মঞ্চনাটক আর শীতের সন্ধ্যাগুলো

মঞ্চনাটক আর শীতের সন্ধ্যাগুলো

ঢাকার শীত কখনোই খুব কড়া নয়, তবু যখন ডিসেম্বরের বাতাস শহরে হানা দেয়, তখন তাকে আলাদা করেই চিনতে হয়। সেই শীতের সন্ধ্যাগুলোতে, বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে আমি আর আমার বন্ধুদের অন্যতম আকর্ষণ ছিল মঞ্চনাটক। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির নাট্যমঞ্চ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশের নাটমণ্ডল কিংবা বেইলি রোডের মহিলা সমিতির মঞ্চ। গায়ে জড়ানো উষ্ণ শাল, গলায় মোটা মাফলার, আর কাঁধে বন্ধুর হাত—এই ছিল আমাদের সাংস্কৃতিক সন্ধ্যাগুলো।

বিশ্ববিদ্যালয়জীবন তো যেন নিজেই একটি নাটক! এক বন্ধু মহলেই কত ভিন্ন চরিত্র, নানা সংঘাত, হাসি-কান্না আর একেকজনের রোজকার ব্যস্ততা। কিন্তু এই হেমন্তের শেষ থেকে শিট শুরুর সন্ধ্যাগুলো আমরা পার করেছি অন্য এক মঞ্চে, যেখানে আলো-আঁধারের খেলায় চলত মঞ্চনাটকের অভিনেতাদের অন্যরকম পাঠ। যখন শিল্পকলা কিংবা মহিলা সমিতির অডিটোরিয়ামে পৌঁছাতাম, তখন মনে হতো শহরের কোলাহল থেকে বেরিয়ে এক ভিন্ন মঞ্চে চলে এসেছি।

মঞ্চের কাঠ, রঙ, স্পটলাইটের তাপ আর দর্শকদের উত্তেজনা মিলিয়ে সেই পরিবেশ আমাদের ছাত্রজীবনের ক্লান্তি দূর করতো তো বটেই; কখনো রাজনৈতিক ব্যঙ্গ, কখনো লোকসংস্কৃতি, কখনো মানবিক সংকটে ঘেরা নাটক ছিল আমাদের চিন্তা, মননের এক খোরাক। অনেক সময় টিকিট না পেয়ে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেছি, আর পেয়ে গেলে মনে হয়েছে, একটি সন্ধ্যা বাঁচিয়ে ফেললাম।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটমণ্ডলের অভিজ্ঞতাগুলো ছিল আরও আপন। নিজ ক্যাম্পাসে নাটমণ্ডলের রহস্যময় আলো-আধারির মিশেল, ছোট্ট অডিটোরিয়ামের ঘনিষ্ঠতা, আর মঞ্চের ঠিক সামনে বসে অভিনেতাদের নিপুণ অভিনয়, সংলাপ বলে যাওয়া, কণ্ঠের কম্পন, সবকিছু খুব কাছ থেকে দেখে নেওয়ার সুযোগ ছিল। আমরা প্রায়ই ভাবতাম, কীভাবে এতও এতও সংলাপ তারা বলে যাচ্ছে। মঞ্চনাটকের সঙ্গে পর্দার নাটকের এই এক বিশাল তফাৎ। কখনো অভিনেতারা আমাদের দর্শক সারির মাঝে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে সংলাপ বলতে বলতে। আবার কখনো হুট করেই অভিনেতাদের পাশ থেকেই বেরিয়ে এলেন নাটকের আরেক মূল চরিত্র।

মঞ্চনাটকের এই বিষয়গুলো শুধু বোঝা যায়, যারা মঞ্চে যেয়ে নাটক দেখেছেন তারাই জানেন। এমন অনেক সন্ধ্যা আছে যখন নাটকের কোনো এক দৃশ্যে অডিটোরিয়ামে নেমে আসা নিস্তব্ধতা আমাদের সব দর্শকদের মন ভারী করে দিত। আবার পরক্ষণেই কোনো হাসির দৃশ্যে পুরো হল একযোগে কেঁপে উঠত। এখানেই পর্দার নাটক আর আলো এবং তার রহস্যময় সহোদরা আধারির মিশ্রণে মঞ্চনাটকের বিস্তর পার্থক্য, যেন এক রোমাঞ্চ!

