ফাদার ক্রিসমাস থেকে সান্তা ক্লজ: যেভাবে হয়ে উঠল উৎসবের প্রতীক
প্রতি বছর ২৪ ডিসেম্বর রাতে যে হাসিখুশি বৃদ্ধ মানুষটি চুপিচুপি আমাদের ঘরে ঢুকে পড়ে, তিনি সারা বিশ্বেই প্রিয় এবং বিভিন্ন নামে পরিচিত। কিন্তু তাকে কি ফাদার ক্রিসমাস বলা উচিত, না সেন্ট নিকোলাস, নাকি সান্তা ক্লজ? এদের মধ্যে পার্থক্যই বা কী? তার উৎপত্তি কোথায়? তিনি কি আদতে একজন খ্রিস্টান সাধু, নাকি আধুনিক করপোরেট সংস্কৃতির তৈরি এক চরিত্র?
এই লেখায় আমরা খুঁজে দেখব—ইংল্যান্ডে কীভাবে ফাদার ক্রিসমাসের আবির্ভাব হয়েছিল এমন এক সময়ে, যখন ঋতুভিত্তিক উৎসবগুলো সরাসরি আক্রমণের মুখে পড়েছিল। পাশাপাশি আমরা জানব, আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে সান্তা ক্লজ কীভাবে জন্ম নিলেন এবং উনিশ শতকে এই দুই উৎসব-প্রতীক যখন একে অপরের মুখোমুখি হলো, তখন ঠিক কী ঘটেছিল।
ফাদার ক্রিসমাসের ইংরেজ উৎস
প্রথম দিক থেকে শুরু করে উনিশ শতক পর্যন্ত ফাদার ক্রিসমাস ছিলেন পুরোপুরি একটি রূপক চরিত্র। তিনি কোনো পৌরাণিক সত্তা নন, বরং পুরো ক্রিসমাস ঋতুর প্রতীক। তাকে সাধারণত দেখা হতো এক হাসিখুশি বৃদ্ধ মানুষ হিসেবে, যিনি উৎসবের আসরের সভাপতিত্ব করছেন—কিন্তু তিনি মোটেও উপহার দেওয়া কোনো কোমল চরিত্র ছিলেন না। এর প্রধান কারণ, তখনকার ক্রিসমাস উদযাপন ছিল একেবারেই ভিন্ন রকম—এতে শিশুদের চেয়ে প্রাপ্তবয়স্কদের বিনোদনের দিকটিই বেশি গুরুত্ব পেত। ইলাস্ট্রেটেড লন্ডন নিউজ-এ প্রকাশিত কেনি মিডোজের আঁকায় সেই সময়কার এই প্রাপ্তবয়স্ক-কেন্দ্রিক উৎসবের চিত্র স্পষ্ট দেখা যায়।
ক্রিসমাসকে মানুষের রূপ দেওয়ার সবচেয়ে পুরোনো নিদর্শন পাওয়া যায় ১৫ শতকের একটি ক্যারোলে। সেখানে 'স্যার ক্রিসমাস' নামের এক চরিত্র যিশুর জন্মের সংবাদ জানান এবং শ্রোতাদের বলেন—'মেক গুড চিয়ার অ্যান্ড বি রাইট মেরি'।
ফাদার ক্রিসমাসের আরেকটি সম্ভাব্য পূর্বসূরি পাওয়া যায় ইয়র্ক শহরে, যেখানে ২১ ডিসেম্বর 'ইউল রাইডিংস' নামে একটি উৎসব হতো। সেখানে 'ইউল' সেজে এক ব্যক্তি কেক ও মাংস হাতে রাস্তায় ঘুরে বেড়াতেন এবং ভিড়ের দিকে বাদাম ছুড়ে দিতেন। তবে ১৫৭২ সালে এই শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ করা হয়, কারণ এতে অংশগ্রহণকারীদের আচরণকে 'ভেরি রুড অ্যান্ড বারবারাস' বলে অভিযোগ ওঠে।
