শিকলবন্দি শৈশব

লোহার শিকল পরেই কৈশোরে পৌঁছেছে লিমন। ছবি: স্টার

লিমন শরিফের বয়স তখন ৩ বছর। নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে প্রথমে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। কিছুদিন পর বন্ধ হয়ে যায় স্বাভাবিক কথা বলা। শুধু 'মা-বাবা' বলতে পারে। স্বাভাবিক চলাচলেও দেখা দেয় নানা সমস্যা।

শিশু লিমনের এমন অস্বাভাবিক অবস্থা সামাল দিতে হিমশিম খেতে হয় তার বাবা-মাসহ আত্মীয় স্বজনদের। পরে বাধ্য হয়ে নিজ সন্তানের পায়ে লোহার শিকল আর তালা দিয়ে বেঁধে রাখতে শুরু করেন তারা। কেটে গেছে ১২টি বছর। লোহার শিকল পরেই শিশু থেকে কৈশোরে পৌঁছেছে লিমন।

ফরিদপুরের সালথা উপজেলা যদুনন্দী ইউনিয়নের উজিরপুর গ্রামের দরিদ্র দিনমজুর বাবা হাফেজ শরিফ (৫৮) ও মা সুফিয়া বেগমের (৫১) ছেলে লিমন (১৫) ।

তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে লিমন সবার ছোট। বড় বোন রানীর (২৭) বিয়ে হয়েছে ৭ বছর আগে। বড় ভাই রাজীব (২৪) ও মেঝ ভাই সজিব (২২) বাবার মতই দিন মজুর হিসেবে কাজ করেন অন্যের জমিতে।

হাফেজ শরিফের নিজের কোনো জমি নেই। ৩ শতাংশ জমির উপর জীর্ণ-শীর্ণ বসত ঘর ও রান্নার জায়গা। এই বসত জায়গার মালিকও কাগজে কলমে হাফেজ শরিফ নন। একজনের কাছ থেকে বেশ কয়েক বছর আগে এ জমিটি তিনি কিনেছিলেন, কিন্তু জায়গার দলিল এখনো করে দেওয়া হয়নি হাফেজ শরিফের নামে।

নিউমোনিয়ায় অসুস্থ হওয়ার পর গত ১২ বছর ধরে এভাবেই লোহার শিকলবন্দি হয়ে কাটে লিমনের দিন রাত্রি। দিনের বেলা খোলা রান্নাঘরে কাটে লিমনের সময়। রাতে উপরে টিন ও চারপাশে পাটখড়ি বেড়ার বসত ঘরের মেঝেতে তাকে রাখা হয় শিকল পরানো অবস্থায়। বসত ঘরের সামনে রান্নাঘরে একটি খুঁটির সঙ্গে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে শারীরিক প্রতিবন্ধী ও মানসিক ভারসাম্যহীন লিমনকে।

অসুস্থ লিমনের পরিবারের সামর্থ্য অনুযায়ী একাধিকবার স্থানীয় হাসপাতালে আর ফকিরের মাধ্যমে চিকিৎসা করিয়েও কোনো লাভ হয়নি। তবে অভাবের কারণে ভালো কোনো চিকিৎসককে দেখানোও সম্ভব হয়নি হত দরিদ্র এই পরিবারটির।

মিলনের বাবা হাফেজ শরিফ বলেন, '৩ বছর বয়সে লিমন নিউমোনিয়া রোগে আক্রান্ত হয়। তাকে বোয়ালমারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে চিকিৎসা করাই। কিছুদিন পর লিমন মানসিক প্রতিবন্ধী হয়ে যায়। বন্ধ হয়ে যায় স্বাভাবিক কথাবার্তা। ওকে সুস্থ করতে ৫০ থেকে ৬০ হাজার খরচ করা হয়। ধার কর্জ করে এই টাকা খরচ করেও লিমনকে সুস্থ করতে পারিনি।'

তিনি বলেন, 'আমি দিন কামাই করি, দিন খাই। আমার তো ওরে চিকিৎসা করানোর কোন সামর্থ্য নাই। ওর একটা প্রতিবন্ধীর ভাতার কার্ড ছাড়া কিছু নাই।

লিমনকে কেন শিকল ও তালা দিয়ে বেঁধে রাখা হয় জানতে চাইলে হাফেজ শরিফ বলেন, 'কোনো বাবা কি চায় তার ছেলেকে শিকল ও তালা দিয়ে বেঁধে রাখতে। ছাড়া পাইলে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। গাছে ওঠে, পুকুরে নামে, আশেপাশের লোকদের গাছ-গাছালি নষ্ট করে। একবার ছাড়া পাইলে নিজে থেকে বাড়ি আসে না। কয়েক গ্রাম ঘুইরা ওরে ধইরা আনতে হয়। তাই বাইন্ধা রাখি। এরমধ্যে গত ১২ বছরে ও নয় বার শিকল ছিঁইড়া পালিয়েছে।'

লিমনের মা সুফিয়া বেগম বলেন, 'জানিনা লিমন সুস্থ হবে কিনা। অনেক টাকা খরচ করেছি। এখন আর করি না। সে সামর্থ্যও আমাদের নেই। জানিনা ওর ভাগ্যে কী আছে। ছেলের এই অবস্থা দুই চোখে দেখতে পারি না। ওকে এ অবস্থায় দেখে দুই চোখে পানি ধরে রাখতে পারি না।'

যদুনন্দী ইউনিয়ন পরিষদের ইউপি চেয়ারম্যান মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, 'শিশু অবস্থা থেকে লিমন প্রতিবন্ধী ও মানসিক ভারসাম্যহীন। তাকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখতে হয়। একটা প্রতিবন্ধীর ভাতার কার্ড করে দেওয়া হয়েছে। যদি কোনো চিকিৎসা করে ওকে সুস্থ করা সম্ভব হয় তাহলে সহযোগিতা করার চেষ্টা করবো।'

Comments

The Daily Star  | English

Dozens of zombie firms still trading as if nothing is wrong

Nearly four dozen companies have been languishing in the junk category of the Dhaka Stock Exchange (DSE) for at least five years, yet their shares continue to trade on the country’s main market and sometimes even appear among the top gainers. 

2h ago