জাদুর শহর অপেক্ষারও

জাদুর শহর অপেক্ষারও
ছবি: স্টার

প্রতিনিয়ত বেড়ে চলা জনস্রোত আর কখনো শেষ না হওয়া ট্র্যাফিক জ্যামের ভোগান্তি—এই দুইয়ের মিশ্রণেই ঢাকা শহরের গড়ে উঠেছে এক অনন্য বৈশিষ্ট্য। রাস্তায় বেরোলেই 'মামা' কিংবা উচ্চস্বরে বলা 'ওই খালি, যাবা?'— এমন ডাক আমাদের কানে হরহামেশাই ভেসে আসে, যা ঢাকাবাসীর এক বিশেষ পরিচয় হয়ে উঠেছে। আর ট্র্যাফিক জ্যামে ধৈর্য ধরে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করা যে ঢাকার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ, তা নতুন করে বলার কিছু নেই।

অপেক্ষা করুন

ঢাকায় যেখানেই যান না কেন, অপেক্ষা করাটা অবধারিত। বাসস্টপেজ হোক কিংবা মেট্রো স্টেশন, ফুড কোর্ট বা হাসপাতাল—সবখানেই অপেক্ষা আপনার সঙ্গী। কোথায় যাচ্ছেন, তা আসলে মুখ্য নয়; ঢাকায় থাকলে এক কথায় আপনাকে অপেক্ষা করতেই হবে। পাঁচ মিনিটে নাকি পাঁচ ঘণ্টায় আপনার পালা আসবে, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। তবে একসময় না একসময় আপনার পালা ঠিকই আসবে।

অপেক্ষাতেই থাকুন

ঢাকায় বসবাসরত প্রায় সবাই ভালোভাবেই বুঝে গেছে, অপেক্ষা তাদের দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং তারা ধীরে ধীরে এর সঙ্গে সুনিপুণভাবে মানিয়ে নিয়েছে।

অপেক্ষার এই সময়ে বেশিরভাগ মানুষ কানে হেডফোন গুঁজে পছন্দের গান কিংবা অডিওবুক শোনে। এই যেমন আমার কথাই ধরুন না কেন, আমি নিজেই এমনটা করি—বাসের জন্য দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে গেলে আমি কানে হেডফোন গুঁজে নব্বইয়ের দশকের গান শুনি, যা অপেক্ষাকে কিছুটা কম বিরক্তিকর করে তোলে। বাসে উঠে আবার শুরু হয় অপেক্ষার পালা—কখনো ট্র্যাফিক সিগন্যাল পেরোনোর অপেক্ষা তো কখনো তীব্র যানজট ঠেলে নিজ গন্তব্যে পৌঁছানোর অপেক্ষা। সেই সময়ও আমি কানে হেডফোন গুঁজে নিয়ে গান শুনেই সময় কাটাই।

ঢাকায় এমন দৃশ্য বিরল হলেও মাঝেমধ্যে অনেকে অপেক্ষার সময় বই পড়ে, যা খুবই ভালো অভ্যাস।

জাদুর শহর অপেক্ষারও
ছবি: স্টার

বেশিরভাগ মানুষ এই সময় ফোনে ব্যস্ত থাকেন। কার্ড গেম, আর্কেড বা পাজল, টার্ন-বেসড স্ট্র্যাটেজি গেম বা ফুটবল সিমুলেটর—এসব গেমই সাধারণত অপেক্ষার সময় তারা খেলেন। অনেকে আবার পুরোনো ইউটিউব শর্টস দেখেই সময় কাটান।

আবার এমন অনেক মানুষ আছেন যারা এই শহরের রূপরেখার সঙ্গে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিয়েছেন এবং তাদের অপেক্ষার ধরন লক্ষ্য করলেই তা বোঝা যায়। বাস কতটা দেরি করছে বা অপেক্ষার লাইনটা ঠিক কত বড়, এসব বিষয় তাদের খুব একটা ভাবায় না। অপেক্ষার প্রহরগুলোকে সদ্ব্যবহার করার কৌশল তারা আত্মস্থ করে ফেলেছেন এবং আর এই সময়ে তারা ফোনের মাধ্যমে রিমোটলি অনেক দৈনন্দিন কাজ সেরে ফেলেন।

এই সময়ে ক্ষুধা লাগা একেবারেই স্বাভাবিক। লাইনে দাঁড়িয়েই অনেককে ঝালমুড়ি, হালিম বা বাদাম খেতে দেখা যায়—আর পড়ন্ত বিকেলে অনেকের হাতে চায়ের কাপও থাকে। বাদাম খাওয়া যেন এক আলাদা দৃশ্য—খাওয়ার সময় খোসা ছিটকে ছিটকে চারপাশে ছড়ায়, কখনো কখনো ঠিক অন্যদের গায়েও লেগে যায়!

আপনার পালা না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করুন

অপেক্ষার মুহূর্তগুলো স্বভাবতই বিরক্তিকর, আর কিছু মানুষের কারণে তা আরও বেশি বিরক্তিকর হয়ে ওঠে। ধরুন, আপনি মেট্রো স্টেশন বা বাস কাউন্টারের সামনে দীর্ঘ সময় ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন। ঠিক যখন আপনার পালা আসে, তখন এমন কিছু মানুষ হঠাৎ করে লাইনে ঢুকে পড়ে, বলেই দেয় যে তাদের ব্যস্ততা অনেক বেশি এবং তারা আর অপেক্ষা করতে পারছে না।

এটা সত্যিই চমকপ্রদ যে অনেক মানুষ সামান্য কোনো তুচ্ছ বিষয়কে কেন্দ্র করে এত কোলাহল তৈরি করে। ট্র্যাফিক জ্যামে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করা তাদের কাছে সাধারণ ব্যাপার। কিন্তু লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে গেলেই হুলুস্থূল কাণ্ড বাধিয়ে ফেলে। হয়তো এটি কোনো শহরের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য—সেখানে কিছু অসভ্য মানুষ থাকবেই, যারা তাদের পালা আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারে না।

দয়া করে আপনারাও তাদের মতো হবেন না। আপনার পালা না আসা পর্যন্ত অনুগ্রহ করে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করুন। এটা ঢাকা শহর আর এখানে আপনাকে অপেক্ষা করতেই হবে।

অনুবাদ করেছেন শবনম জাবীন চৌধুরী

Comments