শৈশব
ফিরে যাই আজ থেকে আরও ২৫ বছর আগেকার সেই সেলুলয়েড, সোডিয়াম বাতির সময়ে। ২০০০ সাল, আমি সবে স্কুলে যাওয়া শুরু করেছি। ঠিক যেন একটি অদ্ভুত, নির্দোষ জগৎ, যেখানে আমার দিন কাটত নিউমার্কেট থেকে কিনে আনা খেলনা হাতে, জানালার পাশে বসে রোদের আঁচে গা সেঁকে। আর ঘরের ভেতর বাজত দেশ-বিদেশের সুরের জাদু।
আমার বড় বোন তখন 'টিনেজার'। তার কাঁধে তখন সদ্য কৈশোরের রঙ, গোটা দুনিয়ার বাদবাকি কিশোরদের মতই 'কিছুই পরোয়া না করা' সময়। সে সময় ইন্টারনেট, স্মার্টফোন না থাকলেও বিনোদনের খোরাক হিসেবে অন্যতম 'ট্রেন্ড' ছিল ক্যাসেট প্লেয়ার আর সেখানে পশ্চিমা দুনিয়ার ব্যান্ড আর পপ তারকাদের গান শোনা। আমাদের ছোট্ট বাসায় প্রতিদিন দুপুর আর সন্ধ্যায় দরজা বন্ধ করে এক 'কনসার্ট' বসত। এই দরজার ভেতরের কনসার্ট থেকেই একসময় দেখি, আমি নিজেই মুখস্থ গেয়ে ফেলছি কিছু কিছু লাইন—উচ্চারণ ভুল হলেও, গলায় ছিল এক ধরনের আত্মবিশ্বাস।
ব্যাকস্ট্রিট বয়েজের 'আই ওয়ান্ট ইট দ্যাট ওয়ে', ব্রিটনি স্পিয়ারসের 'উপ্স!...আই ডিড ইট অ্যাগেইন', আর বয়জোনের আবেগভরা কিছু রোমান্টিক গান। সবেমাত্র স্কুলপাঠ শুরু, তখন ইংরেজি গান বোঝার মতো বয়স বা ভাষা জ্ঞান কিছুই ছিল না। তারপরেও গানের সুর, জ্যাজের টিউন ভালোই লাগতো। বিশেষ করে, মনে হতো, যুগের সঙ্গে, 'ট্রেন্ডের' সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারছি বুঝি! তখন দুনিয়া স্বাভাবিকভাবেই ছিল ছোট, এত ব্র্যান্ডের দোকান, কিংবা দেশ-বিদেশের নানা স্বাদের কুইজিনের সঙ্গে আমরা পরিচিতই ছিলাম না। যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপের কোনো দেশের জিনিস হাতে পেলে মনে হতো, কত দূর থেকে এসেছে জিনিসগুলো!
বাবার তখন সেসব নিয়ে কোনো মাথাব্যথা ছিল না, যতক্ষণ না পড়াশোনায় ফাঁকি দিচ্ছি। যদিও বাবা ছিলেন রবীন্দ্রসংগীত, আর হেমন্তের গান শোনার মানুষ। মনে আছে সে সময় বাবা টেলিভিশন থেকে একেকটি গানের লিরিকস খাতায় লিখে রাখতেন, আর তার পরদিনই চলে যেতেন নিউমার্কেট কিংবা এলিফ্যান্ট রোডের হাতেগোনা কয়েকটি দোকানে। দোকানগুলো বিদেশের বিভিন্ন চলচ্চিত্র, শিল্পীদের গানের ক্যাসেট তৈরি করে এনে দিতেন। বই আর ক্যাসেট সংগ্রহে রাখা ছিল বাবার অন্যতম শখ। আর আমার বোনের কাছে ছিল এই পপ, রক, জ্যাজ গানগুলো নতুন পৃথিবীর দরজা, মুক্ত হাওয়ার চাবি। তখন অবশ্য এটাই ছিল উঠতি বয়সের কিশোরদের আড্ডা, আলোচনার অংশ। কার কাছে নতুন কী ক্যাসেট আছে, কে সবার আগে কিনতে পারলো, কার বাসা থেকে এই গানের সুর ভেসে আসছে, এসব নিয়েও বোনের বন্ধুদের, প্রতিবেশীদের দেখেছি এক ধরনের 'বড়াই' করতে।
আজ যখন স্মার্টফোন, ইউটিউব, আর স্ট্রিমিং অ্যাপের যুগে দাঁড়িয়ে পেছনে তাকাই, দেখি সেই দিনগুলো ছিল একেবারে অন্যরকম। সেখানে ছিল সময় নিয়ে গান শোনা, ভিন্ন ভাষার লিরিক বোঝার বারবার চেষ্টা, অপেক্ষা করে, পকেটে খরচা জমিয়ে নতুন অ্যালবাম কেনা এবং গানকে অনুভব করার এক ধীর অভ্যাস। আর আমি, আমার সেই ছোট্ট বয়সে, হয়তো বুঝতাম না সেসব গান কী বলছে, কিন্তু ভাবতাম, 'আমেরিকা! ইউরোপ! কত দূর! সেখানে বুঝি মানুষ এমন'!
আজ প্রায় ২৫ বছর পর এসে যখন দেখি, পছন্দের এই শিল্পীরাও এখন আর রূপালি পর্দায় নেই, তাদের সেই খ্যাতি থাকলেও আকর্ষণ, চাকচিক্যে কিছু ভাটা পড়েছে, তখন আসলেও বোঝা যায় কতটা সময় পার করে চলে এসেছি। আমার নিজের শিক্ষার্থীদের দেখি, রবীন্দ্রসংগীত বলতে অনেকেই বোঝে ফিউশন, এক নাগাড়ে ব্যাকস্ট্রিট বয়েজ, ব্রিটনি স্পিয়ারসের মতোন পশ্চিমা আধিপত্যের জায়গায় বাজার দখল করে নিচ্ছে 'কে-পপ', তখন মনে হয় ক্যাসেট প্লেয়ার তো এখন অ্যান্টিক জিনিস। কিন্তু সেসব পুরোনো দিন, জিনিসপাতি এই যুগেও নেহাৎ ফেলনা নয়।


Comments