টিউডর ও স্টুয়ার্ট যুগে অভিজাত পরিবারগুলোতে ক্রিসমাস উদযাপনের তত্ত্বাবধানে থাকতেন বিশেষভাবে নিযুক্ত 'লর্ড অব মিসরুল'। তাদের নামও হতো বিচিত্র—'ক্যাপ্টেন ক্রিসমাস', 'দ্য ক্রিসমাস লর্ড' কিংবা 'প্রিন্স ক্রিসমাস'।
তবে এই প্রাথমিক ক্রিসমাস-চরিত্রগুলোর কেউই তখনো 'ফাদার' বা বৃদ্ধ মানুষ হিসেবে চিহ্নিত ছিলেন না। এই রূপটি প্রথম দেন নাট্যকার বেন জনসন।
বেন জনসনের 'ওল্ড ক্রিসমাস'
১৬১৬ সালে রাজদরবারে মঞ্চস্থ হয় বেন জনসনের নাটক ক্রিসমাস, হিজ মাস্ক। এখানে 'ক্রিসমাস' চরিত্রটি হাজির হয় পুরোনো ধাঁচের পোশাক পরে, লম্বা ও পাতলা দাড়ি নিয়ে। সে নিজেকে বলে 'ওল্ড ক্রিসমাস' এবং 'ওল্ড গ্রেগরি ক্রিসমাস'। প্রহরীদের ধমক দিয়ে সে অভিযোগ করে—তারা তাকে উৎসবে ঢুকতে দিচ্ছে না। একপর্যায়ে সে জোর দিয়ে বলে, সে তার এলাকার অন্য যে কারও মতোই ভালো প্রোটেস্ট্যান্ট।
এই মন্তব্য ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ সেই সময় পিউরিটানরা ক্রিসমাস উদযাপনকে ধর্মবিরোধী বলে আক্রমণ করছিল।
জনসনের এই ক্রিসমাস চরিত্রটি নিঃসন্দেহে বৃদ্ধ এবং নিঃসন্দেহে একজন বাবা। সঙ্গে আসে তার বহু ছেলে-মেয়ে—যাদের প্রত্যেকেই তৎকালীন উৎসব সংস্কৃতির একটি দিকের প্রতীক। এদের মধ্যে ছিল 'মিসরুল', 'ক্যারল', 'মিন্স পাই', 'মামিং' ও 'ওয়াসেইল'-এর মতো চরিত্র।
ক্রিসমাস নিজে কোনো উপহার আনেননি। তবে তার এক ছেলে, 'নিউ ইয়ার্স গিফট', এনেছিল—একটি কমলা, রোজমেরির একটি ডাল, আদার রুটির মালা, এবং দুই হাতে দুই বোতল মদ।
পিউরিটান আক্রমণ ও ফাদার ক্রিসমাসের বিচার
ইংরেজ গৃহযুদ্ধের আগে, চলাকালীন এবং পরে (১৬৪২–৫১) পিউরিটানদের ক্রিসমাসবিরোধী আন্দোলন আরও তীব্র হয়ে ওঠে। রাজতন্ত্রপন্থীরা তখন ক্রিসমাসকে রক্ষা করতে তাকে আবারও মানুষের রূপ দিয়ে হাজির করে। ১৬৪৫ সালের পুস্তিকা দ্য অ্যারেইনমেন্ট, কনভিকশন অ্যান্ড ইমপ্রিজনমেন্ট অব ক্রিসমাস-এ এক নারী অক্সফোর্ড শহরের ঘোষকের কাছে জানতে চান—'ওল্ড ফাদার ক্রিসমাস কোথায়?' উত্তরে বলা হয়, 'দ্য পুওর ওল্ড ম্যান...ওয়াজ অ্যারেইন্ড, কনডেমড অ্যান্ড আফটার কনভিকশন কাস্ট ইনটু প্রিজন অ্যামাংস্ট দ্য কিংস সোলজার্স; ফিয়ারিং টু বি হ্যাংড'।