আমার এখনো মনে আছে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে দেখা বেশ কয়েকটি নাটকের দৃশ্য! অন্ধকারে মিথেন, এর পুরো কাহিনীজুড়েই ছিল অস্থিরতা, প্রশ্ন, আর একেবারে সব শেষে সেই জটিল সূত্রের সহজ সমাধান উন্মোচন। নাটমণ্ডলে দেখা শেক্সপিয়রের ম্যাকবেথ। মঞ্চের আলো-আঁধারে শেক্সপিয়ারের ট্র্যাজেডি যেন আরও ঘন, আরও স্পর্শকাতর হয়ে উঠেছিল। সংস্কৃতির যে কোনো বাঁধ নেই, প্রবাহিত নদীর মতোন বহমান, এই নাটকগুলো আমাকে তা স্মরণ করিয়ে দিত।

নইলে কোন পাশ্চাত্যের এক ক্লাসিক প্রাচ্যের এক বিশ্ববিদ্যালয়ে এত শত বছর পরেও সেগুলো মঞ্চস্থ করছেন শিক্ষার্থীরা। আবার টুয়েলভ অ্যাংরি মেন দেখার অভিজ্ঞতা ছিল আরেক ঘরানার। একজন মানুষের ভাগ্য নিয়ে ১২ জনের যুক্তি-তর্ক আবার পাল্টা যুক্তির স্রোত শুনতে শুনতে মনে হয়েছিল, মঞ্চ কি সত্যিই বাস্তবকে ছাড়িয়ে যেতে পারে না?

এরপরের পাঠ শীতের রাতে বাড়ি ফেরা। নাটকগুলো বেশিরভাগই যেহেতু শুরু হতো সন্ধ্যার পরে, তাই শেষও হতো রাতে। বাসা থেকে বকুনি খাওয়ার প্রচলন তখনো বিদ্যমান। একটু রাত হলেই শুরু হয়ে যেত এই রেওয়াজ। কিন্তু এত বকুনি, শাসন উপেক্ষা করেও আমি এবং আমরা, বন্ধুরা মশগুল থাকতাম আমাদের আলোচনা নিয়ে। মাফলার শক্ত করে জড়িয়ে বন্ধুদের সঙ্গে টিএসসির চা-স্টল কিংবা পলাশীর রাস্তাটুকু ধরে হাঁটতে হাঁটতে আলোচনা চলত, আজকের নাটকের কোন দৃশ্যটা সবচেয়ে বেশি স্পর্শ করল, কোন সংলাপ মনে গেঁথে রইল, কোন চরিত্র জীবনের সঙ্গে কতটা মিলে গেল, আর কোন চরিত্রটি জীবনের সব হেলাকে তুচ্ছ করে ফিনিক্সের মতো বর্ষীয়ান হয়ে উঠল। আমাদের আলোচনা কখনো রাত ১১টাও পেরিয়ে যেত, তবু এ যেন ক্লাসরুমের পড়াশোনার চেয়েও বেশি জরুরি ছিল।

আজ তাই এত বছর পরও শীত এলেই মনে পড়ে সেই উষ্ণতার শাল জড়ানো সন্ধ্যা আর রাতগুলোর কথা। মনে পড়ে শিল্পকলার উজ্জ্বল আলো, আবার পরক্ষণেই আধারের রহস্য, নাটমণ্ডলের উষ্ণতা মায়া, আর বন্ধুদের সঙ্গে কাটানো সেই অমলিন সময়। যে নাটকগুলো দেখেছিলাম, সেগুলো হয়তো কতবার মঞ্চস্থ হয়েছে, কতবার বদলে গেছে, অভিনেতাদের অনেক রদবদল হয়েছে জীবনের পালাক্রমে, কিন্তু আমার স্মৃতিতে নাটকগুলো রয়ে গেছে ঠিক যেমনটা দেখেছিলাম তেমনটাই।

Comments