রিকশাচালকের চোখে ঢাকা

রিকশাচালকের চোখে ঢাকা
ছবি: স্টার

ঢাকাকে যদি একটি মাত্র যান দিয়ে বর্ণনা করতে বলা হয়, সেটি হবে রিকশা। তিন চাকা, একটা বেল, রঙ্গিন সব চমৎকার আঁকিবুঁকি আর অদম্য সাহস নিয়ে শহরের বুকে রাজত্ব করা এক বাহন হলো রিকশা। রিকশা দেখলে বিজ্ঞানের ওপর প্রশ্ন জাগে। এখনকার অ্যাপ, গাড়ি আর গতিসীমায় ভরা এই শহরে রিকশা কীভাবে টিকে থাকে, সেটাই যেন এক বিস্ময়।

আর রিকশাওয়ালা মামা হলেন ঢাকার সবচেয়ে বড় গল্পকার। ঘণ্টার পর ঘণ্টা শহরের প্রতিটি কোণা চষে বেড়ানো রিকশাওয়ালা মামার চেয়ে ভালো আর কে এই শহরকে চিনবে! না, তিনি প্রবন্ধলেখক নন। প্রথম দেখায় তাকে খুব সাধারণই মনে হয়। লুঙ্গি বা প্যান্ট, ছেঁড়া-সেলাই করা শার্ট কিংবা পাঞ্জাবি, একটা মরচে ধরা ঘণ্টা—ঢাকার চেনা দৃশ্য। কিন্তু চাকা ঘুরতে শুরু করলেই শহরের যাবতীয় গল্প তার ঝুলি থেকে বের হতে থাকে।

'এই শহরের সমস্যা কী?' এই প্রশ্ন করলে কখনোই তার থেকে কোনো কাঠখোট্টা জবাব পাবেন না। তিনি রাস্তার জোনিং আইন, জনঘনত্ব কিংবা অবকাঠামো নিয়ে কথা বলেন না। তিনি শুধু বলে উঠেন, 'ভদ্রলোকেরাও সিগন্যাল মানে না, আপা।'

তার চোখে এটিই সব বিশৃঙ্খলার মূল। জলবায়ু পরিবর্তন নয়, মেগাসিটির দোষ নয়, কোনো গ্রাফ বা তত্ত্ব নয়, এমনকি নিজের মাঝেমধ্যে ট্রাফিক আইন ভাঙার কথাও বলবেন না। তিনি শহরটাকে একটা ক্লাসরুম হিসেবে দেখেন, যেখানে শুধু তিনি বাদে সবাই ট্রাফিক অধ্যায়ে নকল করে পাস করেছে।

তিনি কিন্তু তার পাঠ খুব ভালোভাবে শিখে নিয়েছে, এ বিষয়য়ে কোনো সন্দেহ নেই। কোন গলিতে সময় অদ্ভুতভাবে দ্রুত চলে, কোন শর্টকাটে কয়েক মিনিট বাঁচে, আর রাজনৈতিক মিটিং বা ট্রাফিক পুলিশের কারণে কোন রাস্তা এড়িয়ে চলতে হবে এই সবই তার জানা।

রিকশাচালকের চোখে ঢাকা

গুগল ম্যাপ ভুলে যান। তার জ্ঞান কিন্তু একদম হাতেকলমে তৈরি হয়েছে। তিনি আরও মনে করেন, ঢাকা আসলে দুই ধরনের অর্থনীতিতে চলে। একটিতে ভাড়া নির্ধারিত হয় তার মাথার ভেতরে থাকা মিটারের হিসাবে, আর অন্যটিতে ভাড়া ঠিক হয় যাত্রীর পোশাক, মেজাজ কিংবা গলায় ঝোলানো করপোরেট আইডির ওপর। দামি জুতো? বাড়তি ২০ টাকা। ছাত্রছাত্রী মনে হলে? ১০ টাকা ছাড় আর সঙ্গে শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কার নিয়ে ১৫ মিনিটের লেকচার ফ্রি।