১৬৪৭ সালে পার্লামেন্ট ক্রিসমাস, ইস্টার, হুইটসানসহ বহু ঐতিহ্যবাহী উৎসব নিষিদ্ধ করে। ১৬৫২ সালে রাজতন্ত্রপন্থী জন টেলরের দ্য ভিন্ডিকেশন অব ক্রিসমাস প্রকাশিত হয়। আর ১৬৫৮ সালের দ্য এক্সামিনেশন অ্যান্ড ট্রায়াল অব ওল্ড ফাদার ক্রিসমাস পুস্তিকায় ফাদার ক্রিসমাসকে দেখানো হয় সাদা দাড়িওয়ালা, পশম-ঘেরা পোশাক পরা এক বৃদ্ধ হিসেবে। সেখানে তাকে প্রাণদণ্ডের মুখে বিচার করা হলেও শেষ পর্যন্ত তিনি জুরি দ্বারা খালাস পান।
১৬৬০ সালে রাজতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার পর ক্রিসমাসও ফিরে আসে। পরবর্তী দুই শতাব্দী ধরে ফাদার ক্রিসমাস নাটক ও লোকনাট্যে উপস্থিত থাকলেও, ইতিহাসবিদ রোনাল্ড হাটনের স্টেশনস অব দ্য সান গ্রন্থে বলা হয়েছে—
'হি ওয়াজ এসেনশিয়ালি কনসার্নড উইথ দ্য অ্যাডাল্ট ওয়ার্ল্ড, পার্সোনিফাইং ফিস্টিং অ্যান্ড গেমস; হি হ্যাড নো কানেকশন উইথ প্রেজেন্টস, অ্যান্ড হি ওয়াজ নট ট্রিটেড উইথ মাচ রেসপেক্ট, বিইং জেনারেলি আ বার্লেস্ক ফিগার অব ফান'।
সেন্ট নিকোলাস ও সিন্টারক্লাস
ইংল্যান্ডে ফাদার ক্রিসমাস গড়ে ওঠার বহু আগেই ইউরোপে আলাদা একটি কিংবদন্তি জনপ্রিয় হচ্ছিল—সিন্টারক্লাস।
এর শেকড় পাওয়া যায় চতুর্থ শতকের গ্রিক বিশপ সেন্ট নিকোলাসের কাহিনিতে। তিনি ছিলেন আধুনিক তুরস্কের মাইরা অঞ্চলের বাসিন্দা।
তার নামে বহু অলৌকিক ঘটনার গল্প প্রচলিত। একটি গল্পে বলা হয়, এক সরাইখানার মালিক তিন যুবককে হত্যা করে ব্যারেলে লবণ দিয়ে রেখেছিল—সেন্ট নিকোলাস তাদের পুনরুজ্জীবিত করেন।
আরেক গল্পে আছে—এক দরিদ্র মানুষ তার তিন মেয়েকে দাসত্বে বিক্রি করতে যাচ্ছিলেন। গভীর রাতে সেন্ট নিকোলাস চিমনি দিয়ে তিন ব্যাগ সোনা ছুড়ে দেন, যা আগুনের পাশে শুকোতে দেওয়া মোজায় পড়ে।
১০৮৭ সালে তার দেহাবশেষ ইতালিতে নিয়ে যাওয়ার পর সেন্ট নিকোলাসের খ্যাতি ইউরোপজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে ৬ ডিসেম্বর, সেন্ট নিকোলাস ডে-র আগের রাতে শিশুদের উপহার দেওয়ার প্রথা গড়ে ওঠে। নেদারল্যান্ডসে 'সিন্টারক্লাস' নামে পরিচিত এই চরিত্র লাল বিশপের পোশাকে হাজির হতেন।
এই চরিত্রকে ঘিরে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভয়ংকর সঙ্গীরাও যুক্ত হয়—ক্র্যাম্পাস, পেরে ফুয়েতার্ড, রু-ক্লাউস, পেলসনিকেল ও কেনেখট রুপার্ট।
সান্তা ক্লজের আগমন