তবু তিনি শুধু বলেনই না, মন দিয়ে শোনেনও। শহুরে উদ্বেগের সব স্বাদই তার কানে এসেছে—বনানীর ব্রেকআপের গল্প, শাহবাগে বার্নআউট, মহাখালীতে অস্তিত্বের সংকট। কখনো কখনো তিনি রোগনির্ণয়ও করে ফেলেন। তার সঙ্গে ১৫ মিনিটের রিকশা ভ্রমণ একেবারে থেরাপি সেশনের চেয়ে কম কিছু নয়।

রিকশাওয়ালা মামারা একইসঙ্গে অর্থনীতিবিদ, সমাজবিজ্ঞানী, থেরাপিস্ট আর রাজনৈতিক বিশ্লেষক। শহর সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি একে 'বাসযোগ্য নয়' বলে উড়িয়ে দেন না। বরং এমন সব বাস্তব সমস্যার কথা বলেন, যেগুলো আপনি চাইলে কোনো সার্ভের প্রশ্নে যোগ করতে পারেন। তার রিকশায় পাঁচ মিনিট কাটালেই আপনি জেনে যাবেন তার বংশপরিচয়, ঢাকায় তো বটেই, রংপুর বা শেরপুরেও কোন শর্টকাটে দ্রুত পৌঁছানো যায় সে পর্যন্ত আলাপ চলে যায়। আর তিনি যে তার গ্রামের বাড়িকে কত মিস করেন, সেই আলাপ তো আছেই।

মাঝেমধ্যে রসিকতাও আসে। কিন্তু সে রসিকতা কখনোই সস্তা নয়। ওগুলো জমে ওঠে বেঁচে থাকার ব্যথা থেকে। তার উচ্চারণ বুঝতে আপনার খানিকটা কষ্ট হতে পারে। কিন্তু তার যত্ন, পর্যবেক্ষণ আর বাস্তব উপলব্ধি চোখ এড়ায় না। কিছু ইউ-টার্নে আপনার বুক ধক করে উঠতে পারে। কিন্তু তিনি জোর দিয়ে বলবেন—এভাবে সময় বাঁচবে। তাই আপনি চুপ করে শুনে যাবেন।

আধা অভিযোগ আর আধা স্বীকারোক্তির সঙ্গে শেষ কথাটা তিনিই বলেন—'এই শহরে সবাই কথা বলে, কিন্তু শোনার লোক নাই।' ঢাকার প্রতিটি রাস্তার মোড় যেন একে অপরের সঙ্গে যুদ্ধ করে। এখানে সবাই শৃঙ্খলা চায়, কিন্তু কেউই অপেক্ষা করতে রাজি নয়। হর্ন বাজে, ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যায়, মেজাজ চড়ে যায় আর সব যুক্তির বাইরে গিয়ে শহরটা তবু এগিয়ে চলে। আর তার মাঝেই রিকশাওয়ালা মামাও চলতে থাকেন।

তার কাছে ঢাকা মানে ছোট ছোট ত্যাগের হিসাব। প্রতিটি রাইডে, প্রতিটি সংকীর্ণ বাঁকে আছে একরোখা জেদ, কঠিন সহনশীলতা আর এমন এক স্পন্দন, যা থামতে জানে না। হ্যাঁ, শহরটা ক্লান্তিকর, পাগল করে দেওয়া, কখনো কখনো একেবারেই হাস্যকর। কিন্তু শহরটার প্রাণ আছে। আর সেই প্রাণের ছন্দ সবচেয়ে জোরালোভাবে ধরা পড়ে তাদের মধ্যেই, যারা ইঞ্চি ইঞ্চি করে শহরটা পাড়ি দেয়। এই শহরে বাস করা সহজ নয়, তাই তাদের মধ্যে থাকে নীরব এক গর্বের চিহ্ন।

অনুবাদ করেছেন সৈয়দা সুবাহ আলম

Comments