ঠিক কীভাবে সিন্টারক্লাস আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে আমেরিকায় পৌঁছালেন, তা পুরোপুরি স্পষ্ট নয়। ধারণা করা হয়, ডাচ উপনিবেশ নিউ অ্যামস্টারডাম (পরবর্তীতে নিউইয়র্ক) হয়ে তিনি সেখানে পৌঁছান।
১৭৭৩ সালে রিভিংটন'স গ্যাজেটিয়ার পত্রিকায় লেখা হয়—সেন্ট নিকোলাস ডে, 'অথারওয়াইজ কল্ড সেন্ট আ ক্লজ', উদযাপন করেছে বহু মানুষ।
১৮০৯ সালে ওয়াশিংটন আরভিংয়ের হিস্টরি অব নিউইয়র্কে বলা হয়, ডাচ পরিবারগুলো এখনো সিন্টারক্লাসের গল্প শোনাত। ১৮২১ সালের কবিতা ওল্ড স্যান্টেক্লজ উইথ মাচ ডিলাইট প্রথম স্লেজ ও রেইনডিয়ার তুলে ধরে।
১৮২৩ সালে ক্লেমেন্ট ক্লার্ক মুরের এ ভিজিট ফ্রম সেন্ট নিকোলাস—যা আমরা দ্য নাইট বিফোর ক্রিসমাস নামে জানি—সান্তাকে পূর্ণতা দেয়।
চিত্রশিল্পী থমাস ন্যাস্ট ১৮৮১ সালে মেরি ওল্ড সান্তা ক্লজ আঁকার মাধ্যমে সান্তার চেহারাকে চূড়ান্ত করেন।
এমন একটি ধারণা কারো কারো আছে যে, সান্তা ক্লজ কোকা-কোলার উদ্ভাবন। কিন্তু ১৯৩০ এর দশকের আগে কোকা-কোলা তাদের কোনো বিজ্ঞাপনে সান্তা ক্লজকে ব্যবহার করেনি। কাজেই এই ধারণাটি সম্পূর্ণ ভুল।
ফাদার ক্রিসমাস ও সান্তার মিলন
১৮৬৪ সালে সুজানা ওয়ার্নারের লেখায় সান্তা ও ফাদার ক্রিসমাস প্রথম একসঙ্গে হাজির হন। ১৮৭৯ সালে নোটস অ্যান্ড কোয়ারিজে এডউইন লিস লিখেছিলেন—তিনি জানেন না 'স্যান্টিক্লজ' কোন অঞ্চল থেকে আসেন।
১৮৮০-এর দশকে সান্তা ও ফাদার ক্রিসমাস প্রায় পুরোপুরি একীভূত হয়ে যান। অক্সফোর্ড ডিকশনারি অব ইংলিশ ফোকলোর জানায়—১৮৮৩ সালে এক ফরাসি পর্যটক বলেন, ফাদার ক্রিসমাস চিমনি দিয়ে নেমে মোজায় উপহার দেন—এটা ইংল্যান্ডে সবার জানা।
পাঞ্চ ম্যাগাজিন তখন 'ফাদার ক্রিসমাস নট আপ-টু-ডেট' ও 'ফাদার ক্রিসমাস আপ-টু-ডেট' নামে কার্টুন ছাপে।
এক ভিক্টোরিয়ান ক্রিসমাস আইকন
ভিক্টোরিয়ানরাই আমাদের আধুনিক ক্রিসমাস তৈরি করেছে। শিশু, পরিবার, দানশীলতা ও ধর্ম—সব মিলিয়ে এক নতুন উৎসব। এই উৎসবের জন্য দরকার ছিল এক উদার, হাসিখুশি, শিশুপ্রেমী চরিত্র। সান্তা ক্লজ সেই শূন্যস্থান পূরণ করেন।
নামে ফাদার ক্রিসমাস হোক বা সান্তা ক্লজ—এই চরিত্র আজ বিশ্বজুড়ে ক্রিসমাস সংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দু এবং আপাতত তার বিদায়ের কোনো লক্ষণ নেই।


Comments